ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ০:৫৬:৫৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

পুরাণ : হেরা, স্বামীর পরকীয়ায় বিরক্ত এক দেবী

শান্তা মারিয়া

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৪৩ এএম, ১৭ অক্টোবর ২০১৯ বৃহস্পতিবার

হেরা, স্বামীর পরকীয়ায় বিরক্ত এক দেবী

হেরা, স্বামীর পরকীয়ায় বিরক্ত এক দেবী

গ্রিক পুরাণে হেরা দেবতাদের রানী। রোমান পুরাণে তিনি দেবরাজ জুপিটারের স্ত্রী জুনো। হেরা একই সঙ্গে দেবরাজ জিউসের বোন ও স্ত্রী। তার বাবা ক্রোনাস ও মা রিয়া। তিনি রিয়ার প্রথম সন্তান। জন্মের পরপরই ক্রোনাস তাকে গিলে ফেলেন। কারণ ভবিষ্যতবাণী ছিল যে রিয়ার গর্ভের সন্তান দ্বারা উত্খাত হবেন ক্রোনাস। পরবর্তীতে রিয়ার কনিষ্ঠ সন্তান জিউজ বিষ প্রয়োগে ক্রোনাসকে যখন সন্তানদের উগরে দিতে বাধ্য করেন তখন পিতৃজঠর থেকে মুক্তি পান হেরা। ওস্যান এবং টেথিস নামে দুজন টাইটান তাকে লালন পালন করেন। সবচেয়ে বড় বোন ও সুন্দরী বলে জিউস তাকে বিয়ে করেন। হেরার অন্য ভাইবোনরা হলেন দিমিতির, হেস্টিয়া, পোসাইডন ও হেডিস।

হেরা ছিলেন বিবাহিত নারীদের রক্ষাকর্ত্রী। তিনি ছিলেন দেবীদের মধ্যে অন্যতম সেরা সুন্দরী। ‘শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাপ্য’ লেখা সোনার আপেলটি প্যারিস তাকে না দিয়ে আফ্রোদিতিকে দেওয়ায় ভীষণ চটে যান হেরা। আপেলটি তাকে দিলে প্যারিসকে তিনি এশিয়া ও ইউরোপের অধিপতি বানাবার প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন। তবু প্যারিস তাকে সেরা সুন্দরী মনোনীত করেননি। এজন্য প্যারিসকে তিনি কখনো ক্ষমা করতে পারেননি। ফলে ট্রয় যুদ্ধে তিনি  ট্রোজানদের ধ্বংসে সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। মূলত হেরার কারণেই ট্রয় যুদ্ধের কোনো শান্তিপূর্ণ মীমাংসা না হয়ে এমন করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে।

নরনারীর বিবাহিত জীবনের সুখশান্তি রক্ষার ভার ছির হেরার ওপর। যদিও তার নিজের বিবাহিত জীবন মোটেই সুখের ছিল না। স্বামী জিউসের একের পর এক পরকীয়া প্রেমের কারণে হেরা কখনো শান্তি পাননি। সর্বদা স্বামী ও তার প্রেমিকাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করেই তার দিন কাটতো। এ কারণেই তার চরিত্রে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা ও কূটকৌশল দেখা যায়। স্বামীর প্রেমিকা শুধু নয় তাদের সন্তানদের প্রতিও সমান ভাবে নিষ্ঠুর ছিলেন হেরা।

জিউসের সন্তান হওয়ায় হারকিউলিসকে তিনি ক্রমাগত যন্ত্রণা দিয়েছিলেন। অবশ্য মৃত্যুর পর হারকিউলিস স্বর্গে গেলে হেরা তাকে ক্ষমা করেন এবং নিজ কন্যা হিবির সঙ্গে বিয়ে দেন। হেরা জিউসের আরেক প্রেমিকা টাইটান লেটোকে প্রসব যন্ত্রণার মধ্যেও কোনো ভূখণ্ডে প্রসবের অনুমতি দেননি। আরেক প্রেমিকা আইওকে তাড়া করে নিয়ে ফিরেছিলেন মিশর পর্যন্ত। সেমেলিকে পুড়ে মরতে প্ররোচণা দিয়েছিলেনি। বনপরী ইকোর নিজস্ব কথা বলার শক্তি কেড়ে নিয়েছিলেন।

তবে জ্যাসন এবং আর্গোনটদের তিনি স্বর্ণমেষের চামড়া আনার অভিযানে অনেক সাহায্য করেছিলেন।
নিজের সন্তান হওয়া সত্বেও হেফেস্টাসকে শিশু অবস্থায় তিনি স্বর্গ থেকে ফেলে দেন। কারণ হেফেস্টাস ছিলেন খোঁড়া ও কুশ্রী। বড় হয়ে হেফেস্টাস হন সেরা কারিগর। তিনি মায়ের জন্য একটি অপূর্ব সুন্দর সোনার সিংহাসন বানিয়ে স্বর্গে পাঠিয়ে দেন। সিংহাসনটি ছিল আসলে একটি ফাঁদ। হেরা সিংহাসনে বসতেই একটি জাল এসে ঘিরে ফেলে তাকে। ফাঁদ থেকে মুক্তির কৌশল জানেন একমাত্র হেফেস্টাস। তাই তার ডাক পড়ে স্বর্গে। হেফেস্টাস স্বর্গে বসবাস করার অনুমতি চান হেরার কাছে আর চান আফ্রোদিতিকে বিয়ে করতে। হেরা পুত্রকে স্বর্গে থাকার অনুমতি দেন আর আফ্রোদিতির সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করেন।

স্বামীর অবিশ্বস্ততায় তিতবিরক্ত হলেও হেরা নিজে ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত। থেসালির রাজা ইকসায়ন জিউসের আশ্রয়ে থাকার সময় হেরার প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে মিলনের প্রস্তাব দেন। ইকসায়ন ভেবেছিলেন স্বামীর লাম্পট্যের প্রতিশোধ  স্বরূপ হেরা তার প্রস্তাবে রাজি হবেন। কিন্তু প্রচণ্ড রেগে হেরা জিউসের কাছে গিয়ে ইকসায়নের নামে অভিযোগ করেন এবং তার শাস্তি দাবি করেন।

জিউসের ওপর ক্রমাগত নজরদারি করলেও  তাকে  হেরা ভালোওবাসতেন। জিউসও সেকথা বিলক্ষণ জানতেন। হেরার ঝগড়া ঝাটিতে অতিষ্ঠ হয়ে জিউস একবার তাকে দারুণ শিক্ষা দেন। হেফেস্টাসকে দিয়ে এক কাঠের নারীমূর্তি তৈরি করান জিউজ। তার পর সেই নারীমূর্তিকে বিয়ের আয়োজন করেন। পুরোটাই ছিল ধাপ্পা। হেরা মনে করেন অন্য এক নারীকে বিয়ে করছেন জিউস। কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের আসরে ছুটে আসেন দেবরানী। হেরার কান্নাকাটি দেখে হাসতে হাসতে পুরো ঘটনা ফাঁস করেন জিউস। জিউসের ঔরসে হেরার গর্ভে জন্ম নেওয়া দেবদেবীরা হলেন রণদেবতা অ্যারেস, কলহ দেবী এরিস, যৌবনের দেবী হিবি, প্রসবের সাহায্যকারী দেবী ইলিথিয়া এবং দেবকারিগর হেফেস্টাস। তবে হেফেস্টাসের জন্ম নিয়ে মতভেদ আছে। একটি কাহিনিতে রয়েছে জিউস যেমন কোনো নারী ছাড়াই অ্যাথেনিকে জন্ম দিয়েছিলেন। তেমনি নিজের ক্ষমতা দেখাতে জিউসকে ছাড়াই হেফেস্টাসকে জন্ম দেন হেরা।

হেরার রূপ রাজকীয়। তিনি জলপাই তেল দিয়ে রূপচর্চা করতেন। কখনো তাকে দেখা যায় সোনার সিংহাসনে আসীন অবস্থায়। তার মাথায় রয়েছে একটি সোনার মতান্তরে হীরক বলয়। যা তাকে মহিমান্বিত করেছে।  হেরাই সম্ভবত প্রথম দেবী যার জন্য সামোসে ৮০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে এক ছাদবিশিষ্ট মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর্গোসেও তার বিশাল মন্দির ছিল।

হেরার কাছে মূলত নারীরা ছুটে যেতেন তাদের বিপদে। বিবাহিত নারীদের সাহায্য করতেন হেরা। হেরার প্রিয় নগরী ছিল আর্গোস। তার কাছে পবিত্র ছিল গাভী ও ময়ূর। সুন্দরী তবে নিষ্ঠুর ও ষড়যন্ত্রকারী এক দেবী হিসেবেই মূলত গ্রিক পুরাণে চিত্রিত হয়েছেন স্বর্গের রানী হেরা।