ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ১০:১৪:৩১ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

বাল্যবিয়ে: নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে 

নিজস্ব প্রতিবেদক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:২৭ পিএম, ৩০ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় নেত্রকোণার দোলেনাকে বিয়ে দেয় বাবা-মা। বিয়ের পর তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বিয়ের পর থেকেই স্বামী আর তার পরিবারের অত্যাচার দোলেনার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। একসময় বাধ্য হয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে সে। সঙ্গে নিয়ে আসে এক সন্তান। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই তার। 

দোলেন বলে, ‘আমারে না হয় স্বামী তালাক দিছে, কিন্তু তার সন্তানের খোরপোষ তো দিবো, তাও দেয় না। ঘর-সংসার করতে পারলাম না। সমাজ ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও আমার কোনো মর্যাদা নাই’ স্বামীর নামে মামলা করেছি, দেখি কি হয়!, - কথাগুলো বলতে বলতে দোলেনা থেমে যায়, চোখ মোছে।

রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭: প্রয়োগ ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায়  যোগ দিতে আসা দোলেনা এভাবেই তার জীবনযুদ্ধের কথা শোনায়।
 
নানা কারণ দেখিয়ে প্রাপ্ত বয়স হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দিতে সমাজের অনেকে তৎপর হন। কিন্তু বাল্যবিয়ের কুফল তাদের যাপিত জীবনের যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। এমন উদাহরণ মেলে দোলেনার মতো স্বপ্না আক্তার, চুমকি আক্তার, রেখা মুমু ও আরো অনেক মেয়ের জীবন যন্ত্রণার গল্পে। 

অন্যদিকে দেখা যায়, কম সংখ্যক হলেও কিছু স্কুলগামী বালিকা বন্ধু-বান্ধব ও এলাকার কারো সাহায্য নিয়ে বাল্যবিয়ে ঠেকাতে পারছে। যেমন দিনাজপুরের প্রীতি রহমান। 

বিয়েতে দোলেনার আপত্তি পরিবার ও সমাজ শোনেনি তবে দিনাজপুরের প্রীতির অনঢ় আপত্তির কাছে হার মেনেছে পরিবার ও পাড়া প্রতিবেশী। প্রীতিকেও স্কুলে পড়া অবস্থায় জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে প্রীতি কিছুতেই রাজি হয়নি। বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী আর স্থানীয় বেসরকারি সংগঠনের প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা দিতে পারেনি প্রীতির অভিভাবকরা। ছোট বয়সে বিয়ে না দিয়ে মেয়েকে লেখাপড়া করানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রীতির মা-বাবা। তবে এর জন্য কম কথা শুনতে হয়নি তার পরিবারকে। 
উচ্ছল প্রীতি জানায়, ‘এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আরো লেখাপড়া করতে চাই। আমার অভিভাবকের মতো অন্যদেরও বোঝা উচিত, বাল্যবিয়ে না দিয়ে মেয়েকে লেখাপড়া করানো জরুরী।’ 

আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট আয়োজিত এক আলোচনা সভায় যোগ দিতে আসা দোলেনা ও প্রীতির সাথে কথা হয়। তারা মনে করে, মেয়েদের লেখাপড়া করার সুযোগ ও নিরাপত্তা দিলে বাল্যবিয়ে বন্ধ হবে। বাল্য বিয়ের খারাপ দিকগুলো বেশি করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে জানাতে হবে বার বার। 

বাল্যবিয়ের পরিস্থিতি, সমাজে বাল্যবিয়ের গ্রহণযোগ্যতা, বিদ্যমান আইন ও এর প্রায়োগিকতা নিয়ে এই আলোচনায় আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটে’র চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল বলেন, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ নারীর নিরাপত্তাহীনতা, নির্যাতন ও অধঃস্তন অবস্থার জন্য যতটা বিব্রত, কিন্তু এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে ততটা সোচ্চার নয়। তাই দেখা যায়  নারীকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর পক্ষে কোনো কোনো গোষ্ঠীর মতামত প্রচার করার পরও দায়িত্বশীলরা চুপ থাকে, সমাজও তেমন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয় না। 

তিনি আরো বলেন, একদিকে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের পাশাপাশি নানাদিকে এগুচ্ছে, অন্যদিকে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ছোট বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে তাদের আবার একটি অনিরাপদ জায়গায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে তাকে লেখাপড়া করার সুযোগ দিতে হবে। বাল্যবিয়ে দেয়ার কারণে নারীর অগ্রযাত্রা বাধা পাচ্ছে। 

সুলতানা কামাল বলেন, দেশে অনেক বড় বড় উন্নয়ন হচ্ছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নত দেশের পথে হাঁটছে দেশ। কিন্তু নারী নির্যাতন কমছে না। তবে অসামঞ্জস্য উন্নয়ন ক্যানসারের মত। এই আর্থিক উন্নয়নে আমরা ধনী হচ্ছি কিন্তু সভ্য হচ্ছি কিনা সে প্রশ্ন আসে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে নারীর প্রতি সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, মনোভঙ্গিও বদলাতে হবে। 

বাল্যবিয়ের কুফল প্রসঙ্গে প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. হালিদা হানুম আকতার দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, বাল্যবিয়ের কারণে একজন নারী শারীরিকভাবে নানামুখী ক্ষতির সম্মুখীন হয়, এর প্রভাব পড়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে। তাই বাল্যবিয়ের কুফলগুলো সবারই জানা দরকার। 

তিনি বলেন, স্কুল পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সর্ম্পকে জানানো উচিত। তাহলে নিজেরাই সচেতন হবে। যদিও স্বাস্থ্য বিষয়ে অনেক কার্যক্রম আছে, অনেক ক্ষেত্রে সফলতাও এসেছে। তারপরও এ সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো প্রয়োজন।  

বাংলাদেশ পুলিশ ওমেন নেটওয়ার্ক’র যুগ্ম সম্পাদক পুলিশ সুপার শেহেলা পারভীন বলেন, ১৬ বছর আগে যখন পুলিশে যোগ দিই, বিভাগটিতে নারীদের সংখ্যা ছিল এক শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে সাত শতাংশ। বিশেষ করে নারীদের সুবিধার্থে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ ওমেন নেটওয়ার্ক। যা নারীদের সহায়তা পেতে অবদান রাখছে। 

তিনি বলেন, এদেশে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে নারীরা অনেক বাঁধার মুখে পড়ে। নির্যাতনের শিকার নারীরা মূলত নারী পুলিশের কাছেই মামলা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অনেক অসহায় নির্যাতিতা সাহায্য চাইতে আসে। 

তিনি আরো বলেন, কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দারিদ্রতা বা নিরাপত্তার অভাবই বাল্যবিয়ের একমাত্র কারণ নয়, যৌতুকও  বাল্যবিয়ের একটি অন্যতম কারণ। এক হিসাবে দেখা যায়, গত চার বছরে যৌতুকের জন্য নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে।

বাল্যবিয়ে ও আইন প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের চিফ ম্যাজিস্ট্রেট সারাফুজ্জামান আনছারী কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন। যেমন- বাল্যবিবাহে শরীয়াহ আইন মোতাবেক বিয়েটা অবৈধ নয়, কিন্তু আইন অনুযায়ী বাল্যবিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক সমস্যা, নতুন আইনে উক্ত সমস্যাটি সামাজিকভাবেই মোকাবেলার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বাল্যবিবাহ আইনের বিশেষ ধারায় আদালতের অনুমতি স্বাপেক্ষে বিয়ের কথা বলা হয়েছে, তবে আদালত অনুমতি দেয়ার আগে যাচাই কমিটির মতামত নিবেন। এই যাচাই কমিটি সমাজের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত। কোন এলাকায় বাল্যবিবাহ সংঘটিত হলে সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তাগণকে বাল্যবিবাহ বন্ধের ক্ষমতা দেওয়া আছে। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বাল্যবিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। 

তিনি আরো জানান, বাল্যবিয়ে বন্ধের ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্টকেও জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া আছে। এছাড়াও পুলিশ বাল্যবিয়ে বিষয়ক যেকোন মামলা নথিভুক্ত করতে বাধ্য। 

আমরাই পারি জোটের নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক বলেন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন নিয়ে আমরাই পারি জোট দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। আইন পাসের পর গত বছর আইনের বিধিমালা ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। সরকার বলছে  বাল্যবিবাহ আইন পাসের পর আর বাল্যবিয়ে হচ্ছে না। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের তথ্য উপাত্ত ও আমরাই পারির গবেষণায় প্রচুর বাল্যবিয়ের ঘটনা উঠে আসে। 

আলোচনা সভায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নিকাহ রেজিস্টার, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আইনজীবীরা বাল্যবিয়ের কারণগুলি তুলে ধরেন। এর মধ্যে নকল জন্ম নিবন্ধন ও এর ফটোকপি, মৌলভি দিয়ে বিয়ে পড়ানো, লুকিয়ে বিয়ে দেয়া যা আবার রেজিষ্ট্রি না করা অন্যতম কারণ। এছাড়াও এফিডেভিট করা এবং রাজনৈতিক ও সমাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার থাকার কারণে অনেক জায়গায় বাল্য বিয়ে হচ্ছে। 

সভায় বাল্যবিবাহ আইন, বিধিমালা এবং জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সমন্বিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আমরাই পারি জোটে’র জাতীয় কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোটের্র আইনজীবী ফরিদা ইয়াসমীন। 

তিনি প্রবন্ধে জানান, বাংলাদেশ সরকারের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ-২০১৪ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ আ্যন্ড ট্রেনিং এর মতে সরকারি হিসাবে দেশে বাল্য বিয়ের হার (১৮ বছরের কম বয়সী) ৫৯ শতাংশ। ইউনিসেফের মতে বাল্যবিয়ের শতকরা হারে  বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ (৭ মার্চ ২০১৮, দৈনিক প্রথম আলো)।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এবং প্রণয়নের প্রেক্ষিত প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, বাল্যবিয়ের সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে বাল্যবিয়ে মুক্ত করার অঙ্গীকার পূরণে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাল্য বিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭ পাশ করে। বিলটি রাষ্টপতি  স্বাক্ষর  করার পর ১১ মার্চ ২০১৭  এটি আইনে পরিণত হয় বিশেষ বিধানসহ। এর ১৯ ধারায় বিশেষ বিধানের প্রেক্ষপটে আদালতের নির্দেশে এবং অভিভাবকের সম্মতিতে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বিয়ের সুযোগ রয়েছে। আমরাই পারিসহ অনেক এনজিও এবং সিভিল সোসাইটি বিশেষ বিধানের বিরোধিতা করার পরও সরকার বিশেষ বিধানসহ আইনটি অনুমোদন দেয়।
 
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭ তে বলা আছে, 
* বিবাহের ক্ষেত্রে ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’ ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো নারী। 

*বিবাহের ক্ষেত্রে ‘প্রাপ্ত বয়স্ক’ ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোনো নারী।

১৯ ধারা অনুযায়ী ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছই থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্ক  ও সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ ও পিতা-মাতা বা প্রযোর্জ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হলে তা এই আইনের  অধীনে অপরাধ বলে গণ্য হবে না। 

ফরিদা ইয়াসমীন প্রবন্ধে বাল্য বিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭’র কয়েকটি ইতিবাচক সংযোজন এবং বাল্য বিবাহ নিরোধকল্পে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০৩০ এর কর্মসূচিগুলোও বর্ণনা করেন।