ন্যায় বিচারের কান্ডারী আমাল ক্লুনি
সালেহীন বাবু
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ১২:৫২ পিএম, ১ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০১:১২ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার
মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হওয়া রয়টার্সের দুই সাংবাদিক কো ওয়া লোন এবং কিয়াও সোয়ে’র পক্ষে এবার আইনী লড়াই লড়বেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবি আমাল ক্লুনি।বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে ক্লুনির কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে এ খবর জানানো হয়। অবৈধভাবে সরকারি গোপন তথ্য সংগ্রহের মিথ্যে অভিযোগে গত বছর ১২ ডিসেম্বর রয়টার্সের এই দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার করে দেশটির সরকার।
মিয়ানমার এক অন্য রকমের রাষ্ট্র। যেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে লক্ষ্য লক্ষ্য রোহিঙ্গা। নির্বিশেষে হত্যা করা হয়েছে সে দেশেরই নাগরিকদের। লুটপাট, নিপীরন, দমন চলছে দিনের পর দিন। রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ বিষয় নিয়ে পুরো বিশ্বে চলছে অব্যাহত নিন্দার ঝড়।
এমনকি সেখানে অবস্থিত সাংবাদিকরাও স্বাধীনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। উল্টো সত্য ঘটনা উদঘাটন করতে যেয়ে মিয়ানমারের প্রচলিত আইন ’অফিসিয়াল সিক্রেটস এক্ট ১৯২৩’ ধারায় গেল বছর ১২ ডিসেম্বর রয়টার্সের দুই সাংবাদিক কো ওয়া লোন (৩১) এবং কিয়াও সোয়ে’কে (২৮) গ্রেফতার দেখানো হয়। এ দুই সাংবাদিক বিদেশী সংবাদমাধ্যমে দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে অবৈধভাবে সরকারী গোপন তথ্য সংগ্রহ করছিল বলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দাবী করে।
তাদের বিচার ঔপনিবেশিক আমলের দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনের (অফিসিয়াল সিক্রেটস এক্ট ১৯২৩) অধীনে হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এ বছরের জানুয়ারী থেকে মিয়ানমারের একটি আদালতে প্রাথমিক শুনানি শুরু হয়। যদি সাংবাদিকরা দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
২০১৬ সালে রয়টার্সে যোগ দেওয়া কো ওয়া লোন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংকটসহ আরও বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। কিয়াও সোয়ে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে রয়টার্সের প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করছেন। সর্বশেষ তারা রাখাইনের ইন দিন গ্রামে সেনা অভিযানে ১০ রোহিঙ্গা হত্যার ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন।
জানুয়ারীতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ওই ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যার কথা স্বীকার করে বলেছে নিহতরা বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। তবে এ বিষয় নিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়নি বলে জানান জাতিসংঘের মিয়ানমারের দূত হাউ দো সুয়ান। বরং সরকারীগোপন নথি অবৈধভাবে নিজেদের কাছে রাখার অভিযোগে তাদের আটক করা হয়েছে।
এদিকে গেল সপ্তাহে দুই সাংবাদিকের আইনজীবি আদালতের কাছে এই মামলা খারিজের আবেদন করেছে। ইয়াংগুন জেলা আদালতে আগামী ৪ এপ্রিল, বুধবার মামলা খারিজের শুনানি হবে। আটক রয়টার্সের এ দুই সাংবাদিক যখন সুষ্ঠ বিচারের আশায় উদ্বিগ্ন তখর তাদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবি আমাল ক্লুনি। গেল বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে ক্লুনির কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে এ খবর জানানো হয়।
বিবৃতিতে ক্লুনি বলেন, শুধুমাত্র ঐ খবর (রাখাইনে রোহিঙ্গাদের খবর) দেওয়ার কারণে কো ওয়া লোন এবং কিয়াও সোয়ের বিচার চলছে। আমি তাদের মামলার কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করেছি। ঐ দুই সাংবাদিক নিরপরাধ। এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তাদের মুক্তি দেওয়া উচিত। এই মামলার ফলাফল মিয়ানমার সরকারের দেওয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাক স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অনেক কিছু বলবে।
স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ক্লুনি। ৪০ বছর বয়সী এ ডাকসেটে আইনজীবি তার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষনতা, আইন সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান-ধারনা নিয়ে বিশ্বে সমাদৃত। নিজেকে তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন মানবতার কল্যাণে। তাই তো তার আইনি কেসের অভিধানে হার শব্দটি নেই। আর্ন্তজাতিক বড় বড় কেসগুলোকে নিমিশেই তার মেধা দিয়ে সমাধান করেন তিনি।
ক্লুনির জীবনেও ঘটেছে অনেক নাটকীয় ঘটনা। সাফল্য অর্জন করতে গিয়ে পার হতে হয়েছে নানা ঘাত প্রতিঘাত। ক্লুনির জন্ম বৈরুত, লেবাননে। বাবা ছিলেন ট্রাভেল এজেন্সিীর মালিক,মা ছিলেন পত্রিকার প্রকাশক। ২০০১ সালে নিউওয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ ল তে এলএমএ তে ভর্তি হন এবং ভাল ফলাফল করেন। ২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনার কোর্ট অফ জাস্টিস এর ক্লার্কশীপ পান। আইনজীবি হিসেবে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে চর্চা শুরু করেন। নিউওয়র্ক, ইংল্যান্ড এবং ওয়ালের বারের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ইউ এনর স্পেশাল ট্রাইবুনাল অফ লেবানন এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইবুনাল ফর দ্যা ইউগোসোলভাকিয়ার প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন।
২০১০ সালে চলে যান ব্রিটেনে। সে সময় লন্ডন এবং ওয়ালসের বারের ডটি স্ট্রেট চেম্বারের ব্যারিষ্টার নিযুক্ত হন। ২০১৩ তে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েন কর্ম পরিধি বেড়ে যাওয়ার কারণে। কফি আনানের সিরিয়া বিষয়ক পরামর্শক, ইউএন হিউম্যান রাইটসের পরামর্শক হিসেবে গুপ্তচর হত্যায় ড্রোন কতটুকু কার্যকর তার বিরুদ্ধে আবস্থান নেন এবং গুপ্তচর হত্যায় ড্রোন আক্রমন বন্ধ করেন। কলম্বিয়াতে গৃহযুদ্ধের সময় কলম্বিয়ার ইন্টলিজেন্সেদের সঙ্গে, বাহরাইনের রাজার পরামর্শক হিসেবে স্বনামধন্য প্রফেসর চেরিক বাসিওনির সঙ্গে কাজ করেন। ২০১৫ তে কলম্বিয়া ল ইনিষ্টটিউটের উচ্চ পদস্থ ফেলো নির্বাচিত হন। আবার ইউনিভাসির্টি অফ লন্ডনের আইনের লেকচারার হন। পাশাপাশি ”দ্যা নিউ স্কুল”, নর্থ ক্যারোলাইনার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করেন। সে বছরের ৮ মার্চ গণতান্ত্রিক ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতি গোরলিয়া ম্যাকপাগালের লাগাতার অবরোধ যে আর্ন্তজাতিক আইন সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করেছে তা প্রমান করেন ক্লুনি।
অন্যদিকে মালদ্বীপের নির্বাসিত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাশেদের কেস লড়াই করেন। নাশেদকে উদ্দেশ্যে প্রনোদিতভাবে যে দীর্ঘদিন কারাগারে রাখা হয়েেছ তা ধাপে ধাপে প্রমান করেন। আইরিশ সরকার ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা যে নীতি বহির্ভুত ছিল বলে আর্ন্তজাতিক আদালতে মামলা করে তাও পুরো ভ্রান্ত বলেন ক্লুনি। শেষ পর্যন্ত আইরিশদেরই কেসে পরাজয় ঘটে।
২০১৪ সাল থেকে ইউকে এর্টনী জেনারেল অফিসে কর্মরত আছেন। আগামী ২০১৯ সাল পর্যন্ত থাকবেন এখ কাজে। এছাড়া পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল প্যানেলের কাউন্সিলারও তিনি। তাছাড়া নিজের সংগঠন তো আছেই।
নিজের কাজের কৃতিত্ব হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরষ্কার। তার চেয়ে বড় কথা ক্লুনি কোন কেস আজ পর্যন্ত হারেননি। সেটা ছোট কিংবা আর্ন্তজাতিক হোক। নতুন এই কেসেও নিজের সাফল্যের তকমাটা আপ্রাণ ধরে রাখার চেষ্টা করবেন ক্লুনি এটাই স্বাভাবিক। আর তা যদি করতে পারেন ক্লুনি তার খ্যাতি এগিয়ে যাবেন আরও এক ধাপ। সবচেয়ে বড় কথা কেসে জিতলে মুক্ত করতে পারবেন মিয়ানমারে বন্দী রয়টার্সের দুই সাংবাদিক কো ওয়া লোন, কিয়াও সোয়েকে। বেচে যাবে দুইটি জীবন, বেচে থাকবে সততা ও সত্যতা ।
