চাঁদের আলোয় কাটুক আঁধার
ঝর্ণা মনি
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:৪০ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২২ শনিবার
ঝর্ণা মনি
তখন রামপুরায় থাকি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে গলির মুখে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনবো বলে অফিসের গাড়ি থেকে নামতেই অপরিচিত এক ভদ্রমহিলা জড়িয়ে ধরে বললেন, ওয়াও! তুমি খৃষ্টান। ঘটনার আকস্মিকতায় বোকা বোকা চাহনি বুঝতে পেরে ভদ্রমহিলার উত্তর, 'তুমি গলায় যীশু খ্রিস্টের লকেট পরে আছ।' বললাম, দিদি, একটু ভুল হয়েছে। আমি খৃষ্টান নই। লক্ষ্য করলাম, একটু অবাক হলেন ভদ্রমহিলা। কপালে ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে ওঠল। মুখে হাসি অটুট রেখে বললেন, 'সমস্যা নেই। তুমি আমার যীশুকে শ্রদ্ধা করো, ভালোবাসো, এটিই যথেষ্ট।' এরপর দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে চলে গেল।
(২)
কোভিড শুরুর আগে দোয়েল চত্বরে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দোকান ঢু মেরেছিলাম কিছু গয়না কেনার জন্য। স্কাই-ব্লু জিন্স আর সাদা টপসের সাথে ম্যাচিং করে লম্বা চেন পরেছিলাম সেদিন। পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটির কিছু তৈজসপত্র দেখছিলেন আপাতমস্তক বোরকা পরিহিত এক ভদ্রমহিলা। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কুরআনের আয়াত গলায় পরেছ; ভালো কথা, কিন্তু ওড়না কোথায়? জানো না, মুসলমান মেয়েদের পর্দা করতে হয়? বললাম, আন্টি, আমি মুসলিম নই। আর এটি তো একটি চেন। কুরআনের আয়াত জানি। কিন্তু বাংলা অর্থ জানি না। আজমির শরিফ বেড়াতে গিয়ে পছন্দ হয়েছে, তাই আমার দিদিয়া কিনে দিয়েছিল।
উত্তর শুনে আন্টির মনে হয়, এক দলা থুতু গলায় আটকে গেল! ঘোঁত ঘোঁত করে কিসব বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন। তার নাকি সুরের আওয়াজে আমি শুধু 'নাপাক' শব্দটিই বুঝলাম!
(৩)
ভয়ংকর কোভিডকাল। কঠোর লকডাউন। জনমানুষহীন রাস্তাঘাটে শুধু এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। থাকি ইস্টার্ন ইডেনে। গেটের ঠিক বিপরীতেই সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার। পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা অরুণ সরকারের অপেরা ফার্মেসি। বাবার জন্য ক্লপিড এএস, সেরিটন, সেকলো কিনতে অপেরায় গিয়ে দুই বন্ধু টুকটাক কথা বলছিলাম। এরমধ্যে এক ভদ্রলোক এলেন ইনজেকশন নিতে। হঠাৎ আমার দিকে দৃষ্টি পরতেই বললেন, বাহ্! আপনি তাহলে বৌদ্ধ। বেশ, বেশ। আমিও বৌদ্ধ। বললাম, আমি বৌদ্ধ নই। ভদ্রলোক কাচুমাচু করে বললেন, না মানে, আপনি গলায় মহামতি বুদ্ধের লকেট পরে আছেন তো তাই!
(৪)
গত ডিসেম্বর। বেইলি স্টারের সামনে দাঁড়িয়ে প্রবাসী এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে এক ভদ্রলোক এসে নমস্কার করে বললেন, 'দিদি, আমিও হিন্দু। আপনার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা দেখে খুব ভালো লাগলো। এটি কি পাঁচ মুখী রুদ্রাক্ষ? কোথায় পেলেন? কিন্তু জানেন,রুদ্রাক্ষ পরে নিয়ম না মেনে চললে উল্টো অনেক ক্ষতি হতে পারে।'
বললাম, ভাই, আমি মানুষ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান- এসবের চেয়েও বড় পরিচয় মানুষ। আর এই রুদ্রাক্ষের মালা কোনো ধর্মীয় কারণে পরিনি, ফ্যাশনের জন্য পরেছি। তামিলনাডুর মহালক্ষ্মী মন্দির থেকে কেনা এই মালার ঠিক দ্বিতীয়টি দেখতে পাবেন বিখ্যাত কবি হেলাল হাফিজের গলায়।
গলার মালা দিয়ে ধর্ম যাছাই করতে আসা ভদ্রলোকের মুখের মানচিত্র মুহূর্তে পাল্টে গেল! ধর্ম নিয়ে ঠাট্টাতামাশা! তরুণ প্রজন্ম উচ্ছন্নে যাওয়ার দুঃখে গজরাতে গজরাতে তিনি পাশ থেকে সরে গেলেন।
(৫)
চাঁদ। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। চাঁদ নিয়ে ছড়া, কবিতা, গানের শেষ নেই। আজও আকাশে একটাই চাঁদ। একই চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে ধরণী। জোসনাপ্রেমীরা জোসনায় মেতে উঠেছেন।এই একই চাঁদের হাসিতে আজ হিন্দু ধর্মের কোজাগরী পূর্ণিমা, বৌদ্ধধর্মের প্রবারণা পূর্ণিমা, মুসলিম ধর্মের ঈদে মিলাদুন্নবী আর খৃষ্টান ধর্মের ইস্টার সানডে।
চাঁদের আলোয় কাটুক আঁধার।
লেখক পরিচিতি: ঝর্ণা মনি, ডেপুটি চিফ রিপোর্টার, ভোরের কাগজ।