ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:৪৩:৪৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

জন্মনিরোধ যৌথ দায়িত্ব সামলাচ্ছে নারী একা

নিজস্ব প্রতিবেদক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:২৭ এএম, ৩ অক্টোবর ২০২৫ শুক্রবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

গর্ভনিরোধের দায় যেন নারীর একার। কারণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর ৯১ শতাংশ এখনও নারী। গত ৫০ বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে পুরুষের অংশগ্রহণ বেড়ে মাত্র ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২-২৩ অনুসারে, জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছে। ইচ্ছা থাকলেও ১০ শতাংশ দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারছেন না। জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ সংকট, কোথায় পাওয়া যায়– তা না জানা এর বড় কারণ।

সব ওষুধের মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। ফলে ব্যবহারকারীর স্বস্তির পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রায় পুরোটা নারীরা ব্যবহার করে বলে এই ঝুঁকি তাদেরই বেশি নিতে হচ্ছে।

এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব এখনও নারীর কাঁধে। পরিবার পরিকল্পনায় নারীরা একা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, পদ্ধতি গ্রহণ করছেন এবং শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া সহ্য করছেন। অথচ জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি যৌথ দায়িত্ব, যা স্বামী-স্ত্রী দুজনের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই হতে পারে না।

চাহিদার মাত্র ৩৭ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরকার থেকে দেওয়া হয়। ৬০ শতাংশ বেসরকারি এবং বাকি ৩ শতাংশ এনজিওগুলো সরবরাহ করে থাকে। এই বাস্তবতায় আজ ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস পালিত হচ্ছে। ‘পরিকল্পিত পরিবার, সুস্থ সমাজ’– এই স্লোগানে ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে পুরুষের অনাগ্রহের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরুষদের মধ্যে এ নিয়ে ভুল ধারণা আছে। ফলে কনডম ও এনএসভির কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকলেও তারা এটি ব্যবহার করছেন না। জন্মনিরোধের পুরো ভার তারা স্ত্রী বা জীবনসঙ্গীর ওপর চাপিয়ে দেন। 

পুরুষের অংশগ্রহণ হতাশাজনক

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) অনুসারে, ১৯৭৫ সালে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ কনডম ব্যবহার করতেন। ২০১৪-১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ শতাংশে, ২০১৭-১৮ সালে ৭ শতাংশ আর ২০২২-২৩ সালের সর্বশেষ জরিপে তা বেড়ে ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৭ শতাংশ কনডম ও ২ শতাংশ পুরুষ স্থায়ী পদ্ধতি এনএসভি (ছুরিবিহীন ভ্যাসেকটমি) ব্যবহার করেন। 

নারীর অভিজ্ঞতায় বাস্তবতা

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার হাইদনখালী গ্রামের মরিয়ম আক্তার। বয়স মাত্র ২৬। বিয়ে হয়েছে ১৬ বছর বয়সে। তার পরপরই প্রথম সন্তানের জন্ম। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। মা-খালা কেউ কিছু বলেননি। প্রথম সন্তান নেওয়ার তিন মাস পরই আবার অন্তঃসত্ত্বা হন তিনি। কিন্তু এবার গর্ভপাত হয়ে যায়। এরপর কয়েক দফা জন্মনিরোধের ইনজেকশন নেন স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে। 

মেরী স্টোপস আয়োজিত উঠান বৈঠকে মরিয়ম আক্তার বলেন, তাঁর স্বামী কখনও কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। প্রথম সন্তানের সময় হাসপাতালে যেতে চেয়েছিলাম। স্বামী যেতে দেননি। এর পর নিজের তাগিদে ইনজেকশন নিয়েছি, পিল খেয়েছি। 

শুধু মরিয়ম নন; গত বুধ ও বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে ঘুরে দেখা গেছে, গর্ভনিরোধ ব্যবস্থায় নারীর একক দায় এখানেও বড় বাস্তবতা। কেউ স্বামীর সামান্য সহযোগিতায়, কেউ একাই পদ্ধতি গ্রহণ করছেন।

পুরুষের ভুল ধারণা, নারীর কষ্ট

কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর গ্রামের লাকি রানীর (৩৩) বিয়ে হয় ২৩ বছর বয়সে। স্বামী কখনোই জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা করেননি। পিল খাওয়ার পর অনিয়মের কারণে গর্ভধারণ হয়, তিনি বুঝতেও পারেননি। ভারী কাজ করতে গিয়ে গর্ভপাত হয়ে যায়।

একই গ্রামের বিলকিস বেগম (৩৭) জানান, খাবার বড়ির সরবরাহ না থাকায় খেতে পারেননি। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভধারণ হয়েছে তাঁর। 

গবেষণার তথ্য 

বিডিএইচএসের ২০২২-২৩ সালের তথ্য বলছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্যে খাওয়ার বড়ির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি– ২৭ শতাংশ। ইনজেকশন নেন ১১ শতাংশ, কনডম ৮ শতাংশ, নারী বন্ধ্যাকরণ ৫ শতাংশ, পুরুষ বন্ধ্যাকরণ মাত্র ১ শতাংশ।

নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, আইইউডি ও ইমপ্ল্যান্ট দীর্ঘমেয়াদি অস্থায়ী ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি। আইইউডি জরায়ুতে স্থাপন করতে হয়। অন্যদিকে ইমপ্ল্যান্ট পদ্ধতিতে একটি বা দুটি নরম অতি ক্ষুদ্র ক্যাপসুল কনুইয়ের ওপরে চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ইনজেকশন হচ্ছে আরেকটি ক্লিনিক্যাল ও অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি। এটি প্রতি তিন মাস পরপর নিতে হয়। এ ছাড়া আছে খাওয়ার বড়ি। 

তিনি বলেন, আইইউডির ক্ষেত্রে প্রথম কয়েক মাস তলপেটে ব্যথা ও ফোঁটা ফোঁটা রক্তস্রাব হতে পারে। ইমপ্ল্যান্ট ও ইনজেকশনের কারণে মাসিকে পরিবর্তন, মাথাব্যথা এবং ওজন বেড়ে যেতে পারে। নারীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি খাওয়ার বড়ি গ্রহণের ফলে মাসিকের পরিমাণ কম হওয়া এবং সন্তান প্রসবের পর বুকের দুধ কম হওয়ার মতো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, তরুণ দম্পতিদের নিয়মিত কাউন্সেলিং, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রজনন স্বাস্থ্য-শিক্ষা এবং গণমাধ্যমে প্রচারণা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হতে পারে। নিরাপদ মাতৃত্ব, সুস্থ পরিবার ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জন্মনিরোধক ব্যবহারের প্রসার ঘটানো জরুরি, বিশেষ করে পুরুষের মধ্যে। 

অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বাড়ছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বিল্লাহ হোসেন বলেন, চাহিদা থাকলেও ১০ শতাংশের বেশি জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী পাচ্ছেন না জনগণ। এতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ না করার সঙ্গে অল্প বয়সে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের হার বাড়ছে। ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে অনেকে গোপনে বেসরকারি ক্লিনিকে অনিরাপদ গর্ভপাত করছেন। এতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ছে। ভবিষ্যতের জনবিস্ফোরণ ঠেকাতে এখন থেকেই সচেতনতামূলক প্রচার বাড়ানো উচিত।

বিল্লাহ হোসেন বলেন, ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীরা যত সন্তানের জন্ম দেন, তাকে মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) বলা হয়। ২০১১ সাল থেকে দেশে টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। ২০২৩ সালে টিএফআর ২ দশমিক ১ এসেছে। 

সরকারি সরবরাহে ঘাটতি, বেসরকারিতে মূল্যবৃদ্ধি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেওয়ার প্রবেশগম্যতা ও সরবরাহ– দুই ক্ষেত্রেই সমস্যা রয়েছে। চর, হাওরসহ দুর্গম অঞ্চলে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সরকারি সেবার ঘাটতি রয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী এখন বেসরকারি খাতনির্ভর হয়ে পড়েছে। বেসরকারি খাতগুলো জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে দরিদ্র ব্যক্তিরা অনেক সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনতে না পেরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। এটি জনসংখ্যার ওপর প্রভাব ফেলছে।  

ধর্মীয় ও সামাজিক নেতারাও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন

মেরী স্টোপস বাংলাদেশে কান্ট্রি ডিরেক্টর কিশওয়ার ইমদাদ বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ কেবল একটি স্বাস্থ্যগত বিষয় নয়, এটি নারীর অধিকার, মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ গঠনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ করার পাশাপাশি নারীকে তার শিক্ষা, কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের সুযোগ করে দেয়। 

কিশওয়ার ইমদাদ বলেন, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা ও মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এর পুরোটাই বলতে গেলে নারীর হাত ধরে এসেছে। তবু এখনও প্রায় ১০ শতাংশ প্রজনন বয়সী দম্পতির মধ্যে অপূর্ণ চাহিদা বিদ্যমান, যারা সন্তান না চাইলেও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন না। পাশাপাশি বাল্যবিয়ের উচ্চ হার এখনও আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।

মেরী স্টোপস বাংলাদেশের পার্টনারশিপ অ্যান্ড ফান্ডরাইজিং প্রধান মনজুন নাহার বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে পুরুষদের অংশগ্রহণ বাড়াতে দরকার সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, দম্পতি পর্যায়ে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ এবং পদ্ধতির বিষয়ে পরিষ্কার ও প্রমাণভিত্তিক তথ্যপ্রবাহ। গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক নেতারাও এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রামের (সিসিএসডিপি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম অনেক দূর এগোলেও তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনও জন্মনিরোধক-সম্পর্কিত সঠিক তথ্য ও পরামর্শ থেকে বঞ্চিত। ফলে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ বাড়ছে, যা মাতৃস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও সামাজিক বাধা কাটিয়ে উঠতে হবে। ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে স্থানীয় ধর্মীয় নেতা, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সেবাগ্রহীতা পরিবারগুলোকে সচেতনতার কাজে যুক্ত করতে হবে। 

রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, কোনো দম্পতি স্থায়ী পদ্ধতি নিতে চাইলে তা স্বামী নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। কেননা, নারীদের স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয় পেট কেটে। অন্যদিকে, পুরুষের এ পদ্ধতি গ্রহণ অনেক সহজ। অনেকেই ভাবেন, পুরুষরা স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করলে পুরুষত্ব হারাবেন। এটা একদম ঠিক নয়।