ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪১:৩১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ভারতের মিডিয়া সম্রাজ্ঞীর সাতকাহণ

অনলাইন ডেস্ক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:০১ পিএম, ২৪ জানুয়ারি ২০২২ সোমবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

টাইমস গ্রুপ ভারতের তাবৎ মিডিয়ার ৩৫ শতাংশের মালিক। শিল্প ও ব্যবসায় অন্যতম নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানটি ভোগ্যপণ্য ও গৃহস্থালি সামগ্রীর নির্মাণ ও বিপণনের দিক থেকেও ভারতে অগ্রগণ্য। মাড়োয়াড়ি জৈন সম্প্রদায়ের আগরওয়াল গোষ্ঠীর মালিকানায় টাইমস গ্রুপ ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্বশালী জৈন-মাড়োয়াড়ি আদানি, আম্বানি, আম্বুজা প্রভৃতির মতোই একটি জায়েন্ট গ্রুপ।

বৈবাহিক সূত্রে আসা ইন্দু জৈন স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রুপের হাল ধরেন। শুধু হাল ধরেই ক্ষান্ত হননি, দুই ছেলেকে পাশে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ও বৃদ্ধিকে অব্যাহত গতি নিয়ে এগিয়ো নেন। চিন্তায়, কর্মকুশলতায়, দক্ষতায় তিনি পরিণত হন ভারতের মিডিয়া সম্রাজ্ঞীতে।

টাইমস গ্রুপের চেয়ারপারসন ইন্দু জৈন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'কিছু মিডিয়া হাউস মশলাদার খবর ছেপে তাদের বিক্রি বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমি সেই ধরনের সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করি না। কোনও কোনও সাংবাদিক আমাদের মহান মনীষীদের সম্পর্কে নানা বিতর্কিত কথা লিখছেন দেখতে পাই। তাতে হয়তো তাদের পত্রিকার বিক্রিও বাড়ে। কিন্তু টাইমস অফ ইন্ডিয়া এই ধরনের ব্যবসায় বিশ্বাস করে না। নিজেদের ফায়দার জন্য আমরা ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করতে পারি না।'


ইন্দু জৈনের জীবনদর্শন প্রকাশিত হয়েছে তার নিজের ভাষায়, 'আমি বর্তমানে বাঁচি। ভবিষ্যৎ তো সুন্দর একটা কল্পনা। তবে আমি মনে করি ভারতের যুব ও নারীশক্তি এই দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের জন্যই আমি টাইমস ফাউন্ডেশনকে অন্য ভাবে তৈরি করতে চেয়েছি। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তারা কাজ পাবে, তরুণরা নিজেদের উদ্বুদ্ধ করার পথ খুঁজে পাবে। আমার সংস্থায় সমস্ত শীর্ষ পদে আমি মেয়েদের স্থান দিয়েছি। আমি মনে করি মেয়েরাই এ দেশের ভবিষ্যৎ।'

১৩ মে দিল্লিতে প্রয়াত হয়েছেন টাইমস গ্রুপের চেয়ারম্যান ইন্দু জৈন। নারী অধিকারের চিরসংগ্রামী যোদ্ধা, আধ্যাত্মিকতা প্রচারের মুখ এবং শিল্পানুরাগী ইন্দু জৈনের বয়স হয়েছিল ৮৪। ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬ সালে উত্তর ভারতের ফয়েজাবাদে তার জন্ম হয়েছিল। তার মৃত্যুতে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বণিকসভার শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা যেমন শোক প্রকাশ করেছেন, তেমনই বন্ধু ও অনুরাগীরাও শোকবিহ্বল। অপরিসীম জীবনস্পৃহা এবং এই পৃথিবীকে আরও বেশি বাসযোগ্য করে তোলার অদম্য ইচ্ছা তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। গভীর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, 'দেশের অগ্রগতির জন্য ইন্দু জৈনের অবদান অবিস্মরণীয়।'

ইন্দু জৈনকে সামনে থেকে যারা দেখেছেন, তারা তার অমলিন গাত্রবর্ণ এবং শিশুর মতো সরল, দুষ্টুমিভরা হাসির কথাই সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছেন। গভীর আধ্যাত্মিকতায় ডুবে থাকা তার মনের দর্পণ ছিল ওই হাসি। প্রাচীন পুঁথি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও সনাতন ঐতিহ্যের প্রতি তার গভীর বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও বহিরঙ্গে তিনি ছিলেন খোলা মনের একজন মানুষ। কথায় কথায় সূক্ষ্ম রসবোধ ও উচ্চকিত হাসি তার ব্যক্তিত্বকে করে তুলেছিল আকর্ষণীয়।

১৯৯৯ সালে ইন্দু জৈন টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর নেতৃত্বের একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্টাইল তৈরি করতে পেরেছিলেন। তার নেতৃত্বে এই গ্রুপ অনেক বেশি অনুভূতিপ্রবণ ও সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার পথে এগিয়ে অন্য উচ্চতায় পৌঁছায়। জনচক্ষুর অগোচরে, একটি মহীরূহকে আজীবন নীরবে পালন করেছেন ইন্দু জৈন। টাইমস গ্রুপের চেয়ারপারসনের প্রয়াণের সঙ্গে ভারতের বৃহত্তম সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী শুধু প্রেরণাদাত্রীকেই হারাল না, প্রকৃত প্রস্তাবে ঘটে গেল একটি যুগান্ত, যার শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আগে, যখন আগরওয়াল পরিবারের এক কন্যা বধূ হয়ে এসেছিলেন জৈন পরিবারে।

ইন্দু জৈনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, উত্তরপ্রদেশের ফয়েজাবাদ জেলায়। বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন অশোক জৈনের সঙ্গে। তার শ্বশুর সাহু শান্তিপ্রসাদ জৈন মিডিয়াজগতের এক কিংবদন্তি। তার অধিনায়কত্বেই শুরু হয়েছিল দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ার জয়যাত্রা। ১৯৭৬ সালে তিনি দায়িত্ব সঁপে দেন তার পুত্র অশোক জৈনকে।

কিন্তু ১৯৯৯ সালে বজ্রাঘাতের মতো দুর্ভাগ্যের ছায়া নেমে এসেছিল জৈন পরিবারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচারের পর অকালে প্রয়াত হন অশোক জৈন। অকস্মাৎ একটি সুবিপুল ব্যবসা পরিচালনার ভার এসে পড়ে ইন্দু জৈনের উপর। কাজটা খুব সহজ ছিল না। এক দিকে নিকটতম মানুষের বিয়োগব্যথা, অন্য দিকে ব্যবসা পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব।

কঠিন পরিস্থিতিতেই মানুষের চারিত্রশক্তি প্রমাণিত হয়। আবাল্য ইন্দুর অন্তরের অবলম্বন ছিল আধ্যাত্মিকতা। তার খোঁজেই ফিরেছেন সমস্ত জীবন। সেই তাকেই প্রবেশ করতে হল এক সম্পূর্ণ নতুন জগতে। তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'কর্পোরেট জগতে প্রবেশ যেন আমার ব্যক্তিত্বের একটি অন্য দিকের বিকাশ।'

কঠোর পরিশ্রম এবং সামাজিক সচেতনতার সাহায্যে তার নেতৃত্বে শুরু হল টাইমস গ্রুপের একটি নতুন পর্ব। তার পাশে ছিলেন তার দুই পুত্র, সমীর ও বিনীত। ইন্দু বিশ্বাস করতেন যে সংবাদমাধ্যমের একটি বিরাট সামাজিক দায়িত্ব আছে। কাজেই খবর স্রেফ খবর হিসেবেই পরিবেশিত হওয়া উচিত, কোনও ইন্ধন সরবরাহের জন্য নয়। তা হলেই সমাজে সদর্থক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে সংবাদমাধ্যম। এই মন্ত্রকে উপজীব্য করে তিনি আগামীর ভিত্তি গড়েছিলেন। তার দরুণই এসেছে বিপুল সাফল্য, ব্যবসায়িক এবং জনপ্রিয়তা, উভয় নিরিখেই।

তাকে শক্তি জুগিয়েছিল তার আধ্যাত্মিক চেতনা। একদা তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, তার উদ্দেশ্য সংবাদপত্রটিকে আরও দয়াশীল, আরও বিনম্র, আরও আনন্দপূর্ণ করে তোলা। প্রাত্যহিকতায় জর্জরিত সাংবাদিকদের কাছে হয়তো তা হেঁয়ালির মতো মনে হয়েছিল প্রথমে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল ভালো থাকা ও ভালো রাখার ইচ্ছাটুকু, যা দৈনন্দিন খারাপের থেকে ঊর্ধ্বে ওঠার শিক্ষা দেয়। পাঠকরাও পছন্দ করেছিলেন মানুষের ভালোটুকু ছেনে বের করে আনার এই প্রয়াস।

ইন্দু জৈনের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পরিবেশ, শান্তি, শিক্ষা এবং সহ-ভাগী, অর্থাৎ সরকার ও প্রশাসন পরিচালনায় কী ভাবে মানবসম্পদকে কাজে লাগানো যায়। মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে তারই নেতৃত্বে স্থাপিত হয় টাইমস ফাউন্ডেশন। এ ছাড়াও একাধিক সংস্থার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতীয় জ্ঞানপীঠ ট্রাস্ট, সাহু জৈন চ্যারিটেবল সোসাইটি, রাম চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং সাহু জৈন ট্রাস্ট। ইন্দু বলতেন, এ সবেরই একটিই উদ্দেশ্য- মানুষ শুধু গ্রহণই নয়, যেন অভাবী মানুষকে দানের আনন্দও উপভোগ করতে পারে। যাদের সমাজকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তাদের একত্রিত করা তার জীবনের একটি বড় সাফল্য।

শৈশব থেকেই তিনি জৈন ভগবান মহাবীরের ভক্ত, পরবর্তী সময়ে গুরুপদে বরণ করেন শ্রীশ্রী রবিশঙ্করকে। নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি এক গুরুর থেকে অন্য গুরুর কাছে গিয়েছেন এবং প্রতিটি যাত্রাই তাকে আরও এক ধাপ রূপান্তরের দিকে নিয়ে গেছে। তিনি মনে করতেন যে, আধুনিক ম্যানেজমেন্ট ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। জগৎ জয় করার আগে নিজেকে জয় করতে হয় আর সেই শিক্ষাটিই আসে আধ্যাত্মিকতার পথে। ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা উজ্জ্বলতর হতে পারে স্ব-চেতনার উপস্থিতিতে।

ইন্দু জৈন একাধারে বৃহৎ মিডিয়া-সংস্থার পরিচালিকা, মানবতাবাদী এবং আধ্যাত্মিক পথের পথিক ছিলেন। সর্বোপরি তিনি একজন অসমসাহসী মহিলা, যিনি নিজের শর্তে নিজের মতো করে জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলতেন যে, পুরুষ এ কথা ভুলে গেছে যে, তার সমস্ত পরাক্রমের উৎসে আছে নারীরূপিণী শক্তি। তিনি ছিলেন প্রকৃতই নারীশক্তির প্রতীক।