ঢাকাবাসীর জন্য খালি পায়ে হাঁটার ব্যবস্থা করল বোটানিক্যাল গার্ডেন
নিজস্ব প্রতিবেদক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১০:০৯ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০২৫ শুক্রবার
ছবি: সংগৃহীত
একটু মনে করে দেখুন তো, ঢাকা শহরে শেষ কবে খালি পায়ে মাটিতে হেঁটেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তর হয়তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই শহরে এমন সুযোগ তো নেই বললেই চলে।
সেই সুযোগটাই সম্প্রতি নগরবাসীকে করে দিয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন। মিরপুরে ২০৮ একরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে আছে দৃষ্টিনন্দন গোলাপবাগান, বাঁশবাগান, লেক, পদ্মপুকুর, শাপলাপুকুর, মৌসুমি ফুলের বাগানসহ দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ আর বিচিত্র সব পাখপাখালি। সেখানেই নতুন করে যোগ হলো খালি পায়ে হাঁটার রাস্তা। ৬ ফুট প্রস্থ আর ৩৯০ ফুট দীর্ঘ এই রাস্তার রয়েছে কয়েকটি ধাপ। বালু, গাছের গুঁড়ি, নুড়িপাথর, দোআঁশ মাটি, পানি আর পানিতে ডোবা কাদামাটির পথ।
দুপাশে ইটের গাঁথুনিতে রাস্তা বাঁধা, তারপরে বাঁশের খুঁটি দিয়ে বেড়া দেওয়া আছে। ট্রেইলটির শুরুতেই দুটি সাইনবোর্ড। একটিতে লেখা খালি পায়ে হাঁটার উপকারিতা, অন্যটিতে নিয়মাবলি ও সতর্কতা।
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও বলধা গার্ডেনের পরিচালক শওকত ইমরানের উদ্যোগেই এই খালি পায়ে মাটিতে হাঁটার ট্রেইল। ‘ঢাকা মহানগরীতে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ নেই বললেই চলে। প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি সংযোগের একটা উপায় খালি পায়ে মাটিতে হাঁটা। ঢাকা শহরে এমন হাঁটার সুযোগ তেমন নেই বলে মানুষ কখনোই ইচ্ছা করে নিজ থেকে খালি পায়ে হাঁটতে যায় না। ফলে মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দূরত্ব বাড়ছে দিন দিন। প্রকৃতির সঙ্গে নগরবাসীর সরাসরি সংযোগ ঘটাতেই আমাদের এই খালি পায়ে হাঁটার আয়োজন। এই বেয়ারফুট ট্রেইল প্রতিদিনই ভোর ৬টা থেকে খোলা থাকে। ট্রেইলটি বিশেষ করে মর্নিংওয়াকে আসা মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।’
১০ নভেম্বর সকালবেলা আমরাও সেই রাস্তায় হাঁটতে গিয়েছিলাম। গাছের ফাঁক গলে গায়ে এসে পড়ছে সকালের মিষ্টি রোদ, গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির, চিড়িয়াখানা থেকে ভেসে আসছে হাতির ডাক! এমন করে পথ চলতে চলতে একসময় হাজির হই সেই খালি পায়ে হাঁটার রাস্তার সামনে।
জুতা খুলে খালি পায়ে হাঁটার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিসিআইসি কলেজ থেকে আসা ফাতিন আসনাত ও ঢাকা কমার্স কলেজের নীরব হোসেন। নীরব আগে অনেকবার হাঁটলেও এই প্রথম ট্রেইলে পা রাখছেন ফাতিন। প্রশ্ন রাখি, এখানে কেন হাঁটতে এসেছেন? উত্তরে নীরব বলেন, ‘ঢাকা শহরে সাধারণত খালি পায়ে কেউ হাঁটতে চায় না। সেই রকম খেয়ালও আসে না যে আমাদের খালি পায়ে হাঁটা উচিত। এ ক্ষেত্রে এটা একটা ইউনিক উদ্যোগ। মাটি, বালু, গাছের গুঁড়ি, নুড়িপাথর বিছানো এই রাস্তার কিছু অংশ আবার পানি আর কাদামাটিতে ঢাকা। গ্রামের কাঁচা রাস্তা আসলে কেমন উঁচু-নিচু হয়, তা এখানে হাঁটলে ফিল করা যায়।’
ফাতিন, নীরবের পরেই খালি পায়ে এসে উপস্থিত হন লেদার প্রকৌশলী জুনায়েদ হোসেন। তিনি জানালেন, শুক্রবারের ছুটির দিনে এখানে কম করে হলেও পাঁচ হাজার মানুষের বিচরণ থাকে। দেখলে মনে হয় যেন মিছিল নেমেছে! স্মৃতি হাতড়ে বললেন ছোটবেলার কথা, ‘ছোটবেলায় যখন পড়ালেখা করতে চাইতাম না, বাবা তখন ফসলের মাঠে নিয়ে এমন কাদামাটির মধ্যে নামিয়ে দিতেন। এখানে হাঁটতে এলে সেই দিনের কথা মনে পড়ে।’
খালি পায়ে হাঁটার উপকারিতা
খালি পায়ে হাঁটার অনেক সুফল। খালি পায়ে হাঁটা শুধু হাঁটাই নয়, প্রকৃতির সঙ্গে এক নিবিড় সংযোগ। এতে পায়ের তলার স্নায়ুপ্রান্তে হালকা চাপ পড়ে, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি একধরনের প্রাকৃতিক আকুপ্রেশার থেরাপির মতো কাজ করে। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, মানসিক চাপ কমে এবং শরীর থাকে সক্রিয় ও সতেজ। পায়ের কিছু স্নায়ু চোখের সঙ্গেও যুক্ত, তাই নিয়মিত খালি পায়ে হাঁটা দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মাটির সংস্পর্শে এলে দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়ে। ‘আর্থিং’ বা ‘গ্রাউন্ডিং’ প্রক্রিয়ায় শরীর ভূপৃষ্ঠ থেকে ইলেকট্রন শোষণ করে, যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
এ ছাড়া খালি পায়ে হাঁটলে পায়ের পেশি শক্তিশালী হয়, বজায় থাকে শরীরের ভারসাম্য। প্রকৃতির সান্নিধ্যে হাঁটলে মন যেমন আনন্দে ভরে ওঠে, মনোযোগ ও আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। শিশু থেকে বয়স্ক—সবার জন্য এটা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। এমনকি একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গল্প-কথায় বন্ধুত্ব ও সামাজিক সম্পর্কটাও গভীর হয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে খালি পায়ে হাঁটার নিয়মাবলি ও সতর্কতা
* জুতা ও স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে মূল ট্রেইলে প্রবেশ করুন।
* এক প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করুন।
* হাঁটার সময় যদি ব্যথা বা অস্বস্তি বোধ করেন তাহলে থামুন। হাঁটার মধ্যে বিরতি দিন।
* ঘুরে ঘুরে ১৫ থেকে ২০ মিনিট হাঁটার পরিকল্পনা রাখুন।
* পা ফেলতে প্রতিটি পদক্ষেপে বালু, নুড়িপাথর, গাছের গুঁড়ি, মাটি ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
* হাঁটার সময় পায়ের সামনের অংশ প্রথমে মাটিতে রাখুন।
* বড় বড় পদক্ষেপের চেয়ে ছোট ও নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ ফেলুন।
* প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন, মাটির স্পর্শ অনুভব করুন।
* হাঁটার পর পায়ে ছোটখাটো কাঁটা, আঁচড় বা ফোসকা পড়েছে কি না, পরীক্ষা করে দেখুন।
* হাঁটা শেষে হাতের বাঁয়ে কয়েক কদম এগোলেই পানির ব্যবস্থা পাবেন। তাতে কাদামাখা পা ধুয়ে নিতে পারবেন।
* ডায়াবেটিস বা পায়ে কোনো সমস্যা থাকলে খালি পায়ে হাঁটার আগে চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিন।
যেভাবে যাবেন
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের প্রধান ফটকের বাঁয়ের কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে হবে। জনপ্রতি টিকিটের মূল্য ৩০ টাকা। ১২ বছরের কম বয়সীদের ১৫ টাকা। প্রবেশ করলে একটা গোলাপবাগান পড়বে। এই বাগান ছাড়িয়ে সামনে হাঁটতে থাকলে মিনিট কতক পরে মিলবে দ্বিতীয় আরেকটি গোলাপবাগান। সেখানে টকটকে লাল গোলাপ হাতে স্বাগত জানাচ্ছে একটি ভাস্কর্য। এখানে চারটি রাস্তার মোড় আছে। ডানে আছে ম্যাপ। সেই ম্যাপ অনুযায়ী হাতের ডান দিকে ‘যাত্রাবাড়ী’ স্পটের দিকে হাঁটলেই পেয়ে যাবেন খালি পায়ে হাঁটার রাস্তা।
