ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:১৫:৪৫ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

বাংলাদেশ : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও অপুষ্টির চিত্র

তাসলিমা তামান্না

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ১২:৪৪ এএম, ১২ জানুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ০৮:২০ পিএম, ২৯ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার

রাজধানীর তেজগাঁও বস্তিতে বসবাসরত জুয়েলের বয়স এখন পাঁচ বছর। কিন্তু বয়সের তুলনায় তার ওজন কিংবা উচ্চতা সেভাবে বাড়েনি। প্রায়ই অসুখ-বিসুখ লেগে থাকে। বস্তির ঘিঞ্জি আর স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশেই জুয়েল বেড়ে উঠছে অন্য সব শিশুদের সঙ্গে। জুয়েলের মা রুবিনা বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালান।

 

তিনি জানান, ছেলে প্রায়ই অসুস্থ থাকায় মাঝেমাঝে কাজে যেতে পারেন না। অন্যদিকে জুয়েলের বাবা বেশিরভাগ সময়ই ঘরে বসে কাটায়। কখনো বা রিকশা চালায়। তাই চাইলেও ছেলেকে ভালো খাবার দেয়ার ক্ষমতা মা রুবিনার নেই।

 

গবেষণা বলছে, শুধু জুয়েল নয়, তার বয়সী অনেক বস্তিবাসী শিশুর অবস্থাই এ রকম। নর্দার্ন ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘নিউট্রিশন স্ট্যাটাস এমোঙ্গ আন্ডার ফাইভ : চিল্ড্রেন অফ সিলেকটেড স্লাম ইন ঢাকা সিটি’ শীর্ষক জার্নাল থেকে জানা যায়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টির হার দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় ঢাকা শহরের বস্তিতে অনেক বেশি। এসব শিশুর ৪৯ শতাংশই খর্বকায়, ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ কৃশকায় এবং ৫৬ শতাংশ কম ওজনসম্পন্ন।

 

গবেষণা বলছে, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে এসব জায়গায় অপুষ্টির মাত্রা বাড়ছে। কারণ নগরে থেকেও বস্তির বাসিন্দারা দারিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব, অজ্ঞতায় ভুগছে।

 

এ জার্নাল থেকে আরো জানা যায়, ২০১৫ সালে আগারগাঁও বস্তিতে পাঁচ বছরের নিচে ১০০ জন শিশুর ওপর জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্টান্ট্যার্ড অনুযায়ী ৩৯ শতাংশ শিশু কৃশকায়, ৪৭ শতাংশ খর্বকায় এবং ৪৬ শতাংশ স্বল্প ওজনের।



তবে ওই জার্নালে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বস্তির শিশুদের পুষ্টির চিত্র অনেকটাই উন্নত হয়েছে। আর বস্তির শিশুদের ওপর করা এই গবেষণা দেশের সার্বিক পুষ্টিহীনতার চিত্র বহন করে না বলেও জার্নালে উল্লেখ করা হয়।



বিশেষজ্ঞদের মতে, বস্তির শিশুদের এমন পুষ্টিহীনতা জাতিসংঘের ’টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০’ পূরণের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ২ নম্বর যে লক্ষ্যমাত্রা আছে সেখানে বলা আছে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুসহ কিশোরী মেয়ে, গর্ভবতী, অবহেলিত নারী এবং বয়স্কদের সব ধরনের অপুষ্টি দূর করা হবে।

 

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জানান, সব ধরনের অপুষ্টি দূর করতে নগরের অবহেলিত বস্তিবাসী শিশু, কিশোরী মেয়ে কিংবা গর্ভবতী নারীদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও আরো বেশি সচেতনতা তৈরি করা দরকার।

 

শিশুদের অপুষ্টি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সাগরময় বড়ুয়া বলেন, একটি শিশুর অপুষ্টির সঙ্গে অনেক কিছুই জড়িত থাকে। গর্ভাবস্থায় মা যদি অপুষ্টিতে ভোগে তাহলে শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়। আর কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর মৃত্যু ঝুকিও স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি থাকে।

 

তিনি আরো জানান, কম ওজন নেয়া শিশুর পরবর্তীতে ডায়বেটিক, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

 

ড. সাগরময় বড়ূয়া বলেন, শিশুদের অপুষ্টির আরো অনেক কারণ আছে। ছয় মাস বুকের দুধ খাবার পর যখন শিশুকে স্বাভাবিক খাবার দেওয়া হয় তখন যদি সে চাহিদা অনুযায়ী খাবার না পায় তাহলে তার শারীরিক বৃদ্ধি অনেক কমে যায়। আবার মায়েদের অজ্ঞতাও শিশুর অপুষ্টির আরেকটি কারণ।

 

তিনি বলেন, মায়ের অজ্ঞাতা কিংবা শিশুর অপুষ্টি-এসবের সঙ্গে আর্থিক অবস্থাটাও বিবেচনার বিষয়। কারণ অপুষ্টির সঙ্গে দারিদ্রতার সম্পর্ক রয়েছে। শিশুর অপুষ্টির জন্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশকেও দায়ী করেন তিনি।

 

তার মতে, পরিবেশের কারণে শিশুদের অনেক ধরনের ইনফেকশন হয়। আর ইনফেকশন হলে শিশুর অপুষ্টির আশঙ্কা বেড়ে যায়।

 

এদিকে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ’কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের ওপর জাতীয় জরিপ ২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর ২২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। বিশ্বে যেসব দেশে কম ওজন নিয়ে শিশু জন্ম নেয়, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।

 

এ জরিপ বলছে, ১৫ বছর আগে কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ।

 

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংখ্যা কমে আসলেও এখনো লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ।

 

এ জরিপ আরো জানায়, অপুষ্টির শিকার মাকে গর্ভবস্থায় বেশি খাওয়ালেও তা শিশুর কোনো উপকারে আসছে না। তাই উচিত কিশোরীদের অপুষ্টি দূর করা।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য এবং গর্ভকালীন যত্ন নিয়ে এখনো অনেক কিশোরী, এমনকি তাদের অভিভাবকরাও সচেতন নন।

 

এ বিষয়ে রাজধানীর মেরুলে বসবাসরত গার্মেন্টকর্মী ফাতেমা জানান, ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। বছর না ঘুরতেই সে গর্ভধারণ করে। এই সময় তার শরীর প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলে চিকিৎসক জানান সে রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। চিকিৎসক তাকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু স্বামী, শ্বশুড়ি, এমন কী সেও বিষয়টাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। একসময় তার নানা রকম শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় সাত মাস হওয়ার আগেই শিশুটি পেটে মারা যায়।

 

ফাতেমা বলেন, আসলে অল্প বয়সে মা হইতে হইলে নিজের কি রকম যত্ন নিতে হয় সে কথা কেউ আমারে বুঝায়ে বলে নাই। আমিও বুঝি নাই।

 

ভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফাতেমার মতো অনেক কিশোরী এভাবে মা হতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতায় পড়ছে।

 

ইউনিসেফের ’স্টেট অফ ওয়ার্ল্ডস চিল্ড্রেন ২০১৬’ এর জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী ২০ বছর হওয়ার আগেই মা হচ্ছে।

 

গবেষণা বলছে, যদিও গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে কিশোরী মায়ের সংখ্যা এক-চতুর্থাংশ কমে এসেছে তাও এই সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

 

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কিশোরী মেয়েদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বয়সের তুলনায় ওজনহীনতায় ভুগছে। এছাড়া ৩০ শতাংশ কিশোরী মেয়ে রক্তশূন্যতায় ভোগে, যা খুবই উদ্বেগজনক।

 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মিথিলা ফারহানা বলেন, একজন মেয়ে যদি ২০ বছরের আগে গর্ভবর্তী হয়, তাহলে তার নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

 

তিনি আরো বলেন, এত অল্প বয়সে একটি মেয়ের নিজেরই শারীরিক গঠন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। তাই মাত্র ১৮ বছর বয়সে গর্ভাবস্থায় সে রক্তশূন্যতায় ভোগে। মায়ের চাহিদা আর গর্ভস্থ শিশুর চাহিদা অনুযায়ী খাবার খাওয়ায়ও সে সচেতন হয় না।

 

তিনি আরো বলেন, কম বয়সের কারণে মায়ের আলাদা যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সে বোঝে না। এতে শিশুর বৃদ্ধিও ঠিক মতো হয় না। যা শিশু ও মায়ের পরবর্তী জীবনকেও প্রভাবিত করে।

 

এদিকে দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনার (২০১৬-২০২৫) চূড়ান্ত খসড়ায় দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে। কর্মপরিকল্পনার ওই দলিলে বলা হয়েছে, অপুষ্টির প্রকোপে অঞ্চলভেদে ব্যাপক পার্থক্য আছে। উপকূলের জেলাগুলো ও হাওর অঞ্চল তুলনামূলকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা ও অপুষ্টির নিরিখে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চল বেশি সুবিধাবঞ্চিত। কম সম্পদের অধিকারী পরিবারে খর্বকায় শিশুর হার বেশি। আবার জাতীয় গড়ের চেয়ে যেসব জেলায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেশি, সেসব জেলায় খর্বকায় শিশুর হার বেশি। পরিস্থিতি আরও খারাপ চেহারা নেয় খাদ্যের মৌসুমী টানাপোড়নে, খাদ্যের দাম বাড়লে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে।

 

অন্যদিকে, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০২৫ সালের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৭ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দেশের পুষ্টিসেবার ব্যাপ্তি, মান ও পুষ্টি আচরণে উন্নতি আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।