ঢাকা, শুক্রবার ১৯, এপ্রিল ২০২৪ ৭:৪৬:১৫ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

বিলুপ্তির পথে মহারাণী হেমন্ত কুমারীর ঢোপকল

অনু সরকার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৩২ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বুধবার

বিলুপ্তির পথে মহারাণী হেমন্ত কুমারীর ঢোপকল

বিলুপ্তির পথে মহারাণী হেমন্ত কুমারীর ঢোপকল

ঢোপকল রাজশাহী শহরের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য।  রাজশাহীর সভ্যতাও জড়িয়ে আছে ঢোপকলগুলোর সঙ্গে। প্রায় ৮৫ বছর আগে রাজশাহীতে আধুনিক পানি সরবরাহব্যবস্থা গড়ে ওঠে শতাধিক ঢোপকলের মাধ্যমে। অথচ বর্তমানে ঢোপকলগুলো অযত্ন, অবহেলা এবং মানুষের অসচেতনতার কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বছর পাঁচেক আগেও রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে বেশ কিছু ঢোপকল চোখে পড়তো। কিন্তু এখন তেমন আর চোখে পড়ে না।

শুরুর কথা : মহারাণী হেমন্ত কুমারীর প্রচেষ্টা ও অনুদানে ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজশাহীবাসীদের জন্য সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পানি সরবরাহ প্রকল্প মহারাণী হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস নির্মিত হয় যার অন্যতম নিদর্শন রাজশাহী শহরে অবস্থিত ঢোপকলগুলো।

ইতিহাস : এই ঢোপকল তৈরির সময়ে রাজশাহী পৌরসভার (বর্তমানে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন) দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন রায় ডি এন দাশগুপ্ত। সে সময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির খুব কষ্ট ছিল। বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব ঘটেছিল তখন। যার ফলশ্রুতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা-আমাশয় সহ নানারকম পেটের পীড়া। বেশ কিছু লোকের মৃত্যুও ঘটেছিল সেই সময় এই অসুখে।

রায় ডিএন দাশগুপ্ত রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান (১৯৩৪-৩৯) থাকাকালে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানির কল স্থাপন করা হবে।

১৯৩৭ সালের অগাস্ট মাসের কোন এক দিন মিনিস্ট্রি অব ক্যালকাটার অধীনে রাজশাহী ওয়াটার ওয়াকর্স নামে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ব্যয় করা হয় আড়াই লাখের বেশি টাকা। এই কাজে নগরীর নামকরা ধণী লোকদের এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। সেই সূত্র ধরেই মহারাণী হেমন্তকুমারী নিজেই দান করেন প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। বিশাল অঙ্কের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ডের দান করা জমিতে মহারানী হেমন্ত কুমারীর নামেই ওয়াটার ওয়ার্কস স্থাপিত হয়। কালক্রমে তার নাম হেমন্তকুমারী ঢোপকল নামেই পরিচিত হতে থাকে।

ব্যবস্থাপনা : পুরো শহরজুড়ে প্রায় শতাধিক ঢোপকল স্থাপন করা হয়। মহারাণী হেমন্তকুমারী পানি শোধন কেন্দ্রে পানিকে বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট করে পানি থেকে আয়রন ও পানির ক্ষারতা দূর করা হতো। তারপর সে পানি সরবরাহ করা হতো ঢোপগুলোতে। তবে প্রথম দিকে পাথরকুঁচির ফিল্টার দিয়ে পানি ফিল্টার করা হতো। এরপর তা সিমেন্টের তৈরি মোটা পাইপের সাহায্যে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো।

এই ঢোপকলগুলোর প্রতিটির পানি ধারণক্ষমতা ৪৭০ গ্যালন। প্রতিটি ঢোপকলেই ছিল একটি 'রাফিং ফিল্টার'। এতে বালি ও পাথরের স্তর থাকায় সরবরাহ করা পানি আরও পরিশোধিত হয়ে বের হতো এবং গরমের সময় মোটামুটি ঠান্ডাও থাকতো। সেই সময় সারাদিনে মাত্র দুই ঘণ্টা পানি সরবরাহ করা হতো। শহরের মোড়ে মোড়ে ঢোপকলগুলোতে পানি ধরে রাখা হতো। ফলে সারাদিনই পানি পাওয়া যেত।

প্রায় প্রতি দুই মাস পর পর এই ঢোপকলগুলোকে পরিষ্কার করা হতো। পরিষ্কারের নিয়মটি ছিল খুবই মানসম্পন্ন। ঢোপকলের উপরের ঢাকনাটি খোলা যেত। এই ঢাকনাটি খুলে ভিতরে মানুষ নেমে ব্লিচিং পাউডার ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে তা পরিষ্কার করতো। প্রতি দুই মাস পর পর প্রতিটি ঢোপকল থেকে পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করা হতো। পরে ওই স্যাম্পল পাঠানো হতো পরীক্ষাগারে পানির মান ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য।

নির্মাণ কৌশল : ঢোপকলগুলো লম্বায় প্রায় ভূমি থেকে ১২ ফুট উঁচু এবং ব্যাস প্রায় ৪ ফুট। ঢোপকলগুলো তৈরি করা হয়েছিল সিমেন্টের ঢালাই করে। এই ঢোপকলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো একটা প্লাস্টার করা হতো। নকশাটা করা হতো টিনের সাহায্যে। চারদিকে টিনের একটা রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর ইটের খোয়ার ঢালাই ঢেলে দেয়া হতো। এর ঢালাই খুবই শক্ত। সহজে কোন কিছুর ধাক্কায় বা আঘাতে এটা ভাঙ্গে না।

বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত ঢোপকল : বর্তমানে এই ঢোপকল প্রায় বিলুপ্ত। শহরের স্মৃতি বলতে হাতেগোনা কয়েকটি ঢোপকল রয়েছে। যার মধ্যে একটি কুমারপাড়ায় অবস্থিত। আর একটি দেখা গেছে রাণীরপাড় এলাকায়। তবে এ ঢোপকলগুলোর অধিকাংশই বর্তমানে বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। দুয়েকটি থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে মহানগরীর কয়েকটি এলাকায়।