ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ৩:১১:০৯ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

একদিন মেঘ দিন! আহেমদ মুসফিকা নাজনীন

আহেমদ মুসফিকা নাজনীন

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:১১ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২২ বুধবার

আহেমদ মুসফিকা নাজনীন ও তার স্বামী।

আহেমদ মুসফিকা নাজনীন ও তার স্বামী।

আম্মার ফোন, বান্দর দেখেছো? বান্দরবানে তো গেছো? হকচকিয়ে গেলাম। মানে? একটু পর হাসলাম। আরে চারপাশে তো কত! অপিকে বলতেই বললো, আয়নায় দেখো আরেকটা পাবে। ভয়ে আর আয়না দেখলাম না। সকালবেলা আয়নায় শ্যামলা রাজকন্যা দেখেছি তাই থাক না মনে। এখন দেখার কি দরকার। 
এমন কাঠফাঁটা রোদ্দুর আগে দেখিনি, এবার দেখলাম। জীপে করে ঘুরি নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ের সাথে। দুপাশে ঘন খাদ। সেখানে কুয়াশার মতো মেঘ। রুদমিলা বলে ওর পাশের পাহাড় বেশি সুন্দর আমি বলি আমার। পাহাড় চুপ করে থাকে। 
পথে পথে ভাঁটফুল, গাঢ় লাল বাগানবিলাস আর জবা। পাহাড়ি জবা যে এতো লাল হয় জানা ছিলনা। সেই বাগানবিলাসের সাথে একটা ছবি তোলার সখ হয়েছিলো। তুলতে পারিনি। সব ইচ্ছে মনে হয় মানুষের পূরণ হয়না। অতৃপ্তিটাই হয়তো মনে থাকে বেশি। 
ইচ্ছে ছিলো পাহাড়ের গায়ে থাকা সাদা, হলুদ বুনো ফুলগুলোর চারা নিয়ে আসবো পিকু, বড় আপু আর শিলুপার জন্য। আনা হয়না।
গাড়ী ছুটে চলে নীলগীরি, মেঘলা কিংবা শৈলপ্রপাতের দিকে। গরমে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ছবি তুলি মেঘের সাথে। রোদে গরমে ভুরু কুচকানো। ছাতা মাথায় অপি। ডাকলেও শোনেনা। শুনলেই যে রোদের মধ্যে তুলতে হবে ছবি। তার চেয়ে না শোনা উত্তম। ভাগ্যিস সাথে সাথী ভাবি ছিলেন। তাই কখানা ছবি জুটেছে কপালে। গুণতে গুণতে দেখি মাত্র ৫৯০টা ছবি তুলেছি সবাই। 
থানচি। নিউজ লিখতে লিখতে জায়গাটা চিনি। প্রায়ই পাহাড় ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। সেনাবাহিনী সেই রাস্তা ঠিক করে। ভয়ে ভয়ে এগোই। এই বুঝি পাহাড় ধসে গেলো। পাহাড়ে যাওয়ার আগেরদিন বান্দরবানে খুন হয় একজন। অপহরণ করা হয় ৩ জনকে। কিছুটা ভয় আর শংকা সবই ছিলো। সাথে ছিলো ভয়ংকর সুন্দর পাহাড় দেখার লোভ। জানি সত্য ও সুন্দরে কোনো দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ হয়না। 
মার্মা শব্দ থাইন চৈ বা বিশ্রামের স্থান থেকে থানচি শব্দের উৎপত্তি। ১৯৫০ সালে বা তার আগে যাত্রীরা বিশ্রামের জন্য থানচিতে থামতেন । তখন থাইন চৈ নামে স্থানটি পরিচিত ছিলো। আস্তে আস্তে তা থানচিতে এসে থামে। 
থানচিতে অনেক জলপ্রপাত। সব দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া! আমরা দেখেছি শুধু বড় পাথর বা রাজা পাথর। দুপুর বেলা থেকে বসে আছি নৌকায় চড়বো। বিকেল বেলা  নৌকার জন্য তেল পেলাম। 
ছোট্ট ডিঙি নৌকা। মাঝিসহ আমরা ৭জন । নৌকার মাঝে বসে অপি সেই যে চুপ। আমার আর নদী দেখা হয়না। ফিসফিস করে বলি তুমি নেমে যাও। আমাদের সাথে যেওনা। কাঠ মুখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। নদীকে ওর ভয়। আর নদীর সাথে আমার সখ্যতা। সাংগু নদীর কত গল্প শুনেছি। দেখতে চেয়েছিলাম ওর তারুণ্য। শীর্ণকায় নদী দেখে মন কাঁদে। কাঁদে পাহাড়ী মেয়েরাও। ওইটুক নদীর মধ্যে ওরা মাছ ধরে, গোসল করে। নদীকে ঘিরে এক জলজ জীবন। মাঝে মাঝে পাথরে বাড়ি খেয়ে নৌকা এগোয়। মনে হয় ঝাঁপ দেই। চাইলেই সব হয়না। 
অপির কলিগ তুহিন ভাই তার মেয়ে রুদমিলার সাথে পানি নিয়ে খেলা করেন। রুদমিলার হাসির সাথে ঝর্না যেন বয়ে যায়। মুগ্ধ হয়ে দেখি কিশোরী কন্যাকে। 
ছবি তুলি রানী পাথর আর রাজা পাথরের সাথে। বিশাল বিশাল পাথর, ওখানকার মানুষের কাছে দেবতা। 
ফিরে আসি। আকাশ ভরা সোনালী চাঁদ। চকচক করে সাংগু নদীর পানি। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। ভেসে চলছে নৌকা। হঠাৎ কিশোর মাঝি বলে, নৌকার তেল শেষ। আর যাবেনা। হাত দিয়ে বাইতে হবে। বলে কি । ধীরে ধীরে পানি ওঠতে থাকে নৌকায়। পাড়ে ভিড়াতে বলি মাঝিকে। ও মাঝ নদীতে নৌকা ঠেলে। চাঁদের আলোয় নৌকা চলে। তুহিন ভাই, অপি চুপ। 
পাশ দিয়ে চলে যাওয়া নৌকাকে ডাকি, একটু তেল নিবো বলে। ওরা শোনে না। চারপাশে কত তেল দেয়া দেখি। মাঝনদীতে বিপদের সময় আর তেল পাইনা। এমনই বুঝি হয় জীবনের ক্ষেত্রেও। তেল দেয়ার সময় আছে কিন্তু বিপদে সেই তেলবাজদের আর পাওয়া যায়না। 
সময় ভারী হয়। আমরা এগোতে থাকি, দুলতে থাকি। মাঝে মাঝে ভয়ে সিটিয়ে যাই। অন্ধকারে পাহাড় গুলো কালো হয়। একসময় আলো দেখি দূরের ঘাটের। পাড়ের কাছাকাছি আসতেই কথা ফোটে তুহিন ভাই আর অপির মুখে। 
এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন কেন? এতো বিপদেও নৌকায় আপনাদের কোনো সাড়াশব্দ ছিলনা! তুহিন ভাইয়ের উত্তর ’ভাবছিলাম কি করা যায়?’ 
কথা বাড়ালাম না। থাক বাবা একেকজনের বিপদ পাড়ি দেয়ার ভাবনা একেক রকম। কেউ চুপ থাকে ভয়ে, কেউ বা সমাধানে চেষ্টা করে।
অপি তো স্বীকারই করলো না যে ও ভয় পেয়েছে। তাতে আমিও খুশি। ভয় হোক জয়। চাঁদ হাঁটে আমাদের সাথে। 
রাতে বিজিবির সীমান্ত অবকাশের রিসোর্টে যাই আমরা। ছোট্ট বাড়ি। পুরোটাই কাঠ দেয়া। আহা! মানুষ আমি আমার কেন পাখির মতো মন। 
সামনে আসে এক শালিক। কক্কে পাখির ডাক শুনলাম প্রায় ২৫ বছর পর। 
রুদমিলাকে বললাম চুপ করে শব্দ শোনো। অনুভব করো কত শব্দ প্রকৃতিতে। দুই মিনিটে সাথী ভাবি পেলেন ৮টা। শব্দের এ খেলাটা শিখেছিলাম ভার্সিটিতে কাজল ভাইয়ের কাছে। ওনার একটা খাতা ছিলো তাতে কয়েক হাজার প্রকৃতির শব্দ উনি লিখে রেখেছিলেন। খাতাটা আমার দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। 
পাহাড় ছেড়ে আমরা শহরে আসি। যোগদেয় রিপোর্টার টিটো ভাই। যাই মেঘলা ও নীলাচল। ঠান্ডা বাতাসে মন ঠান্ডা হয়। কাঠফাটা রোদ আর কষ্ট দেয় না। ৩দিন পর ভালোবেসে ফেলি পাহাড় আর মেঘের শহরটাকে। একরাশ নীল মেঘ সাথে করে দূষণের শহরে ফিরি। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি তুমি কি সেই মেঘবালিকা, তুমি কি সেই?