ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৮, এপ্রিল ২০২৪ ২৩:৩৭:৩২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

পুরাণ : স্পার্টার রানি সুন্দরী হেলেন

শান্তা মারিয়া

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:০৯ পিএম, ৪ অক্টোবর ২০১৯ শুক্রবার

গ্রেকো-রোমান পুরাণের অন্যতম আলোচিত চরিত্র হেলেন। তিনি সুন্দরী হেলেন, ট্রয়ের হেলেন ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত। হেলেন অফ ট্রয় নামে সমাধিক পরিচিত হলেও হেলেন ছিলেন স্পার্টার রানি। তিনি ছিলেন পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। গ্রিক ও রোমান পুরাণের সবচেয়ে আলোচিত নারী চরিত্র হেলেনের জন্ম নিয়ে বিভিন্ন কাহিনি রয়েছে। অধিকাংশ পুরাণকার তাকে দেবরাজ জিউসের সন্তান বলেছেন। তার মানে তারা বলতে চেয়েছেন হেলেনের সৌন্দর্য পার্থিব নয়, স্বর্গীয়।

একটি কাহিনিতে রয়েছে হেলেন স্পার্টার রাজা টিন্ডারিউস ও রানি লিডার সন্তান। তার অন্য ভাইবোনরা হলেন, ক্লাইটেমেনেস্ট্রা, ক্যাস্টর ও পলিডিউসিস। অন্য কাহিনিতে রয়েছে দেবরাজ জিউস বনহংসের রূপ ধরে লিডার সঙ্গে মিলিত হলে লিডা দুটি ডিম প্রসব করেন। একটি ডিম ফুটে হেলেন ও ক্লাইটেমেনেস্ট্রা ও অন্য ডিম ফুটে ক্যাস্টর ও পলিডিউসিসের জন্ম হয়।

আবার অন্য কাহিনিতে রয়েছে জিউস নেমেসিসের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তাকে ধাওয়া করেন। নেমেসিস বুনো হাঁসের রূপ ধরে যখন পালাচ্ছিলেন তখন জিউসও বুনোহাঁসের রূপে তার সঙ্গে মিলিত হন। নেমেসিস  একটি ডিম প্রসব করে তা জলাশয়ের কিনারে ফেলে দেন। এদিকে রানি লিডা তখন সেই জলাশয়ের কিনারে পা ছড়িয়ে বসে ছিলেন। সে সময় হার্মিস ডিমটি লিডার কোলে ফেলে দেন। লিডা ডিমটি প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে সিন্দুকে লুকিয়ে রাখেন। ডিম ফুটে হেলেনের জন্ম হয়।

জন্ম যেভাবেই হোক হেলেন ছিলেন অসামান্য সুন্দরী। কৈশোরে গ্রিক বীর থিসিউস তাকে অপহরণ করেন। কিন্তু ক্যাস্টর ও পলিডিউসিস নামে তার দুই যমজ ভাই  তাকে উদ্ধার করেন। সে সময় হেলেনের বয়স কত ছিল তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কোনো কাহিনিতে বলা হয়েছে সাত কোথাও দশ বছর। আবার একটি কাহিনিতে রয়েছে হেলেন তখন কিছুটা বড়ই ছিলেন। থিসিউস ও হেলেনের সন্তান হলেন ইফিজিনিয়া। তবে অধিকাংশ পুরাণে ইফিজিনিয়াকে আগামেমনন ও ক্লাইটেমেনেস্ত্রার সন্তান বলা হয়েছে।

গ্রিক পুরাণকার হেসিওড থিওগনিতে এবং প্রাচীন কয়েকজন রোমান পুরাণকার হেলেনের বাল্যকালেন বর্ণনায় বলেছেন হেলেন স্পার্টার নিয়ম অনুসারে তার ভাইদের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ ও অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন। স্পার্টা ছিল যুদ্ধবাজ নগরী। স্পার্টার নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধবিদ্যা শিখতেন। হেলেনও তাই যুদ্ধবিদ্যা শিখেছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু পরবর্তিকালে যখন পুরুষতান্ত্রিকতা আরও বেশি জেঁকে বসে, তখন নারীদের যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা বন্ধ হয়। তাই অপেক্ষাকৃত পরবর্তিকালের পুরাণকাররা হেলেনের অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে কোন কথা বলেননি।

হেলেনের যখন বিয়ের বয়স হল তখন গ্রিসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজা ও রাজকুমাররা তার পাণিপ্রার্থী হলেন। এত পাণিপ্রার্থী দেখে রাজা টিন্ডারিউস ভয় পেয়ে যান। কারণ প্রত্যাখ্যাতরা যুদ্ধ বাঁধাতে পারে বলে তার আশংকা হয়। তখন ইথাকার রাজা অডিসিউসের প্রচেষ্টায় পাণি প্রার্থীদের মধ্যে একটি চুক্তি হয় যে, হেলেন যাকেই পছন্দ করুক তারা বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নেবেন এবং কেউ হেলেনকে অপহরণ করলে সম্মিলিত ভাবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। হেলেন মাইসিনির রাজপুত্র মেনেলাউসকে পছন্দ করেন। মেনেলোউস হেলেনকে বিয়ে করে স্পার্টার রাজা হন।
বিয়ের পর হেলেন এক কন্যা সন্তানের জননী হন। তার নাম রাখা হয় হারমিওন।

এদিকে বিশ্বের সেরা সুদর্শন পুরুষ প্যারিস ছিলেন ট্রয়ের রাজপুত্র। ‘শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাপ্য’ লেখা সোনার আপেল তিনি অ্যাথেনি ও হেরাকে না দিয়ে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতিকে দিয়েছিলেন। বিনিময়ে আফ্রোদিতি তাকে কথা দিয়েছিলেন যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর ভালোবাসা লাভে তিনি সক্ষম হবেন। প্যারিস স্পার্টায় আসেন এবং মেনেলাউসের আতিথ্য গ্রহণ করেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হেলেনের প্রেমে পড়েন তিনি। হেলেনও প্যারিসের প্রেমে পড়েন। স্বামী মেনেলাউসের অনুপস্থিতিতে তিনি প্যারিসের সঙ্গে পালিয়ে চলে আসেন ট্রয় নগরীতে। নয় বছরের কন্যা হারমিওনকে ফেলেই চলে যান তিনি। হেলেন কেন প্যারিসের প্রেমে পড়লেন সেটা এক রহস্য বটে। মেনেলাউস ছিলেন বীর। তিনি অন্য কোন নারীতে আসক্তও ছিলেন না। মোটামুটি অনুগত স্বামীই ছিলেন বলা চলে। তবে তিনি ছিলেন কাঠখোট্টা গোছের। তেমন সুদর্শনও নন। পক্ষান্তরে  প্যারিস যদিও ছিলেন বিবাহিত।(প্যারিসের প্রথম স্ত্রীর নাম ইনোনি। তিনি একজন পর্বত পরী ছিলেন)। প্যারিস তেমন বীরও ছিলেন না। ট্রয় যুদ্ধে প্যারিস বীরত্বের পরিবর্তে কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছেন একাধিক বার। কিন্তু প্যারিস ছিলেন সুদর্শন। তিনি খুব ভালো বীণা বাজাতে জানতেন। সবচেয়ে বড় কথা প্যারিস ছিলেন কোমল স্বভাবের এবং ছিলেন প্রেমিক।
অবশ্য হেলেন স্বেচ্ছায় প্যারিসের সঙ্গে গৃহত্যাগ করেছিলেন কিনা তা নিয়ে পুরাণকারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

অনেক পুরাণকার বলেন, হেলেনকে বলপ্রয়োগে প্যারিস অপহরণ করে নিয়ে যান। কয়েকজন পুরাণকার বলেন হেলেন স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করেন। হোমার এ দুয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে ছিলেন। ইলিয়াড অনুযায়ী হেলেন স্বেচ্ছায় প্যারিসের সঙ্গে চলে আসেন তবে সেজন্য তিনি বহুবার আফ্রোদিতিকে দোষারোপ করেন। হোমারের মতে আফ্রোদিতির মোহমায়াতেই হেলেন প্যারিসের আহ্বানে সাড়া দেন। হেলেন ও প্যারিস স্পার্টা থেকে ক্রানাই নামে ছোট একটি দ্বীপে আসেন। সেখানে তারা মধুচন্দ্রিমা যাপন করেন। তারপর ট্রয়ে পৌঁছেন প্রেমিক যুগল।

হেলেনকে উদ্ধারের জন্য এর পরই ট্রয় যুদ্ধের কাড়ানাকাড়া বেজে ওঠে। মেনেলাউসের ভাই আগামেমননের নেতৃত্বে পুরো গ্রিসের সম্মিলিত বাহিনী ট্রয়ে হাজির হয়। প্রাচীর ঘেরা ট্রয় নগরী দখলের লড়াই চলে দশ বছর। এই দশ বছর হেলেন প্যারিসের সঙ্গে বেশ সুখেই কালযাপন করেন। তবে যুদ্ধেরে উপলক্ষ হওয়ায় ট্রয়ের জনসাধারণ হেলেনকে ঘৃণা করত। অবশ্য ট্রয়রাজ প্রায়াম ও প্যারিসের বড়ভাই হেকটর বরাবরই হেলেনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ট্রয় যুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে প্যারিসের মৃত্যু হলে প্যারিসের ছোটভাই ডাইফোবাসের সঙ্গে বিয়ে হয় হেলেনের। ট্রয়ের ধ্বংস রজনীতে ডাইফোবাস নিহত হওয়ার পর মেনেলাউসের সঙ্গে হেলেন ফিরে আসেন স্পার্টায়।

গ্রিক বীর একিলিস ছিলেন  হেলেনের প্রণয়প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি কোনোভাবেই হেলেনকে লাভে সমর্থ না হয়ে মা সাগর পরী থেটিসকে অনুরোধ করেন অন্তত একবারের জন্য হলেও হেলেনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা করতে। থেটিস স্বপ্নে একিলিসের সঙ্গে হেলেনের মিলনের ব্যবস্থা করেন। এই কারণে হেলেনের পঞ্চস্বামী হলেন থিসিউস, মেনেলাউস, প্যারিস, ডাইফোবাস ও একিলিস।

পঞ্চস্বামী শুনে অবধারিত ভাবে দ্রৌপদীর কথা মনে পড়ে। দ্রৌপদীর পাঁচজন স্বামী থাকা সত্ত্বেও যেমন তাকে ‘অসতী’ বলতে কেউ সাহসী হয়নি তেমনি হেলেনের ‘সতীত্ব’ নিয়েও কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এর ফলে বোঝা যাচ্ছে নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া পুরুষতন্ত্রের চরম কৌশল ‘সতী’ ও ‘অসতীর’ কনসেপ্ট তখনও মধ্যযুগের মতো চরম আকার ধারণ করেনি।

হেলেনের অপহরণ এবং যুদ্ধ রামায়ণের সীতা হরণের কাহিনিও মনে করিয়ে দেয় বৈকি। যদিও সীতা স্বেচ্ছায় রাবণের সঙ্গে যাননি, তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। অনিচ্ছায় গেলেও সীতাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। সতীত্বের আদর্শ কিভাবে পাল্টেছে সেটা দুই মহাকাব্য থেকে উদাহরণ দেই। বাল্মিকীর রামায়ণে আছে সীতাকে রাবণ হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন লংকায়। তাকে অশোকবনে রাখা হয়েছিল। রাবণ যখন সীতাকে হরণ করেন তখন তার হাত ধরে জোর করে টেনে রথে উঠান। কিন্তু সীতার মতো সতীর হাত পরপুরুষ(বা রাক্ষস) রাবণ ধরেছে এই বিষয়টি বাল্মিকীর সহ্য হলেও পরবর্তিকালের পুরাণকারদের মোটেই সহ্য হয়নি। তাই ‘ছায়াসীতা’ নামে এক উপাখ্যানের জন্ম হয়। এই উপাখ্যানে বলা হয় রাবণ নাকি সীতাকে কখনও লংকায় নেওয়া তো দুরের কথা চোখেই দেখেনি। সীতা হরণ হতে পারে এই আশংকায় অগ্নি আগেই রামকে সতর্ক করে দেন। তাই আসল সীতা অগ্নির কাছে গচ্ছিত ছিলেন। অগ্নির বরে এক ছায়াসীতার সৃষ্টি হয়্ সেই ছায়াসীতাকে নিয়েই রাম পঞ্চবটী বনে ছিলেন। সেখান থেকে ছায়াসীতাকেই রাবণ হরণ করেন। রাবণ বধের পর যখন সীতার প্রথম অগ্নিপরীক্ষা হয় তখন অগ্নি নিজে আসল সীতাকে নিয়ে আবির্ভূত হন আর ছায়া সীতাকে নিয়ে যান।

আশ্চর্যজনকভাবে একই রকম উপাখ্যান পাই গ্রিক মিথোলজিতেও। এখানে হলো ছায়া হেলেনের কাহিনী। হোমার লিখেছেন ট্রয় যুদ্ধের পর হেলেন ফিরে আসেন স্বামী মেনেলাউসের সঙ্গে স্পার্টায়। এবং আবার সসম্মানে রানীর আসন অধিকার করেন। কিন্তু হোমারের পরবর্তি যুগের পুরাণকারদের মনে হয এমন ‘কুলটা’ নারীর রানীর সম্মান পাওয়া ঠিক নয়। তাই তারা ‘ছায়া হেলেনের’ ইতিবৃত্ত রচনা করেন। ছায়া হেলেনের কাহিনীতে বলা হয়, প্যারিস নাকি হেলেনকে কখনও ট্রয়ে নিয়ে যেতেই পারেননি। আসল হেলেন গচ্ছিত বা আশ্রিত ছিলেন সমুদ্রের অমর মানুষ প্রতেউসের কাছে। আর এক নকল হেলেনকে প্যারিস নিয়ে যান ট্রয়ে। ট্রয়যুদ্ধের পর গ্রিকরা যখন দেশে ফিরছিলেন তখন আসল হেলেনকে ফেরত দেন প্রতেউস।  
ইউরিপিডেসের নাটক ও অন্য দুয়েকটি কাহিনিতেও বলা হয়েছে প্যারিস হেলেনেকে অপহরণ করে ট্রয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। তিনি নকল হেলেনকে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রকৃত হেলেন সমুদ্র মানব প্রতেউসের আশ্রয়ে মিশরের প্রাসাদে ছিলেন। ট্রয় যুদ্ধ শেষে প্রকৃত হেলেন মেনেলাউসের সঙ্গে স্পার্টায় ফিরে যান।

হোমারের অডিসিতে রয়েছে অডিসিউসকে খুঁজতে তার পুত্র টেলেমেকাস স্পার্টায় আসেন। সেখানে মেনেলাউসের আতিথ্য স্বীকার করেন এবং হেলেনের সঙ্গে তার দেখা হয়। টেলেমেকাস নিজের পরিচয় প্রদান করার আগেই হেলেন তাকে অডিসিউসের সঙ্গে চেহারার সাদৃশ্যের কারণে তার পুত্র বলে চিনতে পারেন। এতে বোঝা যায় হেলেন শুধু সুন্দরীই ছিলেন না তার বুদ্ধিও যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। এই ঘটনা ট্রয় যুদ্ধের প্রায় দশ বছর পর। তখনও হেলেনকে টেলেমেকাসের চোখে অতীব সুন্দরী বলে মনে হয়। স্পার্টার রাজপ্রাসাদে বসে ট্রয়যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে সবাই যখন অশ্রু বিসর্জন করেন তখন প্যারিসের ভালোবাসা স্মরণ করে হেলেনের চোখেও অশ্রু দেখা দেয়। হেলেন যথেষ্ট আন্তরিকভাবে টেলেমেকাসের পরিচর্যার জন্য দাসীদের নির্দেশ দেন বলে হোমার উল্লেখ করেছেন। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, হেলেন প্যারিসকে ভালোবেসেই গৃহত্যাগ করেছিলেন, অপহরণের শিকার হয়ে নয়। অপহরণের শিকার হলে প্যারিসকে স্মরণ করে তিনি কখনও কাঁদতেন না বরং রাগান্বিত হতেন।

হেলেনের জন্য দশ বছর ধরে যুদ্ধে অসংখ্য বীর নিহত ও ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল সেরা সুন্দরী বলা হলেও হেলেনের রূপের বর্ণনা কোনো পুরাণকারই তেমনভাবে দেননি।