ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ০:৪৪:৫৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

একটি ফোনকল ফাঁস যেভাবে সর্বনাশ ডেকে আনল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:১৩ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০২৫ শনিবার

পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা। ছবি : সংগৃহীত

পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা। ছবি : সংগৃহীত

থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে বরখাস্ত করেছেন দেশটির সাংবিধানিক আদালত। গত জুনে কম্বোডিয়ার সাবেক নেতা হুন সেনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন তিনি। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ওই ফোনকলে নৈতিকতা লঙ্ঘন করেছিলেন পেতংতার্ন।

হুন সেনের সঙ্গে ওই ফোনকলে পেতংতার্নকে আপসমূলক মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা যায়। থাইল্যান্ডের সামরিক কমান্ডারদের সমালোচনাও করেছিলেন তিনি। পরে যদিও আত্মপক্ষ সমর্থন করে পেতংতার্ন বলেছিলেন, ওই ফোনকলের মাধ্যমে কূটনৈতিক সাফল্য পেতে চাইছিলেন তিনি।

পেতংতার্নের বাবা থাকসিন সিনাওয়াত্রার পুরোনো বন্ধু হুন সেন। পেতংতার্ন বলেন, ওই ফোনের কথাবার্তা গোপন থাকা উচিত ছিল। ফোনের আলাপ–আলোচনা ফাঁস ছিল তিনি ও তাঁর দল ফিউ থাই পার্টির জন্য খুবই অস্বস্তিকর। এর জেরে পেতংতার্নের পদত্যাগের দাবি ওঠে। ক্ষমতাসীন জোটে তাঁর সবচেয়ে বড় অংশীদার দলও সরকার ছেড়ে যায়। এতে পার্লামেন্টে খুব সীমিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টিকে ছিলেন তিনি।

ফোনের আলোচনা ফাঁসের ঘটনার পর গত জুলাইয়ে আদালতের নয়জন বিচারকের সাতজনই পেতংতার্নের প্রধানমন্ত্রিত্ব স্থগিত রাখার পক্ষে ভোট দেন। বিচারকদের প্রায় সবাই একই সিদ্ধান্ত দেওয়ায় এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে চার উত্তরসূরির মতো একই ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছেন পেতংতার্ন। তাই শুক্রবার তাঁকে বরখাস্ত করে দেওয়া আদালতে রায় অবাক করে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না।

থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালতের রায়ে বহিষ্কার হওয়া দেশটির পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন। তাঁদের সবাইকে সমর্থন দিয়েছিল পেতংতার্নের বাবা থাকসিনের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন প্রশাসন। ফলে থাইল্যান্ডে ব্যাপকভাবে একটি বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে দেশটির আদালত প্রায় সব সময়ই এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রায় দেন, যাঁরা রক্ষণশীল ও রাজতন্ত্রপন্থী শক্তির চোখে হুমকি হিসেবে বিবেচিত।

পেতংতার্নের ফোনকল ফাঁস করেছিলেন হুন সেন নিজেই। সিনাওয়াত্রা পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্বকে খড়্গের নিচে ফেলে তিনি কেন এমনটা করেছিলেন, তা পরিষ্কার নয়। পেতংতার্নের একটি মন্তব্য নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন হুন সেন। পেতংতার্ন বলেছিলেন, নিজের যুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার নেতার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ‘পেশাদারত্বসুলভ নয়’।

হুন সেন বলেছিলেন, পেতংতার্নের ওই মন্তব্য ‘নজিরবিহীন এক অপমান’। এ কারণেই ‘সত্যটা ফাঁস করে’ দিয়েছেন তিনি। তাঁর ওই সিদ্ধান্তে থাইল্যান্ডে বড় রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে সীমান্তে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাও দেখা দিয়েছিল। গত মাসে তা পাঁচ দিনের সংঘাতে গড়ায়। এতে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া—দুই পক্ষের ৪০ জনের বেশি নিহত হন।

থাইল্যান্ডের সংবিধান অনুযায়ী, খুবই সীমিত একটি তালিকা থেকে এখন পার্লামেন্টের সদস্যদের নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে হবে। গত নির্বাচনের আগে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তিনজন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে হয়েছিল। গত বছর স্রেথা থাভিসিনকে আদালত বরখাস্ত করার পর থেকে এরই মধ্যে দুজনকে ব্যবহার করে ফেলেছে ফিউ থাই পার্টি।

দলটির তৃতীয় প্রার্থী হলেন চাইকাসেম নিতিসিরি। তিনি সাবেক মন্ত্রী ও ফিউ থাই পার্টির একজন বিশ্বস্ত নেতা। তবে অতটা জনসম্পৃক্ততা নেই। তাঁর স্বাস্থ্যও ভালো নেই। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্ভাব্য আরেকজন হলেন অনুতিন চার্নভিরাকুল। তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফোনকল ফাঁসের পর ক্ষমতাসীন জোট থেকে নিজের দল ভুমজাইথাই পার্টিকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।

ফিউ থাই আর ভুমজাইথাই পার্টি—দুই দলের সম্পর্কে এখন উত্তেজনা চলছে। জোট সরকার গঠনের জন্য আসনসংখ্যায় অনেক এগিয়ে থাকা ফিউ থাইয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে অনুতিনের দলকে। তবে সেই সরকার আদৌ স্থিতিশীল হবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বর্তমানে থাই পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশি ১৪৩ সদস্য রয়েছেন বিরোধী দল দ্য পিপলস পার্টির। তবে তাঁরা কোনো জোটে যোগ না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিরোধী দলে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে থাইল্যান্ডে বর্তমানে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা থেকে উত্তরণে নির্বাচনকেই একমাত্র পথ মনে করা হচ্ছে।

তবে ফিউ থাই পার্টি নির্বাচন চায় না। কারণ, ক্ষমতায় থাকার দুই বছরে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি তারা। তরুণেরাও এটা মনে করেন যে অনভিজ্ঞ পেতংতার্ন দেশের ওপর সত্যিকার অর্থে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বেশির ভাগ থাই নাগরিকের ধারণা, পেতংতার্নের হয়ে বড় সব সিদ্ধান্তই নিতেন তাঁর বাবা থাকসিন।

তবে থাকসিন সিনাওয়াত্রা তাঁর ‘জাদুর ছড়ি’ হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে। ফিউ থাই পার্টির গত নির্বাচনে প্রধান একটি প্রতিশ্রুতি ছিল, ‘ডিজিটাল ওয়ালেট’। এর মাধ্যমে দেশের প্রাপ্তবয়স্ক সব থাই নাগরিককে ৩০৮ ডলার করে দেওয়ার কথা ছিল। সে প্রকল্প বর্তমানে থমকে আছে। ব্যাপকভাবে অকার্যকর হিসেবে সমালোচিতও হয়েছে। অন্য অনেক পরিকল্পনাও আলোর মুখ দেখেনি।

কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত ঘিরে থাইদের জাতীয়তাবাদী মনোভাব যখন তীব্র হয়েছে, এমনই এক সময়ে হুন সেনের সঙ্গে সিনাওয়াত্রা পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রক্ষণশীল মহলে সন্দেহ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মনে করা হচ্ছে, তারা সব সময় জাতীয় স্বার্থের আগে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।

সব মিলিয়ে সিনাওয়াত্রা পরিবারের দল ফিউ থাই পার্টির জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। নতুন নির্বাচনে তাদের ১৪০টি আসনের মধ্যে বেশ কয়েকটি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে দলটি থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি ছিল। এখন সেই সে প্রভাব আবার ফিরবে কি না, তা বোঝা কঠিন।