ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ২:৪০:২৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

আমার ঠাকুরমা ‘প্রমোদিনী বসু` ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

তপতী বসু

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:১২ এএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ শুক্রবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর আমার ঠাকুমা মারা যান৷ ঠাকুরমা 'প্রমোদিনী বসু' ছিলেন বরিশালের মেয়ে৷ গ্রামের নাম রায়েরকাঠী৷ ঠাকুরমা ছিলেন বাগেরহাটের বৌ৷ গ্রামের নাম পারমধুদিয়া৷ ঠাকুমার জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে কোলকাতা এবং তার আশেপাশে৷ এই বিভিন্ন জায়গায় বসবাসে তাঁর চরিত্রে ছিল নমনীয়তা৷ বিরুদ্ধ সংষ্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করে লেখা পড়ার প্রতি ছিল আগ্রহ৷ ১৮৮৭র প্রমোদিনী বসু পড়তে পারতেন রামায়ণ -মহাভারত..আরো নানান বই৷ ঠাকুর দা মারা যাবার পরে কঠোর নিয়ম মেনে চলতেন৷ সাদা শেমিজের উপরে ধবধবে সাদা থান, আর চুল ছোটো করে ছাঁটা ঠাকুমা!এমনটাই দেখতে দেখতে আমাদের অতি শৈশবটা একটু একটু করে বড় বেলার দিকে এগিয়ে আসছিলো৷

আমার মায়ের সাথে তাঁর ছিলো অতি আপন সম্পর্ক৷ মায়ের বাবা-মা ষাটের দশকের প্রথম দিকে চলে আসেন ভারতে৷ মা তখন থেকে ঠাকুমার কন্যাসম৷ ঠাকুমার বাবার বা শ্বশুরের দিকে কেউ ছিলেন না ওখানে-তাঁরও পিছুটান ছিলোনা কোনো৷ বাবার শ্রদ্ধা -ভালোবাসা মিশ্রিত অতি কড়া নজর ছিলো তাঁর মায়ের প্রতি। অতি সংক্ষেপে বিদ্যাসাগরীয় মাতৃভক্তি বললে বুঝতে সুবিধা হবে৷

ঠাকুমার যত্নের সমস্ত দায়িত্ব মা নিজের হাতে এবং কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন৷ একাহারী-শাকাহারী ঠাকুমা সকাল থেকে উপোস থাকতেন, এমনকি জলটুকু ও  পান না করে৷ একটু একটু করে কুটনো কুটতেন শাক-লতা-আনাজের..৷ মা অতি যতনে সে সব রেঁধে কালো পাথরের থালা বাটিতে গুছিয়ে দিয়ে তারপর রাঁধতেন মাছ..৷ ঠাকুমা খাওয়া শেষে একটুখানি ঘুমাতেন৷ বিকালে নিজের লাঠিখানি নিয়ে ঘুরতেন ফিরতেন আমাদের আনন্দ নিকেতনের এখানে ওখানে..৷ রাতে পুত্রটি ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকতেন, তারপর পাথরের গ্লাসে একটুখানি গরম দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে যেতেন..৷ নিজের বাবার আলয়ে থাকার সময় থেকেই দুধ ছিল তাঁর প্রিয় পানীয়..৷

বালতি ভরে ঘরে আসত ধবলীর দুগ্ধ৷ লোহার কড়াইতে মা জ্বাল দিতেন, দুগ্ধফেননিভ সুগন্ধি বাতাসে রান্নাঘর ছাড়িয়ে উঠানে ছড়িয়ে যেত৷ কোথা থেকে কাক উড়ে এসে জুড়ে বসে কাপড় মেলা তারে হৈচৈ বাঁধাতো৷ লাল বুলি সাদা বুলি নামের দু'টি কুকুর সাবধান দূরত্বে ঘেউ মেউ জুড়তো৷ সব মিলিয়ে সে এক মিলন মেলার উৎসব৷ ঠাকুমার জন্যে মা কাগজি লেবু দিয়ে বানিয়ে দিতেন ছানা৷ একাদশীর দিন বাবা নিয়ে আসতেন বাগেরহাটের সেরা ঘোষের দোকানের সন্দেশ৷ ঠাকুমা লাজুক মুখে হাসতেন, সন্তানের ভালোবাসার ছোঁয়ায়৷

বাবা তাঁর নিজের মায়ের জন্যে কিনেছিলেন আমাদের ধবলীকে৷ প্রায় দুধ সাদা ধবলী আর তার রাঙি বাছুর আলো করে রাখতো আমাদের ইট পাতানো গোয়ালকে৷ বাঁধানো চাড়িতে কুচোনো খড় আর চিটে গুড় খেতো তারা জাবর কেটে৷ সন্ধেতে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে দেওয়া ধুপের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠতো৷ রাঙি বাছুর ধবলীর গাঁ ঘেঁষে নাক উঁচিয়ে তারই গন্ধ নিতে নিতে চলে যেতো ওর স্বপ্নের দেশে..৷  ..আর  সব মিলিয়ে সে ছিলো বসু পরিবারের যাপিত জীবনের একখানা  সাদা কালোর আনন্দময় ছবি৷

..তারপর ....এলো সেই একাত্তর৷ এক ভয়াবহ সময় ছিলো আমাদের মতন আরো অসংখ্য নিষ্পাপ পরিবারের জন্যে! একই সাথে প্রাণ -মান -সম্পদ এবং বাসস্থানের এমন বিপর্যয়ের করুণতা ইতিহাসে বিরল..জন সমক্ষে তা না আসার ঘটনাও৷ আমার বাবা শহীদ হলেন। তাঁকে কবর দিতে এগিয়ে আসেন প্রতিবেশী কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ৷ আমাদের ধবলী আর রাঙি বাছুর হারিয়ে গেলো স্বাধীনতা যুদ্ধের বলী হয়ে৷

কয়েকটা দিন আমার মায়ের কেটে গেলো উদ্ভ্রান্তের মতন৷  ঠাকুমার দিকেই শুধু নয়, আমাদের কারোর দিকেই মায়ের কয়েকটা দিন কোনো নজর ছিলো না৷ দিন রাত কোথা দিয়ে কেটে যেতে লাগলো..একদিন মায়ের চোখে পড়ল আমাদের ঠাকুমা, যিনি শেমিজ পড়েন, যাঁর সাদা কাপড়ের নিচে পায়ের পাতা দেখা যায় না, তিনি আমাদের স্কুলের মাঠে ঘুরে চলেছেন, আপন মনে৷ পুত্রহীনার সাদা আঁচল জড়িয়ে যাচ্ছে সবুজ ঘাসে..আকাশের লাল রোদ তাঁর সাদা কদম ফুলের মতন মাথায় পড়েছে৷ সব মিলিয়ে ক্রন্দরত মানবীর নিশান, যিনি একা খুঁজে চলেছেন হারিয়ে যাওয়া পুত্রকে৷

আমার ছোটো দুই দাদাকে পাঠিয়ে মা তাঁকে নিয়ে আসেন৷ ছোটো মেয়েটির মতন স্নান করিয়ে খাটে বসিয়ে কয়েক গ্রাস সেদ্ধ ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন৷ বৌমা তখন আবার মায়ের স্থান নিয়ে কড়া পাহারায় ঠাকুমার যত্ন নিতে লাগলেন৷ খাট থেকে তাঁকে নামতে দিতেন না৷ পা ব্যথা করলে কাঠের গরম সেঁক দিতেন৷ নিজের চোখের জল জমা পাথরের মতন জমিয়ে রেখে মা ঠাকুমার চোখের গড়িয়ে আসা অশ্রু নিজের আঁচলে শুষে নিতেন৷ ঠাকুমার লাগানো বরবটি তুলে এনে, রিলিফে পাওয়া চালে সিদ্ধ করে দিতেন৷ অনভ্যস্থ জ্বিহবায় সেই খাদ্য আবার ফিরে আসতো পাথরের থালাটিতে৷ দু'এক ঢোক জল দিয়ে শেষ হোত প্রমোদিনী বসুর সারা দিনের খাদ্য গ্রহণএবং তাঁর পরিবারেরও ৷ এ ভাবেই সে বছরের মে....আগস্ট....এবং নভেম্বর পর্যন্ত কেটে গেলো৷ ঠাকুমা বা মা, কেউই সরাসরি বাবার কথা বলতেন না। শুধু মা ঠাকুমার হাতটা ধরে চুপ করে বসে থাকতেন৷ ঠাকুমাকে মা বলতেন-‘খুব তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হবে...! আমরা আবার সংসার করবো!’

তাঁরা রাজনীতি বুঝতেন না, শুধু নিরাপদে একটুখানি সংসার করতে চাইতেন৷

নভেম্বরের মাঝামাঝি, কার্তিকের শেষে সেবার অনেক শীত৷ ঠাকুমার জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক সবই প্রবল ভাবে স্পষ্ট শুধু শরীর শুকিয়ে গেছে শোকে-অভিমানে-দুঃখে এবং সঠিক আহারের অভাবে৷ মা বুঝতে পারছিলেন বিদায় দেবার সময় আগত প্রায়! দিন ফুরিয়ে আসছে আর একটি প্রিয় মানুষের৷ যাঁকে তিনি সম্মান -শ্রদ্ধা সেবা যত্নের ত্রুটি করেন নি কোনোদিন। তাঁকে শেষ সময়ে প্রিয় খাবার দেবার সামর্থ আজ আর নেই৷..তবু মা   একদিন প্রমোদিনী বসুর হাতখানি ধরে জানতে চাইলেন, ‘মা! আপনার কী খেতে ইচ্ছে করে..’? 

অনড় আভিজাত্যে ঠাকুমা নিজেকে মাটিতে নামিয়ে আনতে চাননি৷ বারবার বলতেন, ‘আমার যা ইচ্ছে করে, তা তুমি এখন জোগাড় করতে পারবে না’৷ তবু নাছোড়বাঁধা তাঁর বৌমার৷ অবশেষে এক গভীর রাতে..মৃত্যুর চারদিন আগে নিজের সাধ তিনি মেলে ধরেন হারিকেনের আলো আঁধারের গোপনে ৷  অশ্রুসিক্ত স্বরে তিনি ফিসফিস করে জানালেন ‘আমার একটু দুধ খেতে ইচ্ছে করে মাগো! পারবা...’!

অনেক বছর পরেও যখন মা গল্প করতেন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতেন৷ ‘আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! আমি দুধ কোথা দিয়ে জোগাড় করবো…’মা বলতেন৷ আমাদের আশেপাশে তখন দূর-দূরান্ত থেকে হিন্দু-মুসলমানরা এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাঁরা মিলেমিশে একটি পরিবারের মত৷ তাঁদেরই একজনকে গিয়ে মা অনুরোধ করেন ‘এক পোয়া দুধ যেভাবে হোক, এনে দিতেই হবে৷! পারবেন...পয়সা এখন দিতে পারবো না, যদি কোনো দিন আমার ছেলেরা বড় হয়ে আয় করতে পারে, সেই দিন আমি দেনা শোধ করে দেবো’৷

এক পোয়া দুধ জ্বাল দিয়ে মা চারবারে তিন চামচের মত দিয়েছিলেন ঠাকুমার মুখে৷ এ ঘটনার  দুই দিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়৷ ঠাকুমার আর স্বাধীনতা দেখা হয়নি! পারিবারিক মুসলিম বন্ধুরা এগিয়ে এসে বাবার কবরের পাশে আরও একটি কবর খুঁড়ে দিলেন৷ মা একটি নারকেল পাতা জ্বালিয়ে ঠাকুমার মুখাগ্নি করে শেষ বিদায় জানান৷ মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার সময় অবিরত চোখের জলে তিনি তা ভিজিয়ে দিয়েছিলেন! এর ৪৩বছর পরে মা ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর মারা যান৷ তার আগে পর্যন্ত তিনি বাবা এবং ঠাকুমার সমাধীতে সকালে জল-ফুল, সন্ধ্যায় প্রদীপ না জ্বেলে নিজে কোনোদিন জলস্পর্শ করেননি৷

বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কত লক্ষ প্রাণের করুণ কথা অগোচরে হারিয়ে গেছে৷ যা নিয়ে হতে পারত আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র-সঙ্গীত-গদ্য বা কবিতা৷ নিদেন পক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিহাস রচনার জন্যে শহীদদের পরিবারের কথা লেখা হতে পারত৷ কিছুই হয়নি৷ যা হয়েছে তার আবেদনও পথের ধূলায় মুছে গেছে৷ ঐ সব পরিবারের একান্ত নিজস্ব কিছু মানুষ তাঁদের বিশেষ দিনগুলোতে স্মৃতি আগলে বসে থাকে শুধু৷

তপতী বসু: প্রবাসী লেখক।