ঢাকা, মঙ্গলবার ২৩, ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:৪০:৪৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে দেশের কিশোর-কিশোরীদের জ্ঞান কম 

স্বাস্থ্য ডেস্ক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৪২ এএম, ৭ জানুয়ারি ২০২২ শুক্রবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানার যমুনা নদীর মধ্যে জেগে উঠেছে তানাঘাট চর। মাত্র ১০৭টি পরিবারের সদস্য বাস করে এই চরে। সেখানে ২২ বছর বয়সি ফুলমালা বাস করে। তার স্বামী শাহ আলম (৪১) ঢাকায় রিক্সা চালায়। 

ফুলমালা গ্রামের বাড়িতে একটি মুদির দোকান দেখাশোনা করে। তার স্বামীর আরো দুইজন স্ত্রী আছে। ফুলমালা তিন নম্বর স্ত্রী। ফুলমালার তিনটি সন্তান। বড় ছেলের বয়স ৭ বছর, বড় মেয়ের বয়স ৫ বছর আর ছোট মেয়ের বয়স ২ বছর। ছোট মেয়ে চরম অপুষ্টিতে ভূগছে। ফুলমালা নিজেও ভূগছে অপুষ্টিতে। রোগা লিকলিকে শরীর নিয়ে সন্তান এবং দোকান কোনটাই ঠিকমতো সামলাতে পারছে না সে। 

আট বছর আগে ফুলমালার বিয়ে হয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় সে নিজেও বুঝতে পারেনি, কিভাবে সন্তানদের লালন পালন করবে। তার মতে, গরীব মানুষ হওয়া ভালো না। ভালো-ভালো খাওয়া যায় না, লেখাপড়া করার সুযোগ পাওয়া যায় না। আরো নানা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। 

প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে কি না জানতে চাইলে ফুলমালাসহ আরো কয়েকজন নারী অপলক দৃষ্টিতে কিছুসময় তাকিয়ে থাকে। তারপর কোনো ধারনা নেই বলে জানায়। 

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং যৌন আচরণ সম্পর্কে দেশের কিশোর-কিশোরীদের জ্ঞান সীমিত। যৌন আচরণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়াটা তাদের জন্য সহজও নয়। বয়ঃসন্ধিকালীন বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীদের বিশেষ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। একজন বিবাহিতা, অন্তঃসত্বা কিশোরীর সন্তান প্রসবের আগে উন্নতমানের পরিচর্যা দরকার। আর তার প্রসবকালে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী বা সেবিকার সহায়তা প্রয়োজন। কারণ বয়স অল্প হওয়ার কারণে কিশোরী মায়েরা বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকে। আর স্বামীকেও প্রসূতির গর্ভকালীন বিভিন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে জানা জরুরী।

শিশুবিয়ের সঙ্গে অল্প বয়সে প্রথম সন্তান জন্মদানের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের প্রায় অর্ধেক ২০ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে। 

সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্যমতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা পাঁচভাগের এক ভাগের বয়স ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। দেশের মেয়েরা, বিশেষত যারা গ্রামে বাস করে কিম্বা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত তারা ছেলেদের তুলনায় দ্রুত বেড়ে ওঠে। কিশোরীদের মধ্যে অনেকে নববিবাহিত। অন্যদের কেউ কেউ বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই বিবাহিত এবং গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করেছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের বিবাহ বিচ্ছেদও হয়েছে। আবার কেউ বিধবা হয়ে শিশু সন্তানদের দেখভাল করতে হিমশিম খাচ্ছে।              

ফুলমালার মতো এ দেশের অনেক কন্যাশিশু বিয়ের শিকার হচ্ছে। বিডিএইচএস ২০১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর হওয়ার আগেই দুই-তৃতীয়াংশ কিশোরীর বিয়ে হয় এবং এক-তৃতীয়াংশ কিশোরী এক সন্তানের মা হয়। 

এছাড়াও  ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিতদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার চাহিদা বেশি থাকলেও আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার খুবই কম। বাল্যবিয়ের কারণে ৮৬ শতাংশ কিশোরী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারের ইচ্ছায় ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের যাঁতাকলেপৃষ্ঠ হয়। অশিক্ষা, অপুষ্টি, ভগ্ন স্বাস্থ্য ও নির্ভরশীলতা বয়ঃসন্ধিকালীন বিবাহের অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। দেশের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ে মানে একজন কিশোরীর সকল সম্ভাবনার সমাপ্তি। এ সব পরিসংখ্যান বাংলাদেশে কিশোরীদের সার্বিক অবস্থা তাদের নিজেদের সমাজের ও দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অনুকুল নয়। 

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের জাতীয় জরিপ মতে, বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ নারীর বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। গ্রামে এই হার ৭১ শতাংশ এবং শহরে ৫৪ শতাংশ। 

‘চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে চলতি বছর প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষার সংগে শিশুবিয়ের সম্পর্ক আছে। ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হওয়া নারীদের ৮৬ শতাংশ নিরক্ষর। 

প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, কিশোরী মায়েরা দ্বিতীয় সন্তানও আগেই নেয়। এদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার ছেড়ে দেওয়ার হারও বেশি। শিশু জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে কিশোরী মায়েদের অংশটি বাড়ছে। ১৯৯৩ সালে জন্ম নেয়া ৩২ লাখ ৭৮ হাজার শিশুর মধ্যে কিশোরী মায়েরা জন্ম দিয়েছিল ২৬ শতাংশ। ২০১২ সালে জন্ম নেয়া ৩২ লাখ ৬২ হাজার শিশুর মধ্যে কিশোরী মায়েরা জন্ম দেয় ২৯ শতাংশ শিশু। 

দেশে প্রচলিত ‘শিশুবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯’ সংশোধন করা হয় ১৯৮৪ সালে। আইন অনুযায়ী পুরুষের বিয়ের বয়স ২১ বছর, নারীর ১৮ বছর। ব্যতিক্রম হলে বিয়ের সঙ্গে জড়িত বর-কনের অভিভাবক, আত্মীয়, স্থানীয় কাজিসহ সবার শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। জড়িত পুরুষদের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা ১ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। বর ও কনে দু’জন নাবালক হলে তাদের কোন শাস্তি হবে না। বর সাবালক ও কনে নাবালিকা হলে ছেলের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা ১ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশে চলমান কার্যক্রমকে আরো বেগবান করতে হবে। তৃণমূলে ও প্রান্তিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রজনন স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং সেবার পাশাপাশি জনসচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধকল্পে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি নারীবান্ধব সমাজ গঠনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। 
তাদের মতে,  স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার পাশাপাশি প্রয়োজন বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রমের প্রচলন করা প্রয়োজন। যেসব কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। ‘আঠারোর আগে বিয়ে নয়, বিশের আগে সন্তান নয়’ এই শ্লোগানে সবাইকে একত্রিত করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা  জানান, শিশুবিবাহ একটি সামাজিক সমস্যা। আর এর জন্য অভিভাবকের অসচেতনতা দায়ী। যে সব পরিবারে শিশুবিবাহ হয় সে সকল পরিবারে দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকে। এর ফলে বহুবিয়ের হার বৃদ্ধি পায়। 

তারা মনে করেন, দেশের কিশোর কিশোরীদের বিরাট অংশ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং এর অধিকার সম্পর্কে জানে না। আবার অনেকে জানলেও সঠিকভাবে জানে না। তাই বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। কেননা মেয়েরা শিক্ষিত হলে তারা বিষয়গুলো জানতে ও বুঝতে পারবে, দেরিতে বিয়ে করবে। তারা তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুবিয়ে এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে এখনই ব্যাপক প্রচার প্রচারণার উদ্যোগ নেয়া জরুরি।