ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:২৩:২৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

সুলতানা রাজিয়া: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক 

অনলাইন ডেস্ক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৫৬ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক কালজয়ী নারী সুলতানা রাজিয়া। প্রায় ৮০০ বছর আগে ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন তিনি। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিসের কন্যা রাজিয়া। তবে রাজকন্যা হিসেবেই রাজত্ব লাভ করতে পারেননি তিনি। দরবারি মোল্লা, আমীর-ওমরারা একজন নারীকে শাসক হিসেবে মেনে নিতে রাজী হয়নি। এজন্য লড়াই করেই তাকে রাজ সিংহাসনে বসতে হয়েছে। তার পাশে ছিল জনগণ ও সেনাবাহিনী। ‌তীক্ষ্ম বুদ্ধিমতি, ন্যায় পরায়ণ ও জনদরদী শাসক ছিলেন তিনি। আবার যুদ্ধক্ষেত্রেও ছিলেন একজন দক্ষ সেনাপতি। সৈনিক হিসেবেও লড়েছেন বীরের মতো। মৃত্যুবরণও করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রেই। এজন্য ভারতবর্ষ তো বটেই, মুসলিমবিশ্বের ইতিহাসেও আলোচিত নারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বাঙালী-অবাঙালী, আরব-অনারব এমনকি ইংরেজদের কাছেও প্রসিদ্ধ তিনি। সুলতানা রাজিয়ার বীরত্ব গাঁথা ও জীবনকাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমা, হয়েছে টিভি সিরিজ, লেখা হয়েছে গল্পও।


তখন দিল্লিতে মুগল শাসনের অবসান ঘটেছে। চলছে জনসমর্থিত সুলতানী শাসন। অভিজাত শাসক শ্রেণীর সমর্থক ইতিহাসবিদরা এই শাসনকালকে চিহিœত করেছেন তথাকতিথ দাসযুগের শাসন হিসেবে। এর নেপথ্য কারণ শেষদিকের অভিজাত মোগল শাসক শ্রেণীর রাজ্য পরিচালনায় অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ও বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট গোলযোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। যার কারণে শাসক শ্রেণীর ভিতর থেকে উঠে আসে নতুন শাসক শ্রেণী। যারা ইতোমধ্যে সরাসরি ক্রিতদাস থেকে শিক্ষায়-দীক্ষায় নিজ যোগ্যতায় রাজ কার্য পরিচালনার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণে পদে আসীন হয়েছিলেন।

তাদেরই একজন ছিলেন, সুলতানা রাজিয়ার নানা দিল্লির অন্যতম সফল সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক। তিনি নিজেও ছিলেন একজন ক্রীতদাস। দিল্লির সুলতান শিহাবুদ্দীন ঘুরী তার জ্ঞানে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে কিনে নিয়েছিলেন তৎকালীন অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধি কাজী ফখরুদ্দীন কুফির কাছ থেকে। কাজী সাহেব তাকে কিনেছিলেন দিল্লির বাজার থেকে। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে কাজী সাহেব তাকে শিক্ষিত ও মার্জিত করে গড়ে তুলেছিলেন। পরে সুলতান তাকে কিনে নিয়ে যুদ্ধকৌশল শিক্ষায় পাঠিয়ে দেন। একসময় তিনি দক্ষ সৈনিক ও পরে খুব অল্প দিনেই নিজের বীরত্ব, সাহস এবং তিনি সেনাপতি হয়ে ওঠেন। সৌভাগ্যক্রমেএকদিন কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লির সা¤্রাজ্যের সুলতান পদে সমাসীন হন। তখন তার আশেপাশে অনেক দাস-দাসী, গোলাম-বাঁদি। এদেরই একজন শামসুদ্দীন ইলতুতমিশ। সুলতানা রাজিয়ার বাবা।

এই ইলতুতমিশের রূপ ও সৌন্দর্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ভাইয়েরা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল ক্রীতদাস হিসেবে। প্রথমে বুখারার এক ক্রেতা তাকে কিনে নেন। তারপর তাকে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হয় দিল্লিতে। ততদিনে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে তিনি বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। গোলামের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কিনে নেন তৎকালীন সুলতান কুতুবুদ্দীন। তারপর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও উন্নত শিক্ষা-দীক্ষায় দিক্ষিত করে ইলতুতমিশের অবস্থান দাস থেকে সমুন্নত করেছিলেন অনেক উঁচুতে। অপরদিকে তিনি নিজের মেধা, যোগ্যতা, বিশ্বস্থতা ও অসাধারণ প্রতিভার গুণে মোহিত করেছিলেন সুলতান কুতুবুদ্দীনকে। মুগ্ধ সুলতান কুতুবুদ্দীন শুধু রাজপদ দিয়েই ক্ষ্যানত হননি, ইলতুতমিশের সাথে নিজের কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন।

কুতুবুদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর শামসুদ্দীন ইলতুতমিশ তাই নিজেকে রাজ্যের অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এসময় বিচারপতি এবং রাজ্য দরবারের আলেম ও মুফতিরা তার দাসত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখন ইলতুতমিশ, একটি রাজকীয় ঘোষণাপত্র বের করে দেখান, যেখানে সুলতান কুতুবুদ্দিনের নিজের হাতে তার দাসত্বমুক্তির বিষয়ে দস্তখত করেছিলেন। এরপর রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাকে মেনে নেন এবং নতুন সুলতান হিসেবে ইলতুতমিশ রাজ্যশাসন শুরু করেন। ১২১০ সাল থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে একজন দক্ষ শাসকের খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। এসময় বিভিন্ন অঞ্চলের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ দমনে সফলতার পাশাপাশি তিনি রাজ্যে ন্যায় ও ইনসাফের শাসন প্রতিষ্ঠা করে জনগণের আস্থা অর্জন করেন। সা¤্রাজ্যে শান্তি ও জনমনে স্বস্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে আরবী খচিত রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। তার সময়ে বাগদাদের খলিফার পক্ষ থেকে ভারতবর্ষে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছিল।

এই শামস-উদ-দীন ইলতুতমিশেরই কন্যা ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সুলতানা রাজিয়া। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২০৫ সালে। সিংহাসনে আরোহন করেন ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে।  তবে রাজিয়ার রাজ সিংহাসন লাভ বাবার মতো সহজ ছিলনা। মৃত্যুর আগে সুলতান ইলতুতমিশ উইল করে রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গেলেও ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর দিল্লির দরবারের নারী বিদ্বেষী আলেম সমাজ ও রাজ্যের আমির-ওমরাহগণ ইউলের বিরোধিতা শুরু করেন। তারা যুক্তি দেন, ইলতুতমিশের পুত্র থাকার কারণে কন্যা উত্তরাধিকারী হতে পারে না। কিন্তু তার আপন ভাইয়েরা উইলের বিষয়ে জানতেন বলে এ বিষয়ে কোন আপত্তি করেনি। কিন্তু তার সৎ মা এ বিষয়ে আলেম ও আমির-ওমরাদের সাথে মিলে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বুদ্ধিমতি রাজিয়া এ বিষয়ে কোন বিরোধে না গিয়ে উইলে বর্ণিত নিজের সুলতান হওয়ার অধিকার সৎ বড় ভাই রোকুনুদ্দিনের অনুকূলে ছেড়ে দেন। দরবারের নারী বিদ্বেষী আলেম রাজ্যের আমির-ওমরাহগণ রুকুনুদ্দিন ফিরোজ শাহকে সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিছুদিনের মধ্যেই বিচক্ষণ রাজিয়ার বুদ্ধিমত্তা কাজ দিতে শুরু করে। শাসক হিসেবে রুকুনুদ্দিন ছিলেন অযোগ্য। রাজকার্য ও জনকল্যাণে তার মন ছিল না। নারীদের ধরে এনে আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসিতার পাশাপাশি তার স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রতিহিংসার কারণে বাবার হাতে গড়া সুশৃঙ্খল রাজ্যের সর্বত্র অস্থিরতা সৃষ্টি হতে শুরু করল। অল্প সময়েই জনগণ ভীত স্বতন্ত্র ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ছেলেদের বিষয়ে এমন আশঙ্কা ছিল বলেই বাবা ইলতুতমিশ কোন ছেলেকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার মনোনিত না করে মেয়েকে করেছিলেন।

মিনহাজ সিরাজ তার গ্রন্থ ‘তাবাকাতে নাসিরী’তে  সুলতান রুকনুদ্দীন ফিরোজ শাহের বিষয়ে লিখেছেন, ‘এই তরুণ শাসক নিজেকে অশ্লীলতা ও অনৈতিকতার সাগরে ভাসিয়ে দিলেন।’ ইতিহাস বলে, ফিরোজশাহ প্রয়োজনীয় রাজ কাজ বাদ দিয়ে হাতির পিঠে চড়ে আমোদভ্রমণে বের হতেন। বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াতেন আর প্রজাদের সুন্দরী রূপসী কন্যাদেরকে তুলে আনতেন হেরেমে। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নারীদের নিয়ে সময় পার করে দিতেন। এসবের প্রতিবাদ করায় আপন ভাই কুতুবুদ্দীনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। এমনকি কৌশলে বোন রাজিয়াকেও মেরে ফেলার জন্য চক্রান্ত করেছিলেন তিনি। তার এ পরিকল্পনার পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছিল তার মা। এই মহিলা স্বামীর প্রিয় তার সতীনের মেয়ে রাজিয়াকে মোটেই সহ্য করতে পারতেন না আগে থেকেই।

এদিকে নতুন সুলতানের এসব অন্যায় ও অত্যাচার জনগণকে ক্রমেই বিক্ষুব্ধ করে তুলছিল। তারা মনে মনে এই অযোগ্য সুলতানের পতন কামনা করলেও কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিল না। রাজ্যের এমন দূরবস্থা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র অন্দর মহলের ভেতর থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন রাজিয়া। এসময় বুদ্ধিমতি রাজিয়ার মাথায় আসে তার বাবার প্রচলিত একটি রীতির কথা। তার বাবা নির্যাতিত জনগণের অভিযোগ শোনার জন্য এক অভিনব পন্থ আবিষ্কার করেছিলেন। তখন ভারতবর্ষের মানুষের সাধারণ পোষাক ছিল সাদা রঙের কাপড়। তিনি ঘোষণা করে দিলেন, রাজ্যে কারো প্রতি কোনো অন্যায় হয়েছে বলে কেউ মনে করলে বা কেউ কোনভাবে প্রতারিত বা নির্যাতিত হয়েছে বলে মনে করলে, সে যেন রঙিন কাপড় পরিধান করে তার দরবারে আসে। এভাবে দরবার কাপড় দেখেই তিনি তাদের আর্জি শোনার জন্য ডেকে নিতেন। বঞ্চিত এবং শোষিত মজলুম মানুষ তখন রঙিন কাপড় পরে তার দরবারে আসতো এবং তিনি তাদের ফরিয়াদ শুনে ন্যায় বিচার করতেন। এক পর্যায়ে তার মনে হলো, সব রঙিন কাপড়ের খোঁজ নেওয়া হয়তো তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে, তাই তিনি তার দরবার এবং প্রাসাদে ঘন্টা ঝুলিয়ে দিলেন। যাতে দিন বা রাতের যে কোনো সময় কোনো অসহায় মানুষ এ ঘন্টা নাড়ালে তিনি তার আর্জি শুনতে পারেন।

যাইহোক, রাজিয়া গোপনে প্রাসাদের বাইরে যাতায়াত শুরু করলেন। বাবার আমলে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী একটি লাল রঙের জামা পরে ঘুরতে লাগলেন। তাকে দেখে আশেপাশের লোকজন জড়ো হতে লাগলো। শাসক ভাইয়ের কুকর্ম নিয়ে জনগণের অভিযোগ শুনতে লাগলেন। প্রাসাদে তাকেও হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে জনগনকে জানালেন। জনগণ নির্যাতনের পোষাক পড়ে সমবেত হতে লাগলো। এক শুক্রবারে মসজিদে সমবেত সবার কাছে থেকে তার বাবা ইলতুতমিশের করা উইলের কথা তুলে ধরলেন। এসময় তিনি সুলতান ইলতুতমিশের সুনাম রক্ষা এবং রাজ্যের নির্যাতিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিরোধের ডাক দিলেন। নিজের পক্ষে সবার সাহায্য চাইলেন। সমবেত সবাই রাজিয়ার পাশে থাকার শপথ নিলেন। এরপর একদিন রঙিন পোশাকের জনগণ হাজির হয় রাজ-দরবারে। হাজার জনতার আগমনে প্রাসাদ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এসময় প্রাসাদের সেনারা রাজিয়ার পক্ষ নেন। ফলে সুলতান রুকনুদ্দীন ফিরোজ শাহ পদচ্যুত হন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আমির-ওমরাহগণ রাজিয়াকে সুলতানা হিসেবে মেনে নিতে রাজি হন। ইতিহাসের বিবরণে সেদিনটি ছিল, হিজরী বর্ষপঞ্জীর ৬০৪ হিজরীর ১৮ রবিউল আউয়াল। খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জীর হিসাবে ১২৩৬ সালে সুলতানা রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন।

এ বিষয়ে ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘ওই সময় উপস্থিত ক্ষুব্ধ জনতা রাজিয়াকে সিংহাসনে সমাসীন করে এবং তাকে নিজেদের সুলতানা হিসেবে মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয়।’ এভাবেই ইতিহাসে একজন নারী হয়েও সুলতানা রাজিয়া নিজের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতায় সব প্রতিকূল পরিস্থিতি দৃঢ়তার সাথে জয় করে নিজের দক্ষতা এবং সাহসিকতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেই প্রকাশ্য দরবারে বিনা অপরাধে নিজের আপন ভাইকে হত্যার অভিযোগে ফিরোজশাহের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন তিনি।

ইতিহাসে সুলতানা রাজিয়াকে একজন বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসক হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে। যার জন্য হাজার বছরের ভারত বর্ষের ইতিহাসে তিনি নিজের স্থান করে নিতে পেরেছেন। রাজকার্য পরিচালনায় সুলতানা রাজিয়া অন্তঃপুরবাসীনি ছিলেন না। তিনি প্রকাশ্য দরবারে পুরুষের মতো রাজকীয় পোশাক পরিধান করে সিংহাসনে আরোহন করতেন। তিনি আলখাল্লা এবং পাগড়ি পরে জনসম্মুখে আসতেন। সুদৃঢ় ভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করায় দ্রুত রাজ্যের সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এক্ষেত্রে পিতা ইলতুৎমিশই তাকে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি যখন যুদ্ধের জন্য রাজধানী ত্যাগ করতেন, তখন তার পক্ষে রাজ্য পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার এখতিয়ার দিয়ে যেতেন এই রাজিয়াকেই। রাজপরিবারে সেই সময় রাজিয়ার চেয়ে যোগ্য আর দক্ষ কেউ ছিলেন না। সেটা তিনি যেমন রাজার অবর্তমানে প্রমাণ করেছেন আবার সিংহাসনে আরোহন করেও প্রমাণ করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু হাতির পিঠে চড়ে নয় ঘোড়ায় চড়েও তিনি একেবারে সামনে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন। তিনি দক্ষ অশ্বারোহী ছিলেন এবং বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। পিতার সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েও রাজিয়া প্রমাণ করেছেন নিজের সাহসিকতা, অশ্বারোহণের দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলি, যুদ্ধের ক্ষিপ্রতা। সেজন্যই পিতা রাজিয়াকে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করেগিয়েছিলেন।

ইতিহাসের বিবরণ অনুযায়ী, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কুরআন পাঠ করতে পারতেন। তিনি ছিলেন বাগ্মি। কবিতাও লিখতেন। তিনি নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মক্তব/টোল প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সাহিত্যিক, শিল্পী ও কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তার শাসনামলে সঙ্গীত ও চিত্রকলারও প্রভূত বিকাশ সাধিত হয়। তার সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যেও উন্নতি সাধিত হয়। তিনি যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেন। রাস্তার দুই পাশে বৃক্ষ লাগানো হয় এবং পানি সরবরাহের জন্য অসংখ্য কুয়ো খনন করা হয়।

সুলতানা রাজিয়ার রাজ্য শাসন প্রসঙ্গে  ইতিহাস পাওয়া যায়, তিনি সভাসদ, আমির-ওমরাহদের সাথে প্রকাশ্য দরবারে খোলামেলা আলোচনা করতেন। প্রয়োজনে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে আইন বা নির্দেশ জারি করতেন। তিনি খুবই উদার ও জনদরদি শাসক ছিলেন। তিনি হিন্দুদের ওপর অর্পিত বর্ধিত কর বিলোপ করেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ দরবারি আলেম ও আমির-উমরাহগণ মোটেও মন থেকে মেনে নিতে পারেন করেননি। তাই দরবারি আলেম ও আমির উমরাহগণ পরোক্ষ ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। সুলতানা রাজিয়ার পুরুষালী রাজকীয় আচার-আচরণ নিয়ে রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়। রাজিয়া কেন ঘোমটা ব্যবহার করেন না। পুরুষের বেশে চলাফেলা করেন Ñএসব প্রচারণা রক্ষণশীল জনগণ লুফে নেয়। তারা এসব মোটেই পছন্দ করতো না।

সুলতানা রাজিয়া বাবার কাছ থেকে প্রজাবাৎসল্যের পাশাপাশি আরেকটি গুণ লাভ করেছিলেন, দাসদের মধ্যে থেকে প্রতিভা অন্বেষণ। তিনি জামালুদ্দিন ইয়াকুত নামের  এক দাসের গুণমুগ্ধ হন এবং তার দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার কারণে ধীরে ধীরে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে আনতে শুরু করেন। তবে এটা করতে গিয়ে তিনি ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীর একাংশের বিরাগভাজন হতে শুরু করেন। এটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে অতুর্কি বংশোদ্ভুত এই ব্যক্তিকে রাজকীয় আস্তাবলের প্রধান নিযুক্ত করার ঘটনা দিয়ে। এই পদটি তুর্কি বংশোদ্ভূত কোন দক্ষ ও প্রভাবশালী সেনাপতির জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু বিষয়টি হয় তার নজর এড়িয়ে যায় অথবা তিনি পাত্তা দেননি। শুধু তাই নয়, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে করতে এক পর্যায়ে শাসনকার্য পরিচালনায় রাজিয়ার উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়ে যান জামালুদ্দিন। এটা মেনে নিতে পারেননি দরবারের আলেম-আমীর-ওমরাহগণ। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, জামালুদ্দিনের প্রতি রাজিয়ার এমন দুর্বলতা ছিল যে, তিনি শাসনকার্য পরিচালনায় কেবলই তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। অনেকে তাকে রাজিয়ার প্রেমিক বলেও অভিহিত করেন।

ঘটনা এতোটাই বিস্তার লাভ করে যে, জামালুদ্দিন ইয়াকুতের প্রতি সুলতানা রাজিয়ার মাত্রাধিক দুর্বলতা ও তাকে বিশেষ মর্যাদা দানের জন্য সেনা বাহিনীর একাংশের উস্কানীতে আলতুনিয়া নামের একজন গভর্ণর রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সুলতানা রাজিয়া বিদ্রোহ দমনে যখন অভিযানে বের হন, তখনও জামালুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়েই যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু বিদ্রোহী দমনে ব্যর্থ হন রাজিয়া। বিদ্রোহীদের দলে ছিল বেশি সৈন্য। জামালুদ্দিন দক্ষ যোদ্ধা বা সেনাপতিও ছিলেন না। যুদ্ধে জামালুদ্দিন নিহত হন এবং আলতুনির হাতে বন্ধি হন রাজিয়া। দিল্লিতে সুলতানা রাজিয়ার এই বিপর্যয়ের সংবাদ পৌঁছলে দ্রুত দিল্লির দরবারি আলেম-আমির-ওমরাহগণ রাজিয়ার ভাইকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন।

ইতিহাস বলে, বিচক্ষণ সুলতানা রাজিয়া বন্দি অবস্থায় আলতুনিয়াকে বিয়ে করে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুর্কী সেনারা সুলতানা রাজিয়ার পক্ষ ত্যাগ করে নতুন রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ফেলেছে। যা জানতে পারেননি রাজিয়া অথবা উপেক্ষা করেছেন। আলতুনিয়ার সৈন্যবাহিনীসহ নিজের ক্ষয়িষ্ণু রাজকীয় বাহিনী নিয়ে সুলতানা রাজিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তবে দূত পাঠিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি জেনে বা না জেনেই তিনি রাজধানী পুনরুদ্ধার করার অভিযানে নেমেছিলেন কীনা ইতিহাসে তার উল্লেখ নেই। তবে  ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লি অভিযান শুরু করেন। কিন্তু দিল্লির উপকণ্ঠে পৌঁছে রাজিয়াকে যুদ্ধ করতে হয় তারই পক্ষত্যাগকারী ও দিল্লির নতুন সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে। সুলতানা রাজিয়া ও আলতুনিয়ার মিলিত বাহিনী বিপুল বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এই যুদ্ধে রাজিয়া বীরের মতো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেলেন, ফলে অনেক সৈনিকই নিজ রাজার বিরুদ্ধে লড়তে মনোবল পাচ্ছিলেন না। এরমধ্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে রাজিয়া বিরোধী কুচক্রিরা একজনকে পক্ষত্যাগকারী হিসেবে সুলতানার রাজিয়ার যুদ্ধ শিবিরে পাঠায়। সে রাজিয়ার খাদ্যে বিষ প্রয়োগ করে। পরের দিন লড়াই করতে যেয়ে বিষক্রিয়ায় দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েন রাজিয়া এবং যুদ্ধে নিহত হন। পরবর্তীতে সুলতানা রাজিয়াকে বীরের মর্যাদায় সেখানেই  দাফন করা হয়। দিল্লির উপকণ্ঠে তার কবরের ওপর একটি সমাধি নির্মাণ করে দেয়া হয়।