ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৪:১০:১৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

দূর্গা’র গল্প : নিবেদিতা রায়

নিবেদিতা রায়

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৪৯ এএম, ৪ অক্টোবর ২০১৯ শুক্রবার

সে বছর বন্যার জলে ভেসে গিয়েছিল খেতের ফসল, বসত ভিটার দূর্বল খুঁটির চালার ঘর। প্রায় এক মাস যখন বন্যার জল নামছিল না রথিন বাবুদের পরিবারের ছয় সদস্য আর গরু-বাছুর নিয়ে একটা ঘরের চকির উপরেই কাটিয়ে দিতে হয়েছে ওদের। এমন সময় বৌটা হলো পোয়াতি। সেই জল-বর্ষার মধ্যে নিজেদের চলাফেরা করতেই কষ্ট তারমধ্যে অভাবের অকুল পাথারে বৌ এর যত্ন আত্তি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

তারপরে জল নেমে গেল, শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর কাশ বনের নরম সাদা ফুলের আকাশ ছোঁয়া স্নিগ্ধতা বন্যার জলে ধুঁয়ে দিয়েছিল রথিনদের সব দু:খ। সে বছর শারদীয়ার আগমনিতে মা দূর্গা এলো নৌকায় চড়ে মর্তে। অষ্টমীর সকালে কুমারি পুজোর লগ্নে রথিন আর সুলেখার ঘরে আলো করে এক কন্যা জন্ম নিল। মন্ডপের ঢাক আর কাসেঁর শব্দে নবজাতিকার প্রথম কান্না মিলিয়ে গিয়েছিলো। বাবা-মা এই শুভ লগ্নের জাতিকার নাম রেখেছিল ‘দূর্গা’। পরশিরা কেউ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসেছিল, টিপ্পনি কেটে বলেছিল, আবারো মেয়ে হয়েছে তবু আনন্দের শেষ নেই। কেউ বলেছিল বাহ তোদের ঘরে মা দুগ্গা এসেছে লো আর চিন্তার কিছু নাই। বছরকার দিনে পুজোর কাজ, অঞ্জলি আয়োজনের অজুহাতে সবাই দূরে দাঁড়িয়েই আশীর্বাদ করে চলে গিয়েছিল। নতুন বাচ্চা ধরতে গেলে যে শুভাশুচ লেগে যাবে, আবার স্নান সেরে পুজোর দিনে কাজকর্মে হাত দিতে এ পাড়ার পড়শিদের সময় আর মন লাগে না। সুলেখার আরো দুই মেয়ে গঙ্গা আর যমুনা দেখতে তেমন সুন্দর নয়, লেখাপড়াতেও মন নেই এসব চিন্তায় চিন্তায় বৃদ্ধ ঠাকুরমা সারাদিন বৌ মাকে দোষারোপ করে। বাড়িতে থাকলে এই নিয়ে সারাক্ষন অশান্তি লেগেই থাকে তাই পুজোর কয়েকদিন উত্তর পাড়ার পুজো মন্ডপেই পরে আছে দুই বোন। কোথা থেকে খবর পেয়ে প্রায় উড়তে উড়তে বোনেরা বাড়ি এসেছিল, নবজাতিকাকে দেখে বলেছিল, দেখ দেখ বোনটাকে কেমন মা দূর্গার মতো দেখতে লাগছে। সেই থেকে আজ অবধি বড় দুই বোন দূর্গাকে প্রায় চোখে হারায়।     

কুড়ি বছর পরে-
রথিনের সংসারে শ্রী ফিরেছে। সরকার থেকে স্কুলের বেতন বাড়িয়েছে। কিছু টিউশনি পড়িয়ে, আবাদি জমির ঘরের ভাত খেয়ে কেটে যাচ্ছিল রথিন মাষ্টারের সংসার। বড় দুটো মেয়ে গঙ্গা আর যমুনার বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে। কয়েক বছর আগে সেই গ্রামের এক ছেলেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ম নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। কয়েকদিন খুব ঠান্ডা পরিবেশ ছিল। অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল কারা যেন। সেই রকম এক রাতের অন্ধকারে একদিন দুই জামাই এসে বলেছিল, বাবা আমরা এদেশ ছেড়ে ওপারে চলে যাচ্ছি। আশির্বাদ করবেন, যেন খেয়ে পরে বাঁচতে পারি। আর একটা কথা কিছুদিন পরে আমরা দূর্গাকেও নিয়ে যাবো। মেয়েরা বলেছিল, বাবা দূর্গাকে ওদেশে বিয়ে দেবো তুমি চিন্তা করো না। পাশের ঘর থেকে দূর্গা সব শুনেছিল, তখন সে কলেজে অনার্স পরে। আরো কতো স্বপ্ন মাত্র বুনতে শিখছে। হঠাৎ ওর মনে ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করলো। এই দেশ, এই মাটি আর জন্মভূমিকে সে খুব ভালোবাসে।

দূর্গা এ বছর অনার্স ফাইনাল দেবে, ইংরেজি নিয়ে পড়ছে। আসেপাশের গ্রামের বাচ্চারা তার কাছে পড়তে আসে। দূর্গার বন্ধুদের একটি দল আছে। সেখানে তারা সাহিত্য চর্চা করে, সচেতনতামূলক কাজ করে। বর্ষা আসার আগে রাস্তাঘাট, নদীর উপরে সাঁকো কিংবা খুব শীতে গরীব শীতার্দের সাহায্যর জন্য তারা কাজ করে। প্রথম দিকটায় অনেকেই ওদের এই কাজগুলোকে বাঁকা চোখে দেখতো। মেয়ে হয়ে কেন ছেলেদের মতো পাড়া চষে বেড়ায় সে নিয়ে আপত্তির শেষ ছিল না। বাবা-মা’কে দূর্গা বোঝাতে পেরেছিল তারা অন্যায় কিছু করছে না। বরং এই দশেকে ভালোবেসে নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে অনেককিছু করবার আছে। ধীরে ধীরে গ্রামবাসীরা দূর্গা ও তার দলের উপর নিজেদের ভরসাগুলো জিম্মি করতে লাগলো। এ বছরের শরতের প্রথম থেকেই দূর্গাপুজোর আয়োজনে উঠেপড়ে লেগেছিল দূর্গার দল। প্রতীমা বায়না দেয়া, প্যান্ডেল , মঞ্চ সজ্জা কতো কাজ। এবার ওরা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে মায়ের চালচিত্র করতে চেয়েছিল। যেমনটা আধুনিক আঙ্গিকে মায়ের সাজ দেয়া হয়। সব প্রতীমা ভিন্ন ভিন্ন আসনে নির্ষ্ট দূরত্বে থাকবে। সরস্বতির হাতে বীণার বদলে গীটার, লক্ষীর শাড়িতে আধুনিক বেশ, কার্ককে বাহুবলীর সাজ ইত্যাদি বৈচিত্র্যে ভরা।

সবাই যখন নতুন নতুন চিন্তা নিয়ে খুব উচ্ছসিত সেসময় দূর্গা সবাইকে নিজের মতামত জানিয়ে দিয়ে বলল, না মায়ের প্রতিমা হবে একচালা আর চালচিত্রে একই আসনে সবার উপস্থিতি। খুব বেশি আধুনিক হতে গিয়ে আমরা নিজেদের স্বকীয়তা না হারিয়ে ফেলি। মনে রেখ আমরা মূর্কে পুজো করি না, মূর্তেতে মায়ের পুজো করি। আজকের আধুনিক পরিবারগুলো যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যেমন একক পরিবারে রূপ নিয়েছে তেমনি সমাজ-সভ্যতা নিজেদের আধুনিকতার ছাঁচে গড়তে গিয়ে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে। শহরবাসীর অনু  এবং পরমানু বাসস্থানের মতো  মা দূর্গার চালচিত্রে মায়ের পরিবারের সদস্যদের পৃথক করে দিও না। একচালা ঘরে মা দূর্গার এই পারিবারিক রূপে আছে সংসারে একসাথে থাকার আনন্দ। কারো হাতে বীণা, কারো হাতে ধান কিংবা কলা বউ এর লজ্জাবনত সাজের সমন্বয়ে সকলের সম্মিলিত জয়গান আর বৈচিত্র্যের একাত্মতা প্রচন্ড শক্তিশালী অসুরকেও বধ করতে পারে। এই একত্রিত শক্তিই পারে সকল ভয়কে জয় করতে। দূর্গার একনাগারে কথাগুলো বলে যাবার মধ্যে অদ্ভূত এক তেজ ছিল। সেদিন রাত থেকে আর কারো রাত জেগে মন্দির পাহাড়া দিতে হয়নি। উৎসবের চারটি দিন শারদীয়ার আলোর বন্যায় ভেসেছিল সবাই।

দশমী পুজোর বিসর্নের পরে রথিন বাবুর দুই জামাই এসেছিল দূর্গাকে ওদের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু ওদের ফিরতে হয়েছিল খালি হাতে। সেদিন দূর্গা বলেছিল, ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের জন্ম হয় ধর্ম নিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে সকল মুক্তিপ্রাণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা তখন বিবেচ্য ছিল না।  আজ কোন ভয়ে এই জন্মভূমি ত্যাগ করবো না। যদি মরতে হয় লড়াই করে মাথা উচুঁ করে মরবো।
ভাসানের পরে সেদিন এক নতুন দূর্গার জন্ম হয়েছিল।

আসছে শারদীয় উৎসব। মা দূর্গার কাছে একজন সনাতন ভক্তের প্রথম চাওয়াটি হয়তো থাকে ‘মা সকলের মঙ্গল করো, আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে-ভাতে।’ শারদ সকালের বাতাসে ঢাকের আওয়াজ বাজে, সেই শব্দে কী চাপাঁতলার কান্না আদৌ চাপাঁ দেওয়া যায় কিংবা অভয়নগরের ভয় দূর করা যায়! কাশের বনে বাতাস আর প্রকৃতির যে অপূর্ব বন্ধন সে রকম করে নাসিরনগরের কিংবা বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া সহিংসতাগুলোকে নির্মূল করে ধর্ম নিরপেক্ষতার আস্থার জায়গাটি ফিরিয়ে দিতে পারবে! আমাদের জানা নেই ,তবে এতোটুকু বুঝি ধর্মের বৈচিত্র্যতাকে আপন করতে না পারলে নিজেদের অর্জিত বিশ্বাসগুলো একদিন ভঙ্গুর হয়ে পরবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।