ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ২১:০৩:০১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

রওশন আরা বাচ্চু: ভাষা আন্দোলনের অগ্রপথিক 

নোরা নূর

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৩৫ এএম, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বুধবার

ফাইল ছবি।

ফাইল ছবি।

রওশন আরা বাচ্চু ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগ্রামী। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে যে সমস্ত ছাত্র নেতারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। নিজের জীবন বাজি রেখে মায়ের ভাষা রক্ষার লড়াইনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

রওশন আরা ১৭ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার উছলাপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এ এম আরেফ আলী এবং মায়ের নাম মনিরুন্নেসা খাতুন।

রওশন আরা বাচ্চু ১৯৪৭ সালে পিরোজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে দর্শনে অনার্স করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে বি এড এবং ১৯৭৪ সালে ইতিহাসে এম এ করেন। 

তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইম্যান স্টুডেন্টস রেসিডেন্স এর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্ট এর সাথে ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।

রওশন আরা বাচ্চু বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন যেমনঃ ঢাকার আনন্দময়ী স্কুল, লিটন অ্যাঞ্জেলস, আজিমপুর গার্লস স্কুল (খন্ডকালীন), নজরুল একাডেমি, কাকলি হাই স্কুল এবং পরে আলেমা একাডেমিতে। সবশেষে ২০০০ সালে বিএড কলেজে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা: ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় রওশন আরা বাচ্চু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে সকল ছাত্র নেতারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি জনমত সমর্থনের জন্যও ব্যাপক চেষ্টা করেন। তিনিই ইডেন মহিলা কলেজ এবং বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করে আমতলার সমাবেশ স্থলে নিয়ে আসেন। এখান থেকেই ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তারা ব্যারিকেড টপকিয়ে মিছিল নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে ব্যরিকেড টপকানো বেশ কঠিন ছিলো। রওশন আরা বাচ্চু তার দলের সবাইকে নিয়ে পুলিশের তৈরি ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলেন। এরপর পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে দেয়। এতে নিহত ও আহত হন অনেকে। 
এ সময় রওশন আরা বাচচুও আহত হন।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিনয় করে বলেছিলেন, আমি বায়ান্ন সালে একটা ছোট্ট ভূমিকা নিয়েছিলাম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন অনেক আগে থেকেই শুরু করেছিলাম। আমি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনও করেছি, এরপর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করেছি। 

তিনি বলেছেন, আমরা আন্দোলন করেছি। ২১শে ফ্রেব্রুয়ারি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আসতাম। তখন গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০-৭০ জন মেয়ে ছিল। আমরা প্রাইমারি স্কুল, ইডেন কলেজ, মুসলিম গার্লস স্কুল, কামরুন্নেসা, বাংলাবাজার স্কুল থেকে হেঁটে হেঁটে গিয়ে মেয়ে সংগ্রহ করে আনতাম। আমরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে হয়ে দুরে দূরে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আসতাম।

রওশন আরা বাচচু আরও বলেছিলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ক্যাম্পাসে এসে দেখি সমস্ত মাঠ ছাত্র-ছাত্রী দিয়ে ভরে গেছে। সেদিন শুধু ঢাকার ছাত্র-ছাত্রী না, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছিল। সেদিন রাজনীতিবিদরা বলেছিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙা ঠিক হবে না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বলছে যে করেই হোক ১৪৪ ধারা ভাঙব। তখন সবাই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তারপর ৪-৫জন করে গ্রুপে প্রুপে ভাগ হয়ে নিজেরা নিজেরা তর্ক করছে। কেউ বলছে ভাঙা উচিত, কেউ বলছে ভাঙা উচিত না। তখন আমরা ১২টার দিকে আমাদের মিটিং শুরু করলাম। মিটিং শুরুর সময় আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন নিচে চলে এলেন আমরা যেখানে বসেছিলাম। সঙ্গে ড. জুবেরি, ড. সাদানি, প্রক্টর মোজাফফর রহমান তার সঙ্গে ছিলেন। এসেই ছাত্রদের কাছে অনুরোধ করে বললেন, বিপদ হতে পারে, আজকে তোমরা আন্দোলন করো না। গুলি চলবে স্যাররা জেনে গেছে, এই জন্য বাধা দিচ্ছে। কার বাধাকে শোনে। ছাত্ররা বিনয়ের সঙ্গে স্যারকে বললো : স্যার, এটা আমাদের জাতীয় প্রশ্ন। আমাদের আন্দোলন করতেই হবে। 

তিনি বলেছিলেন, আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন, আমাদের টিকে থাকার প্রশ্ন, আমাদের ভাষার প্রশ্ন। স্যার আপনি আমাদের মানা করবেন না, আপনার এই অনুরোধ আমরা রাখতে পারব না। এসব কথা শুনে স্যার চলে গেলেন। স্যার চলে যাওয়ার পর আমাদের পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী সভা শুরু হয়ে গেল। গাজীউল হক তার আসন অলংকৃত করলেন। এম আর আখতার মুকুল প্রস্তাব করল, আর আমরা তা সমর্থন করলাম। এই সময় জনাব শামসুল হক আসলেন। তিনি এসেই বললেন আমাদের প্রশাসনিকভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া উচিত। আস্তে আস্তে আমরা ভাষার দাবি আদায় করে নেব। কিন্তু এর মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা তুমুল বিক্ষোভ শুরু করলো। শামসুল হক মাথায় জিন্নাহ টুপি আর শেরোয়ানি গায়ে দিয়ে এসেছিলেন। তখন হাসান হাফিজুর রহমান তার জিন্নাহ টুপি আর শেরোয়ানি দেখে ক্ষেপে গিয়ে গলা চেপে ধরলেন, মাথার টুপিটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন:‘ ইউ হ্যাভ নো রাইট টু টক।’ তখন মারামারি, হাতাহাতি হবার উপক্রম হল। সবাই উত্তেজিত। শহীদ খান নামের এক ছেলে একটা বেঞ্চ টেনে নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে লাগল ১৪৪ ধারা কেন আমাদের ভাঙা উচিত। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কথা বলতে হবে এজন্য এম আর আখতার মুকুল শহীদ খানকে দুটো পা ধরে নামিয়ে দিলেন। তখন ভাষা মতিনকে গাজীউল আহবান করলেন কিছু বলার জন্য। ভাষা মতিন এগিয়ে এসে বললেন, আপনারা কী চান? ১৪৪ ধারা ভাঙবেন নাকি ভাঙবেন না? বলার সঙ্গে সঙ্গে দুহাত তুলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা বলল ১৪৪ ধারা ভাঙবোই ভাঙবো। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ১৪৪ ধারা ভাঙতে। 

রওশন আরা বাচচু বলেছিলেন, কিন্তু এখন আমরা কীভাবে বের হবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পুলিশ বন্দুক ধরে আছে। আর সারি সারি পুলিশ লাঠির ব্যারিকেড ধরে আছে। সেখানে তিনটি ট্রাক আর একটা জিপ রাখা আছে। সেই অবস্থায় আব্দুস সামাদ আজাদ সিদ্ধান্ত নিলেন ১০জন করে বের হবো এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সামনে থাকবে। ধারণা করা হয়েছিল, সামনে মেয়ে দেখলে গুলি করবে না আর গ্রেপ্তার করবে না। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য প্রত্যেক সারির সামনে আমরা থাকলাম। আমরা বুঝতে পেরেছি পুলিশ যেহেতু বন্দুক তাক করে আছে, গুলি ছুড়বে, আমরা কতজন হারিয়ে যাবো, এজন্য মোহাম্মদ সুলতান খাতা নিয়ে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সবার নাম-ঠিকানা লিখতে শুরু করলেন। প্রথম দল ড. সাফিয়া খাতুনের নেতৃত্বে চলে গেল। দ্বিতীয় দলও পুলিশের ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে চলে গেল। হাবিবুর রহমান শেলী ছিলেন মেধাবী ছাত্র। তার নেতৃত্বে মিছিল বের হয়ে গেল। হাবিবুর রহমান শেলীকে বলা হয়েছিল, তুমি প্রথমে অ্যারেস্ট হয়ে যাবে। আরেস্ট হবে এই কারণে যে, তুমি ভালো ছাত্র। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া লোক। তুমি অ্যারেস্ট হলে কিছু হবে না, ভবিষ্যতে টিউশনি করেও খেতে পারবে। কিন্তু অন্যরা টিউশনি না-ও পেতে পারে। বিদ্যার দৌড় না থাকলে তো হবে না। সেভাবেই তিনি প্রথমে অ্যারেস্ট হয়ে গেলেন। যে ছাত্র বের হচ্ছে তাকে ধরে ধরে সেই তিন ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে। দূরে দূরে নিয়ে কাউকে আবার ছেড়ে দিচ্ছে। প্রথম দু’দল বের হওয়ার পর আমি তৃতীয় দলে বের হবো। পুলিশও বন্দুক তাক করে আছে, দুই পুলিশের মাঝে আড়াই হাত লাঠি দিয়ে ব্যারিকেডও দিয়ে রেখেছে। 

রওশন আরা বাচচু বলেছিলেন, এ সময় আমি চিন্তা করলাম পুলিশের লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া ভাঙতে না পারলে ১৪৪ ধারাতো ভাঙ্গা হলো না। তখন আমি গিয়ে সামনে যে লাঠিটা ছিল সেটা ধরে জোরে জোরে নাড়া দিচ্ছি। আমার প্রত্যয় হলো এভাবে নাড়া দিতে থাকলে কৌশলে যত নাড়া দেব একসময় আর জোর পাবে না, এই ফাঁকে লাঠি সরিয়ে আমি বের হয়ে যাব। এভাবে যখন করছি, আমার দেখাদেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ওয়েস্টার্ন স্কুলের ছাত্রসহ জুলমত আলী বারী এরাও লাঠি ধাক্কা দিতে থাকে। যখন আমার হাতের লাঠিটা শিথিল হয়েছে, তখন সেই লাঠিটা আমার পিঠে পড়েছে। আমি দৌড়াচ্ছি। আমাদের মুখে স্লোগান- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, চলো চলো এসেম্বলিতে চলো। এর মধ্যে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করছে, চোখ জ্বালা করছে, কালো ধোঁয়া, পুলিশ-ছাত্রদের মধ্যে ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। মেডিকেলের মোড়ে যখন গেলাম তখন এসেম্বলির দিকে এগোনো যাচ্ছে না। মেডিকেলের মোড়ে তখন গুলি শুরু হযে গেছে। তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমার পেছনে কেউ নেই। যারা ছিল তাদের ধরে ধরে ট্রাকে করে নিয়ে গেছে। মেডিকেলের মোড়ে তখন দুইটা বইয়ের দোকান আর একটা রেঁস্তোরা ছিল। সেখানে কিছু ভাঙা রিকশা ছিল আমি সেখানে লুকালাম। কিছুক্ষণ থাকার পর মনে হলো এখানে আমি নিরাপদ নই। রিকশারগুলোর পাশেই ড. গনির বাড়ি, মাঝখানে তারকাঁটার বেড়া। তখন আমি ড. গনির বাড়ির তারকাঁটা বেড়া ডিঙাতে লাফ দিলাম। লাফ দিলে আমার শাড়ি তারকাঁটার বেড়ায় আটকে গেল। সেখানে আমার মতো একজন লুকিয়ে ছিল সে শাড়িটা ছাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজও জানি না, কে সেই লোক যে আমার শাড়ি ছাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি আজও সাক্ষী হয়ে বেঁচে রইলাম। কিন্তু আমার অনেক সঙ্গী-সাথী সেদিন জান দিয়ে দিল। বরকত-সালাম-জব্বার-রফিক-শফিউর চলে গেল। তখনই শুনেছি রফিকের মাথার খুলি উড়ে গেছে, বরকতের উরুতে গুলি লেগেছে।

এই মহার নেত্রী ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।