ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৫২:৩২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ফরিদপুরের অন্নপূর্ণা- ভারতের `বুড়িমা` 

তপতী বসু

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:০৯ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০২২ বৃহস্পতিবার

ফরিদপুরের অন্নপূর্ণা- ভারতের `বুড়িমা` 

ফরিদপুরের অন্নপূর্ণা- ভারতের `বুড়িমা` 

কম বয়সে বিয়ে হয় ফরিদপুরের অন্নপূর্ণা দাসের। স্বামী  আর সন্তানদের নিয়ে গ্রামে সুখের সংসার ছিলো। একদিনের দেশভাগ তাঁকে ছিন্নমূল করে দেয়।
সুখের সংসার থেকে একেবারে রিফিউজি ক্যাম্পে। ১৯৪৮ সালে  ভিটেছাড়া হয়ে চলে আসেন। তখনকার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ধলদিঘি সরকারি ক্যাম্পে আশ্রয় পান। ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই মৃত্যু হয় স্বামী সুরেন্দ্রনাথ দাসের। 
সন্তানদের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য ধলদিঘির বাজারে রাস্তার পাশে বসে পটল, বেগুন, কুমড়ো, ঝিঙে কিনে বাজারে বিক্রি করতেন।
কখনও কর্মকারের কাছ থেকে হাতা, খুন্তি কিনে হাটে বিক্রি বা বাড়ি বাড়ি নানান সামগ্রী ফেরি করা....। কিন্তু তাতে পেট চলে না। অথচ অমানুষিক পরিশ্রম। বন্ধ করে দেন সেই ব্যাবসা।
ধলদিঘি থেকে এক সময়ে গঙ্গারামপুরে চলে যান। 
গঙ্গারামপুরে পরিচয় হল মা হারানো  সনাতন মণ্ডলের সঙ্গে।  হয়ে উঠলেন সনাতনের মা। তার মুদির দোকান। দক্ষ হাতে বিড়িও বাঁধে। 
অন্নপূর্ণা সনাতনের কাছে শিখলেন বিড়ি বাঁধার কায়দা। অন্নপূর্ণার বিড়ি জনপ্রিয় হল। এই ভাবে চলতে চলতে বছর তিনেকের মধ্যে স্বপ্নের মতো তাঁর নিজের বিড়ি কারখানা গড়ে ওঠে। 
ভিটেছাড়া হয়ে চলে এসেছিলেন।  উদ্বাস্তুদের পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি ক্যাম্প থেকে এক সময়ে হাওড়া জেলার বেলুড়ে স্থায়ী ঠিকানা হয় তাঁর। গরিব ঘরের লড়াকু মেয়ে   হয়ে উঠতে লাগলেন সফল ব্যবসায়ী।
বেলুড়ে প্যারিমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে একটা দোকান-সহ বাড়ি কেনেন তিনি। ধীরে ধীরে  শুরু হয় আলতা, সিঁদুর বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি, দোলের রং এর ব্যবসা।
এক সময় কালীপুজোয়  দোকানে বাজি রাখতে শুরু করেন তিনি।  নিজে তৈরি করতেন না, অন্যের থেকে কিনে এনে বিক্রি করতেন।
আইন না জানা থাকায়  একবার পুলিশ এসে জানতে চাইল বাজি বিক্রির সরকারি ছাড়পত্র কোথায়? লাইসেন্স না থাকায় সমস্ত বাজি বাজেয়াপ্ত হল। জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা সামলেছেন, তাই এতে বিচলিত হলেন না। 
অন্নপূর্ণা  দেখলেন বাজি কিনে বিক্রির থেকে অনেক বেশি লাভ বাজি তৈরি করে বিক্রি করতে পারলে। জেদ চাপল- ছাড়পত্র জোগাড় করে এবার নিজেই বাজি তৈরি করবেন।
বাজি বিশেষজ্ঞ বাঁকড়ার আকবর আলিকে মানলেন গুরু। তাঁর কাছ থেকে শিখলেন সোরা, গন্ধক, বারুদের বিভিন্ন অনুপাত  মিশিয়ে বাজি বানানো। বাজার ধরে রাখতে বাজির কারিগরদের নিয়ে সরকারের নির্দেশনামায় তৈরি করলেন বাজি কারখানা।   
ততোদিনে মাথায় পাকা চুল, শরীরে বার্ধক্যজনিত ছাপ।  ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে 'বুড়িমা' বলে ডাকতো।
ম্যানেজমেন্ট গুরুদের মতো ব্র্যান্ডিং জানতেন না। তবু 
এই নতুন নামেই তৈরি করলেন ব্র্যান্ড। নিজের বাজিকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে নাম দিলেন ‘বুড়িমা’
তিনি নানা রকমের আতসবাজি বানানো শুরু করেছিলেন।
আতশবাজির দুনিয়ায়  নিজের অজান্তেই  তিনি হয়ে গেলেন বিখ্যাত নাম- "বুড়িমা"! এক ব্রান্ড!
পরবর্তীকালে পঞ্চাশটি পরিবারের জন্য বিলিয়ে দিয়েছিলেন জমি। ব্যবসার পাশাপাশি তাঁর এই মানবিক দিকগুলো জনমানসে তাঁকে আরও প্রিয় করে তুলেছিল। তারপরও আছে।
তালবান্দা আর ডানকুনিতে তৈরি করে ফেললেন দুটো কারখানা ।   পাড়ি দিলেন দক্ষিণ ভারতের বাজি শহর শিবকাশীতে। সেখানেই লিজে জমি নিয়ে দেশলাই কারখানা গড়লেন। বুড়িমার নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতবর্ষে ।
ডানকুনিতে চলতে থাকে তাঁর বাজির কারখানা। তাঁর জীবনী সত্যিকারের এক রূপকথার মতো। বাঙালির দ্বারা ব্যবসা হয়না এই আপ্তবাক্য কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে, এক বাঙাল  মেয়ে  ব্যবসায় সাফল্যের  অনন্য নজির গড়েছেন ।
সব হারিয়ে ভিনদেশে আসা মহিলাটির পরিচয়- 
ফরিদপুরের অন্নপূর্ণা - 
ভারতের ' বুড়িমা' !
১৯৯৫ সালে প্রয়াত হন অন্নপূর্ণা দাস।