ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:০১:৩৭ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

অগ্নিকন্যা বীণা দাস

ফিচার ডেস্ক

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ১১:১৩ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৮:১০ পিএম, ২৯ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার

১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর। হরিদ্বারে গঙ্গার ঘাটে এক অজ্ঞাতপরিচয় বয়স্কা মহিলার দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। পরে অজ্ঞাতনামা নারীর পরিচয় জানা গিয়েছিল। সেই নারী ছিলেন ইংরেজদের ত্রাস অগ্নিকন্যা বীণা দাস।

 

বীণা দাস ১৯১১ সালে ২৪ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম। তার পিতা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজী পন্ডিত ও দেশপ্রেমিক বেণী মাধব দাস ও মাতার নাম সরলা দাস। তার দিদি ছিলেন বিপ্লবী কল্যাণী দাস। পিতার আদর্শে প্রভাবিত হয়ে রাজনীতিতে যোগ দেন।তিনি যে তার দেশপ্রেম, আদর্শবাদ, দৃঢ় সংকল্প, উদার চিন্তাভাবনা তার পরিবার থেকেই লাভ করেছিলেন-তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন শান্ত প্রকৃতির। কবি ও দার্শনিক মনের অধিকারী বীণা দাস সময়ের উত্তাল হাওয়ায় পরিণত হন অগ্নিকন্যায়।

 

তার পিতা বেণী মাধব দাসের কথা তার ছাত্র নেতাজী সুভাষ বোস তার ‘ভারত পথিক’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন-বেণী মাধব দাসকে, যিনি কিশোর সুভাষের মনে একটি স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পেরেছিলেন। এমনকী, স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে ভারত ত্যাগ করার পূর্বে নেতাজী সুভাষ বোস, বেণী মাধবের আশীর্বাদ নিতে তার সঙ্গে দেখা করেন। বেণীমাধব তাকে আশীর্বাদ করেন হৃদয়-উৎসারিত শুভকামনায়। বীণা দাসের স্বামী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ যতীশ ভৌমিক।

 

বীণা দাসের চার বছরের বড় বোন কল্যাণী দাস ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতা ছাত্রী সংঘের একজন নিষ্ঠাবান সংগঠক। বিপ্লবীদের বিভিন্ন গোপন সভায় তিনি যোগ দিতেন। উচ্চশিক্ষিত কল্যাণী দাস অনার্স গ্রাজুয়েট হওয়া স্বত্ত্বেও তাকে কারাগারে তৃতীয় শ্রেণির বন্দী করে অবর্ণনীয় কষ্ট দেওয়া হয়। দিদির এই আত্মত্যাগ বেথুন ও ডায়সেশন কলেজে শিক্ষাগ্রহণ করা বীণা দাসকে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় শাণিত করে অনুপ্রাণিত করে উপনিবেশিক শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

 

বেথুন ও ডায়সেশন কলেজ থেকে বীণা স্নাতক হন ১৯৩১ সালে। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে যখন বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছিল বীণা তখন বেথুন কলেজের ছাত্রী। তিনি অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে কমিশন বয়কট ও বেথুন কলেজে পিকেটিং করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন। ওই বছরই কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন এবং ধীরে ধীরে তিনি গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন-শোষণের উপর ক্রমশ জমে ওঠা প্রচন্ড ক্ষোভ ও বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্নিচ্ছটার সংস্পর্শে গান্ধীজির অহিংস মতবাদের থেকে সরে এসে শেষ পর্যন্ত বৈপ্লবিক পন্থাকেই বেছে নেন তিনি।

 

১৯৩২ সালে বীণা দাস তার জীবনের সবচাইতে দু:সাহসিক কাজ করার জন্য মনস্থির করে ফেলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাংলার ব্রিটিশ গভর্ণর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করে হত্যা করার। স্ট্যানলি জ্যাকসন ছিলেন একসময়ের ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, যিনি ২০টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন এবং ৫টিতে অধিনায়কত্ব করেন। পরবর্তীতে কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে নির্বাচন করে ১৯১৫ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। জ্যাকসনকে হত্যার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনের কারণ বীণা দাস তার জবানবন্দীতে এভাবে ব্যাখ্যা করেন-

 

‘I have no sort of personal feelings against Sir Stanley Jackson, the man and Lady Jackson, the woman. But the governor of Bengal represents the system of repression which has kept enslaved 300 millions of my countrymen and countrywomen.’

 

এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বীণা দাস সাহায্য নেন তার বোন কল্যাণীর বান্ধবী কমলা দাস গুপ্তের। কমলা দাসগুপ্ত ‘যুগান্তর’ দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। বীণা দাস যুগান্তরের সদস্য না হলেও তার সংকল্প এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে কমলা দাস গুপ্ত তাকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। ২৮০ টাকা দামের একটি চোরাই রিভলবার সহযোদ্ধা সুধীর দত্তের কাছ থেকে জোগাড় করেন বীণা দাসের প্রিয় কমলা’দি।কমলা’দি শাড়ির ভেতর রিভলবারটি লুকিয়ে উত্তর কলকাতার ‘রামমোহন রায়’ গ্রন্থাগারে নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি বীণাকে রিভলবার চালানোর কৌশল শেখান।কিন্তু স্থানাভাবে বীণা তখন আর টার্গেট প্র্যাকটিস করার সুযোগ পান নি। ইতিমধ্যে বীণা অবশ্য দিনেশ মজুমদারের কাছে শারীরিকশিক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

 

১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েল সমাবর্তন অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি বাংলার গভর্ণর স্ট্যানলি জ্যাকসন। সমাবর্তন অনুষ্ঠান চলে। গভর্নর যখন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য শুরু করছেন তখন গাউনপরা বিশ-একুশ বছরের এক মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়। গুলি চালায় জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে। আত্মরক্ষার্থে স্টানলি জ্যাকসন মাটিতে পড়ে যান। অল্পের জন্য লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়। গভর্ণর ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তৎক্ষণাৎ দৌড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। সেসময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীর পিতা কর্ণেল হাসান সোহরাওয়ার্দ্দী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি দ্রুত বীণা দাসের হাত থেকে রিভলবারটি কেড়ে নেন। ততক্ষণে বীণার রিভলবার থেকে ৫টি গুলি বেরিয়ে গেছে।

 

বীণা দাস গভর্নরকে গুলি করার পর আদালতে নির্ভীকচিত্তে জবানবন্দী দেন, ‘আমিই গভর্নরকে গুলি করেছি….আমার উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যুবরণ করা, এবং যদি আমাকে মরতে হত, আমি চেয়েছিলাম মহান মৃত্যু.. এই ভারতবর্ষে এই পরিমাণ অন্যায়, অত্যাচার এবং বিদেশি শোষণের মধ্যে গুমরে কাঁদার চাইতে সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে প্রতিবাদ করে জীবন বিসর্জন দেওয়া কী অধিকতর ভাল নয়?’

 

এসময় আদালতে বীণা দাসের শিক্ষিকা সিস্টার ডারোথি কাঁদতে কাঁদতে বীণাকে বলেন, ’Bina, I love you so much. How could you do this?’ বিপ্লবী বীণা দাসের তৎক্ষণাৎ প্রতিউত্তর ’Sister, I love you no less. But, I love my country more.’

 

১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা বিচারে বীণা দাসের ৯ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। কারাভোগের সময়টুকুতে তাঁকে একেক সময় একেক কারাগারে, একেক স্থানে নিয়ে যাওয়া হত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলে স্থানান্তরিত হয়ে থাকার পর গান্ধীজির প্রচেষ্টায় অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীর সঙ্গে বীণাও মুক্তি পান। সাত বছর জেলে কাটিয়ে ১৯৩৯-এ তিনি মুক্তি লাভ করেন।

 

জেল থেকে মুক্তির পর বীণা থেমে থাকেননি। সেসময় বিপ্লবীদের অনেকে, বিশেষত তরুণেরা, গোপন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নেন। সেসময়েই আরো অনেকের মত বীণা দাসও কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ট্রেড ইউনিয়নের কাজ আরম্ভ করেন। তিনি দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদিকাও ছিলেন। টালিগঞ্জের চালকল বস্তিতে গিয়ে বস্তিবাসী দরিদ্র শ্রমিকদের সঙ্গে দিনের পর দিন মিশে তাদের চরম দুর্গতিতে পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এর পাশাপাশি সেসময় বীণা দাসের সাহিত্যপ্রতিভা ও দেশাত্মবোধক চিন্তার প্রকাশ পাওয়া যায় কমলা দাসগুপ্ত সম্পাদিত ‘মন্দিরা’ পত্রিকায়।

 

১৯৪২-এ ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু হলে বীণা দাস দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সভা ডাকলেন হাজরা পার্কে। সভাকে বেআইনি ঘোষণা করা হল। সেখানে একজন সহকর্মীকে সার্জেন্ট ব্যাটন দিয়ে প্রহার শুরু করতেই বীণা তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। পুলিশ আবারো বীণাকে গ্রেফতার করে। এবারে তিনি রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে তিন বছর আটক থাকেন। এ দফায় ১৯৪৫-এ তিনি মুক্তি লাভ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচন করে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার প্রভাব বীণা দাসকে ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। বীণা দাসের স্বামী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ যতীশ ভৌমিক। স্বামীর মৃত্যুর পর বীণা দেবী আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যান রাজনীতি থেকে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান।

 

কখন যে তিনি হরিদ্বার চলে গিয়েছিলেন তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেন না। ১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর। হরিদ্বারে গঙ্গার ঘাটে এক অজ্ঞাতপরিচয় বয়স্কা মহিলার দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। সংবাদপত্রেও খবরটি উঠেছিল। পরে অজ্ঞাতনামা নারীর পরিচয় জানা গিয়েছিল। সেই নারী ছিলেন বীণা দাস। ইংরেজদের ত্রাস অগ্নিকন্যার প্রস্থাণ হল অজ্ঞাতে-নিভৃতে।

 

ক’জনই বা মনে রেখেছেন অগ্নিযুগের এই অগ্নিকন্যার কথা? ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্নিগর্ভ হতে উঠে আসা বিপ্লবীদের এই প্রগাঢ় দেশপ্রেমকে অনুপ্রেরণার উৎসমূল হিসেবে প্রোথিত করতে পারিনি আমাদের হৃদয়ে, মস্তিষ্কে, চিন্তন-মননে তাই দেশমাতার গ্লানিমুক্তি ঘটেনি পরাধীনতারতার শৃংখল মোচনের পরেও…!