শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার জন্মদিন আজ
অনু সরকার
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:২৯ পিএম, ২০ আগস্ট ২০২৫ বুধবার
শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা। ফাইল ছবি।
শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার ৮৪তম জন্মদিন আজ। ১৯৪০ সালের ২০ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যাওয়া দুঃসাহসী এক কবির নাম মেহেরুন্নেসা। স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর ওপর নিষ্ঠুরতম ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে শহীদ হন তিনি।
ষাটের দশকের সম্ভাবনাময়, প্রাণবন্ত, হাস্যোজ্জ্বল এক তরুণী কবি মেহেরুন্নেসা। বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অসময়ে মারা যান। পরিবারের খরচ যোগাতে পত্রিকায় কপি লেখা এবং প্রুফ দেখার কাজ শুরু করেন তিনি। সে সময়ের প্রায় সব পত্রিকাতেই তার কবিতা ছাপা হতো। কিন্তু সংসারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে এক সময় সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যেতে হয় তাকে। ছোট দুটি ভাইকে তো মানুষ করতে হবে। তাই নিজের সম্ভাবনা ভুলে গিয়ে সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন তরুণী মেহেরুন্নেসা। পরিশ্রম করতে লাগলেন দিনরাত।
এরই মাঝে ‘সাত কোটি জয় বাংলার বীর! ভয় করি নাকো কোন/ বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে- চির বিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে/ আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি/ চির বিজয়ের অটল শপথ/ জয় এ বাংলায় তুমি....’-- এই কবিতাটি জানান দেয় বিপ্লবের কথা। পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর প্রতি ছুঁড়ে দেয়া এই চ্যালেঞ্জে ক্ষমতার ভীত কেঁপে ওঠে।
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর কবি মেহেরুন্নেসা ঠিক করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’-এ পাকিস্তানের পতাকা না উড়িয়ে বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন অদম্য সাহসী এই মানুষটি। এতে ক্ষিপ্ত হয় ওই এলাকার রাজাকার ও বিহারীরা। কিন্তু তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেন মেহেরুন্নেসা।
তখন অবাঙালি ও বিহারীদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হতো মিরপুরের বাঙালিরা। এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য গঠিত হয় ‘অ্যাকশন কমিটি’। প্রেসিডেন্ট হন মেহেরুন্নেসা। তার খুব কাছের বান্ধবী কবি কাজী রোজি হন সদস্য। ২৫ মার্চ কমিটির মিটিং করেন সংগঠনের সব সদস্যরা। সেদিন মিটিং শেষে বাসায় ফেরার পথে দুই বান্ধবী অনুমান করেন দেশে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
২৫ মার্চ রাতেই পাক হানাদার বাহিনা হঠাৎ ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর হামলা চালায়। শুরু হয়ে যায় রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রাম।
এর ঠিক দু’দিনের মাথায় ঘটে যায় এক নির্মম হত্যাকাণ্ড। ২৭ মার্চ, বেলা ১১ টার দিকে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মাথায় লাল ও সাদা পট্টি পরে মেহেরুন্নেসার মিরপুরের বাসায় আসে কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি, আব্বাস চেয়ারম্যান, আখতার গুণ্ডা, নেহাল ও আরো অনেকে।
মেহেরুন্নেসা বিপদ বুঝতে পেরে কুরআন শরীফ বুকে নিয়ে পরিবারের সকলের প্রাণ ভিক্ষা চান। কিন্তু পিশাচেরা তার সেই আকুতি শোনেনি। একে একে সবাইকে জবাই করে হত্যা করে। তারপর মেতে ওঠে নারকীয় উল্লাসে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর দু’জন অবাঙালি বিহারীর মুখে শোনা যায় সেই নারকীয় উল্লাসের নির্মম ইতিহাস।
জানা যায়, ২৭ মার্চে নির্মমভাবে জবাই করে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয় কবি মেহেরুন্নেসাকে। তার মা ও দুই ভাইকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। মেহেরুন্নেসার কিশোর দুই ভাইয়ের মাথা নিয়ে ফুটবল খেলেছিল সেদিন ঘাতকেরা।
মেহেরুন্নেসার কাটা মাথা তারই লম্বা চুল দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঘুরানো হয়। আর এ সময় মেঝেতে পড়ে থাকে মেহেরুন্নেসার রক্তাক্ত দেহ। মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার নেতৃত্বে, তার দোসরদের সাথে পরিচালিত এই হত্যাকাণ্ড ছিল মানবতার ইতিহাসে অন্যতম এক কালো অধ্যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর ওপর যে নিষ্ঠু ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ হয় তারই শিকার হয়ে প্রথম শহীদ নারী কবি হিসেবে অভিহিত হন মেহেরুন্নেসা।
