ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ২০:৩১:৩১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

পরিবার কাকে বলে জানাতে হবে সন্তানকে

মনিজা রহমান

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:২২ এএম, ১ জুন ২০১৯ শনিবার

মনিজা রহমান

মনিজা রহমান

একটা শিশুর জীবনে পরিবারের ভূমিকা অশেষ। কিন্তু এই সম্পর্কে কতখানি সচেতন থাকে একজন বাঙ্গালী শিশু। যদি তাকে প্রশ্ন করা হয়, তোমার জীবনে পরিবার কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। সে হয়তো কিছুই বলতে পারবে না। পরিবার কি তার মানেই সে জানে না। কিন্তু আমেরিকায় অন্যান্য পরিবারে শিশুকে শৈশব থেকে বোঝানো হয়, এই তার পরিবার। বাবা-মা, ভাই-বোন কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর জীবনে। আর বাঙ্গালী শিশু পরিবার শব্দটাই বুঝতে পারে না। কিংবা তাকে বোঝানো হয় না। সে হয়ত জানেনা, বয়সে ছোট হলেও একটা সংসারে তার অবস্থানেরও গুরুত্ব আছে। যে কোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তার মতামত নেয়াটাও খুব জরুরী। যেমন আপনি বাসা পরিবর্তন করে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকাতে যাচ্ছেন। কিন্তু এই ব্যাপারে কখনও কি সন্তানের মতামত জানতে চেয়েছেন ?

এক বাঙ্গালী দম্পতির গল্প বলি। তারা এদেশে পড়াশুনা করতে আসে। পড়াশুনা শেষ করার পরে স্বামী দেশে ফিরে যেতে চায়। কারণ সেখানে তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি ও ব্যবসা বাণিজ্য রক্ষা করতে হবে। স্ত্রী চাইছে এই দেশে থেকে যেতে। কারণ সে চায় নিরাপদ জীবন। এই নিয়ে দ্বন্দ্বের ফল হল, স্বামী চলে গেলে দেশে। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে থেকে গেলেন। তখন স্বামীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এভাবে বিচ্ছেদের কারণে সন্তানরা মানসিক ভাবে আঘাত পেতে পারে। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এটা আমাদের মধ্যে হয় না। কালোদের মধ্যে হয়। অথচ ১২ বছর পরে তার মেয়েকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সেখানে দেখা যায় তার সারা হাতে কাটা দাগ। এত বছর ধরে ছুরি দিয়ে হাত কেটেছে সে।

পুরো আমেরিকায় প্রতি বছর চার মিলিয়ন শিশু পারিবারিক বিপর্যয়ের শিকার হয়। এই তালিকায় সাদারা এগিয়ে আছে। এমন নয় যে অন্য বর্ণের শিশুরা এই বিপর্যয়ের বাইরে। আসল সত্য হল, সাদাদের ক্ষেত্রে যতখানি রিপোর্ট হয়, অন্যদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। এশিয়ানদের মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা বেশীরভাগ সময় লুকিয়ে রাখা হয়। বাঙ্গালীদের মধ্যে এই চর্চা আরো বেশী।

কোন পরিবারে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে পুলিশ এসে প্রথমে যাকে জিজ্ঞাসা করে, সে হল শিশু। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কে পরিবারে অশান্তি তৈরী করছে ? শিশুটি যদি বাবার নাম বলে, তবে বাবাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হবে, এই ভয়ে বেশীরভাগ পরিবারে স্ত্রী এই ঘটনা পুলিশকে জানায় না। কারণ সে ভাবে স্বামীকে বাসা থেকে বের করে দিলে সংসার কিভাবে চলবে, বাসা ভাড়া কে দেবে ? রাষ্ট্র যে তার জন্য বিভিন্নভাবে সহায়তা দিতে প্রস্তুত, এই খবর সে রাখে না।

কালো পুরুষরা এদেশে তুলনামূলকভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়। তারা গান শুনে। নেচে বেড়ায়। পুলিশী নির্যাতনের স্বীকার হয় তারা নানাভাবে। এক হিসেবে জানা গেছে আমেরিকার ৫২ ভাগ কালো মানুষ জীবনে কোন না কোন সময় জেলে গিয়েছে। অনেক কালো পরিবারে ব্যাগ গোছানো থাকে, বাবাকে যে কোন সময় জেলে যেতে হতে পারে এজন্য। মা তখন পরিবারের হাল ধরে। সে নিজে আয় না করতে পারলে, ফুডস্ট্যাম্পের সাহায্যে খাবার নেয়। ওয়েলফেয়ার ফ্ল্যাট নেয়। এভাবে লড়াই করে চলে তাদের জীবন। ওই পরিবারে একটি শিশু নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে বড় হয়। আবার সে একদিন কোন অপরাধ করে জেলে যায়।

একটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়ার চার পর্যায় থাকে। প্রথমে টেনশন বিল্ডিং। পরিস্থিতি যখন থমথমে। তখন শিশুটি হয়তো বাসার কিচেন কিংবা বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। তারপর হল এক্সপ্লোড করা। যখন বাবা-মা দুজনে চিৎকার করে নিজেদের দোষারোপ করতে থাকে। ওই সময় শিশুটি কিচেন বা বাথরুমে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে কিংবা ভয়ে কাঁপতে থাকে। এক সময় পরিস্থিতি কুলডাউন হয়। এটা তৃতীয় স্তর। সবার শেষে আসে হানিমুন স্টেজ। স্বামী হয়ত স্ত্রীর জন্য ফুল নিয়ে আসে। স্ত্রী স্বামীর পছন্দের খাবার তৈরী করে। কিন্তু ওই শিশুটির মনে পুরো ঘটনার ছাপ রয়ে যায়। যেটা সে আজীবন বয়ে বেড়ায়। ক্রমে তার মধ্যে ডিপ্রেশন, আত্নবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা যায়।

পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা একটি শিশুকে তিনভাবে প্রভাবিত করে। প্রথমত ইমোশোনাল রিএ্যাকশন। শিশুটির মধ্যে অপরাধবোধের জন্ম হয়। ওর মনে হয় সব আমারই দোষ। আমার কারণেই এসব হচ্ছে। কারণ সে বাবা-মা উভয়কে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসে। তাই দুজনের সমস্যার দায়ভার সে একা নিতে চায়। এরফলে তার মধ্যে এক ধরনের মানসিক দুর্বলতা তৈরী হয়। দ্বিতীয়ত বডি রেসপন্স। এই ধাপে শিশুর মধ্যে শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যেমন জ্বর, বমি, ফোকাস প্রবলেম হতে পারে, রাতে কম ঘুম। এটা বাবা-মাকে লক্ষ্য করতে হবে। বিশেষ করে একজন মা যেভাবে তার সন্তানকে বুঝতে পারে, আর কেউ সেভাবে পারে না। অনেক বাবা-মা হয়ত ঠিক করে, সন্তান ঘুমিয়ে পড়লে তারা এই বিষয়টা নিয়ে ঝগড়া করবে। এটা জানার পরে ওই সন্তানের হয়ত সারা রাত টেনশনে ঘুম আসেনা। কারণ সে দুশ্চিন্তা করতে পারে, তার বাবা যদি মাকে মেরে ফেলে। তৃতীয়ত হল, বিহেভিয়ার রেসপন্স। এটা শিশুর পারফরমেন্সে প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে।

পাশ্চাত্যে পরিবার দিবস, বাবা দিবস, মা দিবস খুব ঘটা করে পালন করা হয়। অনেকেই বলেন, এসব লৌকিকতার কারণ কি ? বাবা-মা তো প্রতিদিনেরই। একটা বিশেষ দিনে মনে করার কোন দরকার কি আছে ? এটা আর কিছু নয় পরিবার সম্পর্কে সচেতনাবোধ। পরিবারের কাছে ফিরে যাবার বাসনা।

ছেলেমেয়েকে বাবা-মা দুজন যে পরিবার থেকে এসেছে, তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে জানাতে হবে। দাদা-দাদী, নানা-নানী, চাচা, খালা, ফুফু, মামা প্রত্যেকের নাম মুখস্ত করাতে হবে। এমনকি চাচাতো-ফুফাতো-খালাতো-মামাতো ভাই-বোনদের নাম। প্রত্যেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতে হবে। এতে করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দায়িত্ববোধ জন্ম নেবে। তারা যৌথ পরিবারের মানুষ হিসেবে অনেক বেশী দায়িত্বশীল হবে ও নিজেদের মধ্যে আত্নবিশ্বাস বোধ করবে।

৥ মনিজা রহমান

২৭ মে, ২০১৯

ইস্ট রিভারের তীর থেকে, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র