ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:১৩:৩৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ফেসবুক চ্যাটিংয়ে সাবধান : আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ০১:৫২ এএম, ১৪ জুন ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:৩৭ এএম, ৫ জুলাই ২০১৮ বৃহস্পতিবার

হাত থেকে কখনোই মোবাইল ফোন সরায় না নিলয়। সারাক্ষণ তার চোখ থাকে ফোনের স্ক্রীনে। দেখে বিরক্ত লাগে সাথীর। একটা মানুষ সারাক্ষণ নেটে! কাহাতক দেখা যায় এ দৃশ্য। ভীষণ বিরক্ত লাগে ওর। সংসারের কথা, নিজের কথা বলার সময়ও যেন নেই নিলয়ের!

 


বাচ্চাগুলোকে সময় পর্যন্ত দেয় না। অফিস থেকে ফিরেই বসে যায় নেটে। সাথী নিষেধ করলে লাগে ঝগড়া। আস্তে আস্তে সম্পর্কে শুরু হয় শীতলতা। সাথী অভিমানে দূরে সরে যায়। ও-ও তো ফেসবুকে বসে। কই এতো তো উন্মাদনা দেখানোর তো কিছু নেই!



আগে ওদের কি সহজ সম্পর্ক ছিলো। অফিস থেকে ফিরে কত গল্প করতো ওরা। কেনাকাটা করতো। বাচ্চাদের নিয়ে খেলতো। স্বপ্ন দেখতো অনেক। দু’জন দু’জনের কাছে ছিলো স্বচ্ছ। কার অফিসে কি হয়েছে সব শেয়ার করতো ওরা। গান শুনতো একসাথে।

 

আর এখন? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাথী। নিলয়ের সাথে কথাই বলা যায় না। বুঝতে পারছে নিলয় কোনো কিছুতে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি সেটা ধরতে পারে না সাথী। অসহায় লাগে নিজেকে। কি করবে বুঝতে পারে না।

 

একদিন দুপুর বেলার ঘটনা। নিলয়ের মোবাইল সেট চার্জে দেয়া ছিলো। ছোট ছেলেটা ফোনটা নিয়ে খেলতে গেলে ম্যাসেঞ্জার খুলে যায়। তখনই সাথী দেখে একটা মেয়ের সাথে নিলয়ের চ্যাটিংয়ের কিছু কথা। পুরো পৃথিবীটা দুলে ওঠে ওর। বড় শুন্য মনে হয় নিজেকে। মনে হয় এতদিন একটা প্রতারকের সাথে সংসার করছে ও। যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছে সেই আজ সবচেয়ে অবিশ্বাসী! ও যেন আর নিতে পারে না। সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার। শুনে নিলয় ক্ষমা চায়। অনুতপ্ত হয়। বারবার বলে ভুল হয়েছে, অফিসের এক সহকর্মীর সাথে মজা করে দু’একবার চ্যাটিং করতে করতে বিষয়টা আজ এ পর্যায়ে এসেছে। নেশার মতো প্রতিদিন জড়িয়ে যাচ্ছিল সে। এটা যে অন্যায় তা বুঝতে পারছিলো। কিন্তু ফিরে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছিল না।

 

সুপ্রিয় পাঠক, এ গল্পটা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা। এ ধরনের ঘটনা আজকাল অনেকের জীবনে ঘটছে। নিছক ফান বা মজা করার জন্য চ্যাটিং করতে করতে তা আজ সিরিয়াস পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বুঝে না বুঝে অনেকেই ফেসবুকে চ্যাটিং করতে করতে জড়িয়ে যাচ্ছেন অনৈতিক সম্পর্কে। যার ফল বয়ে নিয়ে আসছে ভয়াবহ পরিণতিতে। বিশেষ করে বিবাহিত নারী পুরুষের মাঝে বেড়ে যাচ্ছে সর্ম্পকের জটিলতা। ভেঙ্গে যাচ্ছে বিশ্বাস, ঘর।



বিথী নামের এক চাকুরিজীবী নারী জানান, তিনি একা থাকেন। তার কিছু সহকর্মী প্রায় মাঝরাতে তাকে মেসেঞ্জারে নক করেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেন, তারা সুখে নেই, স্ত্রী বোঝে না তাদের। বিথি হাসতে হাসতে বলেন, জানেন তাদের প্রোফাইলজুড়ে কিন্তু ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীর সাথে হাসিমুখের ছবি! এটা তাদের ভন্ডামি! যখন তাদের বলি, আপনার এ লেখাগুলো পড়ারো আপনার স্ত্রীকে, তিনি কি জানেন আপনি আমাকে কি লিখছেন? তখন ক্ষমা চায়। বলে ভুল হয়ে গেছে, আপনি ভালো না মন্দ মেয়ে তা টেস্ট করলাম। এ ধরনের আচরণ কি শোভন? প্রশ্ন তার। ফেসবুক আজ সবার কাছে এক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, তবে এর সঠিক ব্যবহার না করে হচ্ছে অপব্যবহার!

 

ফেসবুকে মানুষ সবচেয়ে ভালো ভালো কথা লেখে। সবচেয়ে সুন্দর ছবিগুলো দেয়। যে নীতিবান নয়, সেও নানা নীতিকথা লেখে তার ওয়ালে। এতে বিভ্রান্ত হয় অনেক মানুষ। আসল নকল গুলিয়ে ফেলে সে। আসলের চেয়ে নকলকেই তখন বেশি মনে হয় আপন। জড়িয়ে যায় মিথ্যার জালে। ফলে এক নিমিষে গুড়িয়ে যায় দীর্ঘদিনের ভালোবাসার সংসার। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় কিছু নিরপরাধ মানুষ।

 

ফেসবুকের কারণে আজ সমাজে বাড়ছে পরকীয়া, অবিশ্বাস আর হতাশা। পরকীয়ার ঘটনা সমাজে আগেও ঘটেছে, কিন্তু তা ছিলো অনেকটাই কম। বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোনের কারণে তা হয়ে গেছে অনেক সহজ। ফলে দিন দিন বাড়ছে এর পরিমাণ। কিছু কিছু নারী-পুরুষ আছেন যারা নিজেদের সংসার নয়, অন্যের সংসারকে ভাবেন সুখি। এ সুখ খুঁজতে যেয়ে বা মোহে পরে তারা জড়িয়ে যান অনৈতিক সম্পর্কে। আর এর শুরুটা হয় এখন ফেসবুক থেকেই।

 


রুনা একটি বেসরকারি অফিসে কাজ করেন। তার স্বামী সুমন পেশায় ডাক্তার। সাদাসিদে, খুবই আমুদে ভদ্রলোক। বউকে অসম্ভব ভালোবাসেন। অথচ তিনি জানতেও পারেন না তার স্ত্রী তাকে না জানিয়ে প্রতিদিন চ্যাটিং করে তারই বসের সাথে। বস খেয়েছে কিনা? কি করছে এখন? কাল কি শার্ট পরে আসবে, কোন শার্ট মানায়, অফিসের কাজে তার মন বসে না, তার টিপস দিতে নানা কথা লেখে সে। সে অফিসে বসেও চ্যাটিং করে। আবার কখনো করে বাসায় গেলেও। অথচ তার পাশে বসে বর জানতেই পারছে না স্ত্রীর এই চ্যাটিং-এর কথা।

 

এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী ইসরাত জাহান জানান, এ সমস্যা তখন হয় যখন নিজেদের মধ্যে শেয়ারিংটা কম হয়। পারস্পরিক বিশ্বাস কমে যায়। দুজন দুজনের ভালো লাগা মন্দ লাগাকে গুরুত্ব দেয় না। অতিরিক্ত ডমিনেট কেউ করে। এছাড়া কিছু মানুষ আছে যারা অল্পে খুশি হয় না। অনেকের আবার অন্যের বিষয়ে থাকে অতিরিক্ত কৌতুহল। এ বিষয়গুলো মানুষের ভিতর যখন বাড়তে থাকে তখন নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সে। জড়িয়ে যায় নতুন সম্পর্কে।

 

তিনি বলেন, এ ধরনের আচরণগুলো আসলে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বাড়ায় দু পক্ষেরই। বাড়ায় সামাজিক সমস্যাও।

 

প্রিয় পাঠক, এখন ভাবুন রুনার বর যদি কোনদিন জানতে পারেন বা চ্যাটিংয়ের লেখাগুলো পড়েন তা হলে কি ভাববেন? ক্ষমা কি করতে পারবেন স্ত্রীকে? সহজ কি হবে এ সর্ম্পকগুলো? কি হবে তখন সর্ম্পকের পরিনতি? এরা দুজনই কিন্তু ঠকাচ্ছেন তাদের পরিবারকে। এসব চ্যাটিংয়ের কথা যদি প্রকাশ পায় বা কেউ যদি শেয়ার করে দেয় ফেসবুকে, তাহলে তারা কতটা সম্মানিত থাকবেন সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে!

 

সামাজিক সমস্যা রোধে তাই এখনই বন্ধ করা দরকার এসব চ্যাটিং চ্যাটিং খেলা। কাজের প্রয়োজনে লিখুন যে টুকু দরকার ঠিক ততটুকুই। শব্দচয়নে হোন মার্জিত। সতর্ক হোন, সচেতন হোন নিজের চারপাশ নিয়ে। জীবনে প্রলোভন থাকবেই। কিন্তু তা থেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে নিজেকে। পরিমিতি বোধ থাকতে হবে জীবন আচরণে। এমন কিছু করা যাবে না, যাতে নিজের দিকে নিজে তাকাতে পারবেন না।

 

বিশ্বস্থ হোন আপনার পাশে থাকা প্রিয় মানুষটার প্রতি। যে সারাজীবন মায়াভরা চোখে, মমতামাখা হৃদয় নিয়ে আপনার পাশে থাকে। আপনার বিপদে আপদে যার বুক কাঁপে। ভালোবাসার এসব মানুষদের ঠকানো তো পাপ। মমতামাখা এসব হৃদয়গুলো শুকিয়ে গেলে ভালোবাসাহীন হয়ে পরবে জগত সংসার।

 

বসের সুনজরে থাকা, প্রমোশন কিংবা একটা ভালো চাকরি অথবা গৃহবধূদের অন্য সংসারে সুখের আশায় কোনো মিথ্যে স্তুতি শোনার বা বলার জন্য চ্যাটিং করার দরকার নেই অন্য মানুষের সাথে। গল্প করুন, প্রাণ খুলে আড্ডা দিন, হাসুন নিজের পরিবারের সাথেই, তারাই আপনার আপন। কারণ কোনো মিথ্যে সম্পর্ক বা স্বার্থের সম্পর্ক খুব বেশি দিন টেকে না। কিন্তু এর প্রভাব আর দাপটে ভেঙ্গে যায় শত শত মন আর সংসার। তাই নিজে কি করছেন তার খেয়াল রাখা দরকার। এমন কোনো আচরণ করে নিজেকে ছোট করবেন না অন্যের কাছে। সাময়িক মোহে যা করবেন তার ফল কখনো ভালো হয় না।

 

বারবার ভাবুন যা করছেন, যা লিখছেন তার জন্য নিজের বিবেকের কাছে আপনি পরিস্কার তো? ছোট ছোট কথা দিয়ে শুরু করা চ্যাটিং একদিন যেন বড় হয়ে না যায়। এ কারণে যেন নষ্ট না হয়ে যায় সরল সর্ম্পকগুলো। পাশের মানুষকে অবহেলা করে, উপেক্ষা করে ভুল পথে দৌড়াবেন না।

 

ফেসবুক ব্যবহার করুন। কিন্তু নিজে ব্যবহৃত হয়ে যাবেন না। লেখায়-বলায়-ভাবনায় হন পরিমিত। থাকুন সৎ নিজের কাছে, অন্যের কাছে, সবশেষে প্রিয় মানুষের কাছে।

 

৥ লেখক : সিনিয়র নিউজ রুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন