ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৫৩:৩০ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

শাঁখারীবাজারের দুর্গোৎসবের রাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:৩৩ এএম, ২ অক্টোবর ২০২৫ বৃহস্পতিবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চলছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। রাজধানীর দুর্গাপূজা মানেই যেন পুরান ঢাকা। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব যেন হয়ে উঠে সার্বজনীন। আনন্দ উপভোগ করতে দল বেঁধে পূজামণ্ডপে আসেন ভক্ত ও দর্শনার্থীরা।

রাত তখন গভীর। ঘড়িতে বাজে প্রায় ১২টা। শহরে নেমেছে তুমুল বৃষ্টি। এর মধ্যেই পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারে পৌছে দেখা যায়, সরু গলি আর ইতিহাসে ভারাক্রান্ত দালানের দেয়াল যেন রূপকথার আলোয় ভাসছে। মোড়ে মোড়ে পূজামণ্ডপ। চারদিকে রঙিন আলো, উঁচু মঞ্চে দেবীর আসন, কোথাওবা বাড়ির আঙিনায় বসেছে পূজা। যেন কোনো এক শিল্পীর জীবন্ত ক্যানভাস।

শাখারীবাজারের রাস্তার দু’পাশে মেলা বসেছে। বাতাসে ভাসছে ধূপের সুবাস। মিষ্টির দোকান থেকে আসছে নাড়ু, পিঠাসহ হরেক রকমের মিষ্টান্নের ঘ্রাণ। খেলনার দোকানে কোলাহল। দোকানের সামনে ভিড় করে প্রিয়জনের জন্য উপহার কিনছেন অনেকে। বক্সে ভক্তিমূলক সংগীত, কখনো আবার আধুনিক সুরের ঝংকার। সুরের তালে নেচে উঠছে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। কেউ ছন্দ মেনে, কেউবা নিছক আনন্দে।

হঠাৎ এক তরুণীর কণ্ঠ ভেসে এলো- ‘এখানে প্রতিটি মণ্ডপই যেন জীবন্ত ছবি।’ প্রতিমার দিকে তাকালেই মনে হবে সত্যিই তো, যেন রঙিন ক্যানভাসে দাঁড়িয়ে আছেন জীবন্ত দেবী। নববানী, সূর্যতারা, নতুন কুঁড়ি, নব কল্লোল, সঙ্খমিত্র, ধ্রুবতারা- কোনো কমিটি বাদ নেই। সবাই প্রতিযোগিতায় নেমেছে- দেবীদুর্গাকে কে কার থেকে সুন্দর করে সাজাতে পারে।

আনন্দের ভিড়ে হঠাৎই এসে গেল এক নিঃশব্দ বেদনা। শিমুলিয়ার সাটারবদ্ধ শিল্পালয়ের সামনে এক খেলনার দোকানদার জানালেন, প্রবীণ প্রতিমাশিল্পী হরিপদ পাল এ বছর প্রতিমা গড়েননি। কিংবদন্তিতুল্য এই প্রতিমা কারিগরের কোনো সাগরেদ নেই এবার। নিজেরও বয়স হয়েছে ঢের। তাই আর প্রতিমা গড়তে পারেননি। যেন আলোর উজ্জ্বলতার আড়ালে নিভে যাচ্ছে এক শিল্পীর দীর্ঘ সাধনার প্রদীপ।

কিছুদূর হাঁটতেই দেখা হয় টুপি-পাঞ্জাবি পরা মুরুব্বির সঙ্গে। মাঝরাতেও খোলা রেখেছেন মুদি দোকান। কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে উৎসব যেটাই হোক; আনন্দ উপভোগে জাতপাত নাই। কথাটি বলেই সরল হাসি হাসলেন।

রাত গড়িয়ে তখন প্রায় দুইটা। আকাশে বজ্রের গর্জন, মাটিতে টুপটাপ বৃষ্টির ছন্দ। এরই মাঝে বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ভিড় ভেঙে মানুষ ঢুকে পড়ছে লুচির দোকানে। টগবগে কড়াইতে ফুটছে তেল, লুচি ভাজা হচ্ছে একের পর এক, পাশে সাজানো সুজি আর সবজি।

লুচির দোকান পেরিয়ে দেখা গেল, কিছুক্ষণ আগের লোকারণ্য ভিড় কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। চারদিক বৃষ্টিতে ভিজে নির্জন। গুটি কয়েক লোকজন আর ভক্ত রয়েছে। এরই মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ল এক দৃশ্য- এক তরুণ আঁকড়ে ধরে আছে সাদা শাড়ি পরা এক প্রৌঢ়কে। দু’জন দাঁড়িয়ে আছেন বাঁশের মাচা দিয়ে বাঁধা এক মণ্ডপের নিচে। বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছেন, তবুও মনে হচ্ছিল ওপর থেকে মা দুর্গা নিজেই যেন তাদের আগলে রেখেছেন। 

সূত্রাপুরের দিকে পা বাড়াতেই দেখা গেল সরু গলিতে হাঁটুপানি জমে আছে। বৃষ্টির কারণে কয়েক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই, চারদিকে আলো-আঁধারির খেলা। হঠাৎ আঁধার ভেদ করে মোমবাতি আর প্রদীপের আলোয় দেখা গেল এক পূজা মণ্ডপে দেবীদুর্গার প্রতিমা। বৃষ্টির অঝোর ধারার মাঝেও তিনি যেন নিজের দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সামনে আরও কয়েকটি গলিতে মরিচবাতির আলোয় দাঁড়িয়ে আছে চারটি মণ্ডপ। দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। কেবল প্রহরী আর স্বেচ্ছাসেবকরা রয়েছেন।

কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মাঝেই জমে থাকা পানি ভেঙে এগিয়ে আসছিলেন কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। কারও হাতে ভাঙা ছাতা, কারও কাঁধে ভিজে গামছা। তাদের মুখে বৃষ্টি হওয়াতে কিংবা পানি জমা গলি নিয়ে নেই কোন খেদ। হাসিমুখে তারা মাকে দর্শন করতে চলেছেন। দৃশ্যগুলো দেখে সেই মুহূর্তে মনে হলো অন্ধকার, বৃষ্টি, দুর্যোগ-কিছুই ভক্তির শেকড় ছিঁড়তে পারে না।

শাঁখারী বাজারের প্রাণচাঞ্চল্য আর সূত্রাপুরের নিস্তব্ধ আঁধার- দুটি দৃশ্য একসূত্রে বাঁধা। দুর্গোৎসব এখানে শুধু প্রতিমার সৌন্দর্য নয়, এটি ভক্তির দীপ্তি, আশ্রয়ের উষ্ণতা আর মানবিকতার উৎসব। দেবী যেন প্রতিমার ভেতরেই সীমাবদ্ধ নন। তিনি ছড়িয়ে আছেন বৃষ্টিভেজা রাতের প্রতিটি আলোয়, প্রতিটি হাসিতে, প্রতিটি আশ্রয়ে।