ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫৬:৫২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

কৃষক নারীদের সাথে আমার গল্প শেষ হয়নি

ফরিদা আখতার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:৫৮ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার

লেখক ফরিদা আখতার, নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ

লেখক ফরিদা আখতার, নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ

কৃষক নারীদের সাথে আমার গল্প করা শেষ হয়নি। এবার আমি আধুনিক কৃষি পরিবারের কয়েকজন নারীকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলাম আলোচনার জন্য। প্রথমেই আমার একটি ভুল ধারণা ভাঙলো, আমি ভেবেছিলাম তাঁরা অত আগ্রহ ভরে কথা বলবেন না। কেন এমন উদ্ভট কথা আমি ভাবলাম তা জানি না। তবে তাঁদের সাথে কথা বলে আমার নয়াকৃষির নারী কৃষকদের সাথে কথা বলার মতোই আনন্দ পেলাম। তাঁরা জানালেন, অবশ্যই তাদের স্বামীরা নম্বরী ধান (বিআর ২৯, শ্বর্ণা, বিআর ১১, বিআর ৪৯, বিআর ৫২) উৎপাদন করেন। সরিষার মধ্যে ধুপরী নামের হাইব্রীড সরিষা, নানা রকম হাইব্রীড সব্জি ইত্যাদী চাষ করেন। এই ফসল করতে সার- ইউরিয়া, পটাশ কিনতে হয়। দাম জানেন না, কারণ স্বামী বাজার থেকে নিয়ে আসেন। কীটনাশক ব্যবহার হয় তবে বেশি ব্যবহার করেন “ঘাসমারা” (Herbicide) ওষুধ, তাহলে নিরানি দিতে হয় না। নিরানী দেয়ার শ্রমিকের দাম বেশি। এই ওষূধ দিলে সেই খরচ বেচে যায়। 
তাহলে কি আপনাদের কোন বীজ রাখার কাজ করতে হয় না? উত্তর শুনে আমি অবাক। আমরা স্থানীয় ধানের বীজ যেমন পাটজাগ, চামারা, পাইজাম, নাজিরশাইল), সব্জির বীজ (সীম, চাল কুমড়া, লাউ), মাঘী সরিষা–এসব বীজ হাতে রাখি। এই হাতে রাখি কথাটা খুব জোর দিয়ে বললেন। কারণ জমি তো সব একরকম না। ধোপা এলাকায় (নীচু) আমন ধানের কিছু জাত লাগালে ভাল। এখানে নম্বরী ধান চলে না। এসব বীজ রাখছে দেখে স্বামীও খুশি হয়। বলে, ‘তুমি বীজ রাখছিলা বলে তো চাষ করতে পারলাম। দেখতে ভাল লাগলো। আমার টাকা বাচলো। এই টাকা দিয়ে আমি হাল বাইমু’ । যতোই হোক, স্বামীর মাথায় আধুনিক চাষের খরচ যোগানোর চিন্তা! 
তবে এই কথা তারা পরিস্কার জানিয়ে দিলেন এই নম্বরী ধানের বীজ নারীদের পছন্দ নয়। তাঁরা বললেন ‘আমাদের পছন্দ নিজের হাতে রাখা বীজ’। ইরি ধানে কোন স্বাদ নাই; খেলে অনেক অসুখ বিসুখ হয়। 
হেসে ছড়া কাটলেন ‘ধানের মধ্যে ইরি, ইষ্টির মধ্যে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি’[অর্থাৎ নিজের মা-বাবা বাদ দিয়ে বাইরের মানুষকে দেখে]।
আলোচনা মোড় একটু ঘুরালাম। এবার জমির প্রসঙ্গ। আধুনিক কৃষি করা এই নারীদের পরিবারের জমি তুলনামুলকভাবে বেশি, কমপক্ষে দেড় একর থেকে সাড়ে তিন পর্যন্ত জমি তাদের আছে চাষাবাদের জন্যে। আচ্ছা এই জমির মধ্যে আপনাদের নামে কোন জমি আছে? সমলার স্বামীর ৩.৫০ একর জমি, সমলার নামে দিয়েছেন ৪০ শতাংশ। কারণ? তাদের দু’জন ছেলে, কোন মেয়ে নাই। স্বামী ভেবেছেন তাঁর অবর্তমানে ছেলেরা মা’কে নাও দেখতে পারে , তাই আইনীভাবে পাওয়ার বিষয় থাকলেও আলাদাভাবে জমি লিখে দিয়েছেন। মধ্যবয়সী সমলা একটু লাজুক ভঙ্গীতেই বললেন তাঁর স্বামী তাঁকে ভালবাসেন। 
মর্জিনার স্বামীও ২২ শতাংশ জমি লিখে দিয়েছেন তাঁর নামে। কিন্তু ফসল করার ক্ষেত্রে স্বামীর সিদ্ধান্তেই ইরি আবাদ করতে হচ্ছে। কিছুটা মন খারাপ করেই বললেন ‘অন্য কিছু করতে হলে অনেক ভাল ফসল করে দেখাতে হবে’। কিন্তু ইরি আবাদ ভাল হোক কি খারাপ হোক তা নিয়ে প্রশ্ন নাই। ‘স্বামীর জমির ব্যাপারে বলা বে-আইনী কথা হবে’।
রিজিয়ার নামে কোন জমি নাই, স্বামীর কাছেও তিনি চান নি। কেন? ছেলে দুইজন আছে, মেয়ে নাই। মেয়ে থাকলে নিজের নামে জমি রাখার কথা ভাবতেন কারণ ছেলেরা যদি তাদের বোনকে না দেখে তাহলে তিনি মেয়েকে তার জমি দিতে পারতেন। এখন আর সেই চিন্তা নাই। কিন্তু মেয়ে থাকলে তো মেয়েও বাপের সম্পত্তি পেতে পারে । রিজিয়ার এই ব্যাপারে কোন বিশেষ মত নেই। মেয়ের জন্য নিজে যা করতে চাইতেন তিনি তাই বললেন। 
রানীর কোন জমি নিজের নামে নাই। ছেলেরা আছে দেখবে আশা করেন না, তাকে নিয়ে বল খেলাখেলি শুরু হবে। হেসে বললেন, ‘জমি আছে গোরস্তানে সাড়ে তিন হাত’। 
বাপের বাড়ি থেকে উত্তরাধিকারের সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার অভিজ্ঞতাও তাঁরা বললেন। সমলার ভাইয়েরা জমি বাবদ তাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিল, তিনি আনেন নি। ভাইদের দিয়ে দিয়েছেন। রানী তার ভাতিজাদের দিয়ে দিয়েছেন। মর্জিনার ভাইয়েরা জমির ভাগ দিতে চায় না। তবে তারা মনে করেন বাপের বাড়িতে কিছু সম্পত্তি থাকা ভাল। প্রয়োজনে সেখানে যাওয়া যায়। 
‘ঝি-বেটী ঠেকলে যায় বাপের বাড়ি আর রাইন-পাতিল ভাঙলে যায় কুমার বাড়ি’।
‘বাপের বাড়ি ওয়ারিসের মালিক, স্বামীর বাড়ি দুই আনার মালিক’। 
সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয় নি। বিশেষ করে গ্রামের নারীদের যে অবস্থা সেই অবস্থার প্রেক্ষিতে বা তাদের perspective কিছু জানা যায় না। আমি নয়াকৃষির নারী কৃষকদেরও এই প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁরা ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের সদস্য। জমি খুব বেশি নেই। নিজেরা ফসল ফলিয়ে কেউ কেউ জমি কেনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জমি নিজের নামে করতে গেলে বাঁধার সম্মুখিন হয়েছেন। একজন বলে উঠলেন ‘মহিলার নামে জমি করলে সেখানে ঝগড়া/অশান্তি আছে’। এই কথার অনেক গভীর অর্থ করা যায়। ঝগড়াটা কেন, কার সাথে?
কিন্তু নয়াকৃষির নারী কৃষকরা স্বামীর জমিতে কি ফসল ফলাবে, কোন বীজ রাখবে, পুরো কৃষি ব্যবস্থাপনায় তাদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি, তাদের মর্যাদাও বেশি। তারা স্বামীর জমি, নিজের জমি এই ভাগটুকু করেন না, প্রয়োজন হয় না। এই বিষয়টি খুব দৃশ্যমান এবং নারীদের কথায়ও খুব আত্মবিশ্বাস দেখা গেছে।
তবু জমিতে নারীর ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন আছে । নারী অধিকার প্রশ্নে এই বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ