হ্যালো বেলজিয়াম, ঘুরে এলাম ব্রুজেস শহর
রহমান রাফিজা
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৫:৪৭ পিএম, ১৩ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার
লেখক রহমান রাফিজা
হ্যালো বেলজিয়াম ফ্রি রেলটিকিট! বেলজবাসীকে চাঙ্গা করতে সরকারের এ উপহার। নিজ দেশ ঘুরে দেখার জন্য বেলিজিয়ামের নাগরিক আর কার্ডধারীদের ৬ মাসে একটি রেলটিকিট ফ্রি দেবে। এই ঘোষণা এলো এ বছর আগস্ট-সেপ্টেদম্বরের দিকে। এমন উপহার কে না চায়! প্রায় ৩৫ লাখ আবেদন পড়ল। আবেদনকারীর কেউ বাদ পড়ল না। সবাই পেল সুযোগেটি। সবার ঘরেই পৌঁছে গেল টিকিট। ফ্রি! ফ্রি! অবশ্যই ফ্রি!
এই টিকিট দিয়ে প্রতি মাসে বেলজিয়ামের যে কোনো জায়গায় ঘুরে আসা যাবে। এমন টিকিট দেয়ার মূল উদ্দেশ্য বেলজবাসীকে ঘুরতে বের করা। ইউরোপীয়রা ঘুরতে পছন্দ করে এটা সত্যি। তবে শোনা যায়, বেলজরা ঘুরে বেড়াতে তত আগ্রহী নয়, দেশের ভেতরে তো আরও না। তাই সরকারের উদ্যোগ আগে নিজেকে জানো, তবেই না ভিনদেশ। বুদ্ধিমান সরকার, সে সাথে আন্তরিকও, জনবান্ধাবও বটে ।
সাধুবাদ জানাই এই উদ্যোগকে। তবে বাধ সাধল বর্তমান সময়। টিকিট হাতে! যেতে পারছি না। বিশ্বজোড়া করোনার দ্বিতীয় তান্ডব চলছে। ২০২০ এর নভেম্বরে এসে তান্ডবলীলায় এবার প্রথম স্থান নিয়েছে বেলজিয়াম! ছোট দেশ হলে হবে কি? তেজ আছে। রোগ ছড়ানোয় প্রথম! হাহাহা! তবে প্রতিরোধ করার প্রাণন্ত চেষ্টাও আছে। বারবার লক ডাউন চলছে। সরকার সময়ের প্রয়োজনের সাথে সাথে পাল্টে দিচ্ছো নিয়ম কানুন। পহেলা দফায় লকডাউন ছিল অনেকটা জেলখানার অনুভূতি। এখন তা ঠেকেছে খুঁটি গাড়া গরুর মতো। যাক, চলছে চলুক। ভালোর জন্যই তো এত সব।
তবে আমার ভাবনা অন্য জায়গায়। ভাবছি একটি করে মাস আসছে আবার চলেও যাচ্ছেু। দুটো করে ছয়টি টিকিট নষ্ট হচ্ছেে। মন খুব খারাপ। টিকিটের সদব্যবহার বুঝি আর হোল না। আজ ৭ নভেম্বর। কি করা যায় ভাবছিলাম। বাইরে সূর্য জেগেছে। আলোর ঝিকিমিকি চারদিক জুড়ে। আবহাওয়া দেখলাম। বৃষ্টি নেই। তাপমাত্রা ১৬। ঠান্ডার সময় ঠান্ডাতো কিছুটা থাকবেই। মন যেন কি চাইছে। ফেসবুক নাড়ছি, গুগলে যাচ্ছিা - হঠাৎ দেখি মাইকেল মধুসূদন যেন বলছেন - 'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে'। মনে হলো ঠিক তাই। ভয় কিসে! সাহসে করবো জয়। সবাই যখন ঘর আর হাসপাতাল করছে, এখনতো শহর ফাঁকা। এটিই মোক্ষম সময়। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। আমরা তিন মা-মেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। গন্তব্য অজানা নয়। আগে থেকেই নির্বাজচিত। নিজ শহর থেকে ঘন্টা খানেকের রেলযাত্রা। শহরটির নাম ব্রুজেস (Bruges)।
জি হ্যাঁ, আমাদের গন্তব্য ব্রুজেস শহর!
শুরু হলো অভিযান। আমরা তিনজন। সাথে আছে চিপস, চকলেট আর লেমনেড পানীয়। ব্যাস। রেলগাড়িতে চেপে বসলাম। ঘন্টা খানেকের পথ। জানালার ধার ধরে বসলাম। মিষ্টি রোদ লাগছিল গায়ে। ভিটামিন ডি নেয়ার এইতো সময়। তখন ঘড়ির কাটায় সকাল ৯'২০ বাজে। আদরের বড় ভাগ্নে সৌম্যর ভাষায় এটাই ডি নেয়ার উপযুক্ত সময়।
এদিকে আমার বড়কন্যা বিরোতিহীনভাবে ক্লিক ক্লিক করে চলেছে জানালার কাচের এ পাশ থেকে। বাইরে ছুটে চলা গাছ গাছালি আর আকাশে রোদের খেলা। থেমে নেই ছোটজনও। একাধারে সেলফি তুলছে। আর বলছে, মাম দেখ রোদে চেহারা কি উজ্জ্বল দেখায়। বাংলাদেশের মতো সব সময় রোদ থাকলে কি মজাই না হতো। কথায় কথায় পৌঁছেও গেলাম গন্তব্যে। মজার কাণ্ড হলো আজকাল টিকিট চেক হয় না। করোনার ভয়ে সবাই তিন হাত দূরে থাকে!
রেলগাড়ি থেকে নামলাম আমরা। এগিয়ে যাচ্ছি। স্টেশান থেকে ১০ মিনিটের পথ শপিং মল। ২০ মিনিট এগুলে মূল মার্কেট স্কয়ার। একে ঘিরেই পুরো শহর। চললাম খুঁজে দেখতে শহরটিতে কি কি আছে। আসার আগে কিছুটা গবেষণা করে বেরিয়ে ছিলাম, তাই অসুবিধা হলো না। সত্যি বলতে কি, ইউরোপে যদি হাতে টাউন প্ল্যান থাকে আর সঙ্গে থাকে জিপিএসসহ স্মার্ট ফোন তাহলে তো কর্মশেষ। আপনার অজান্তেই সে আপনাকে টেনে নেবে আপনার পছন্দের জায়গায় ।
আমি আবার একা অজানা জায়গায় চলতে একটু ভয়ই পাই। আজ পাচ্ছি না! কারণ সাথে আছে বীর দুই নারী, আমার কন্যা অজন্তা আর আদিবা। ওদের আমি বীরই বলবো। বেশ কয়েক বছর একা আছে এই বিদেশ-বিভূইয়ে। এদেশে পড়তে এসেছে দু’বোনে। একজন অনার্স শেষে মাস্টার্স করছে, আরেকজন অনার্স শেষের পথে। তাই আমার আর কিসের ভয়! ওরা তো চিনে নিয়েছে একা পথ চলা। অজানা জায়গা খুঁজে নেয়ার টেকনিক শিখেছে। আর শিখেছে কিভাবে নিজেকে নিরাপদ রেখে চলতে হয়। যাই হোক, বাড়তি কথা বেশি হয়ে গেল!
ব্রুজেস আসলে বেলজিয়ামের একটি প্রদেশ। ম্যাপে এর আকার ডিম্বাকৃতির। ক্যাসল, ছোট ছোটে পুল, খালের সমারোহে এটি উত্তরের ভেনিস বলে খ্যাত। জনসংখ্যার দিক থেকে বেলজিয়ামের সপ্তম বৃহৎতম শহর। এবার ব্রুজেস নিয়ে আমি যা জেনেছি তা একটু বলে নেই। তারপর ঘুরে দেখাব কোথায় কি আছে।
শুনুন তবে, নবম শতকে জলদস্যুরা প্রথম এই জায়গাটিকে তাদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। সে সময় স্কেন্ডেনেভিয়ান লোকদের আসা-যাওয়া ছিল অনেক বেশি। আর তাই স্কেন্ডেনেভিয়ান শব্দ Brygga মানে harbour বা mooring place অর্থাৎ আশ্রয় বা পোতাশ্রয় থেকে ব্রুজেস নামকরণটি হয়েছে। জুইন নদীর সাথে উত্তর সাগরের সংযোগ থাকায় সে সময় থেকে ব্রুশ খুব দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্ন্তজাতিক ব্যবসায়িক বন্দর হয়ে ওঠে।
১২ শতকের দিকে এটি শহর হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জুইন নদীর কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ব্যবসায়িরা কাপড় বেচাকেনা করতে আসত। তখন এখানকার টেক্সটাইল ব্যবসা রমরমা ছিল। এক সময় এখানে তৈরি আর্ন্তজাতিকভাবে প্রসিদ্ধ কাপড় পাওয়া যেত।
১৪ শতকে শহরটি উত্তর ইউরোপের ওয়্যার হাউজে পরিণত হয়। বিশেষ করে ইতালি, জার্মনী, স্পেনের নিজস্ব প্রতিনিধিরা এখানে থাকত। ফলে এলাকাটি বিভিন্ন ভাষাভাষি লোকের দ্বারা ইউরোপীয়ান সেন্টারে পরিণত হয়। ফলে সে সময় এখানে একজোটিক কাপড় পাওয়া যেত।
১৫ শতকের দিকে এসে শহরটি তার সম্পদ হারাতে থাকে। কিছুটা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে বন্দর এলাকাটি ক্রমশ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ফলে কাপড়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর ধস নামে। তবে ধস নামলেও অন্য দিক থেকে উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়। গার্মেন্টস নষ্ট হয়ে গেলেও এর আর্ট এবং আর্কিটেকচার ভিন্ন মাত্রা পায়। সে সময় নামকরা দুই পেইন্টার অ্যান্থনি ভ্যান ডিক (Anthony Van Dyck) এবং হ্যান্স মিমলিং (Hans Memling) চমৎকার সব কাজ করছিলেন যা নতুন আকর্ষণ তৈরি করে।
যদিও ১৬ শতকে এসে শহরটির নিজস্ব ক্ষমতা কমতে থাকে এবং ১৮ শতকে এটি দরিদ্রতম শহরে পরিণত হয়।
২০ শতকের দিকে আবার এই শহর জেগে ওঠে। এটি আর্ন্তজাতিক টুরিস্টদের কাছে একটি উল্লোখযোগ্য ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে দাড়ায়। মিডিয়াভেল শৈল্পিকতার কারণে এ শহর নতুন জীবন পায়। পরিচিত হয়ে ওঠে উত্তরের ভেনিস হিসেবে। বর্তমানে এটি উত্তর-পূর্ব বেলজিয়ামের ফ্ল্যামিস অন্বলের রাজধানী। শোনা যায়, এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে আভিতজাত্যপূর্ণ লেস তৈরি হয়। এ শহরে একটি লেস সেন্টারও রয়েছে। যাতে এর ইতিহাস পাওয়া যাবে। ব্যাস এটুকু ইতিহাস এ পর্যন্ত জানলাম।
এবার চলুন ঘুরে দেখা যাক শহরটি। সেই তখন রেলস্টেশান থেকে নামলাম আমরা। বিশ মিনিটেই আমরা চলে এলাম মার্কেট স্কায়ারে। এই চত্বরে নানা সময় নানা ধরনের উৎসব আয়োজন করা হয়। ক্রিসমাস ফেস্টিভ্যাল, বিয়ার ফেস্টিভ্যাল, আবার কোন ঋতুকে, দিবসকে কেন্দ্র করে চলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য নানান উৎসব।
আমরা খোলা যে স্কয়ারে এসে পৌঁছালাম তা মার্কেট স্কয়ার। মার্কেট স্কয়ারটিকে ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের রেস্টুরেন্ট, ফুলের দোকান, এনটিক্স শপ। চত্বরে মাঝ বরাবর উপরে আকাশ ছুঁয়ে গেছে বেলফ্রাই টাওয়ার। টাওয়ারটি মধ্যযুগে এ এলাকার সম্পদ আর স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে যেন দাড়িয়ে আছে। যে কেউ এ টাওয়ারে উঠে পুরো শহরটি দেখতে পারে। এই টাওয়ারে রয়েছে ৩৬৬ স্টেপ। প্রতি ১৫ মিনিট পর পর carillion music বেজে ওঠে। এক সময় এখান থেকে ভিন্ন ঘন্টার আওয়াজে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দেয়া হতো।
ঠিক বায়ে প্রাদেশিক প্রাসাদ। গথিক ডিজাইনের বিল্ডিংটি এখন পশ্চিম ফ্ল্যান্ডারের গর্ভণরের বাসভবন। স্কয়ারের ঠিক মাঝখানটায় দাড়িয়ে আছে জন ব্রাইডেল (jan breydel) এবং পিটার ডি কনিক (pieter de coninck ) নামের দু’জন ঐতিহাসিক ব্যক্তির মূর্তি। ডানদিকে রয়েছে তখনকার কোন ধনবান লোকের বিশাল দূর্গবাড়ি।
মার্কেট স্কয়ারের সাথে ক্যাসেল স্কয়ার। এখানেয় প্রথম প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যক্তিদের জন্য ক্যাসেল গড়া হয়। সেখান থেকে জলদস্যুদের প্রতিহত করা হতো। এখানে আরও রয়েছে সিটি হল এবং চ্যাম্বার্স। তার সাথে বেঞ্চ পাতা আছে, যাতে বসে বসে চারপাশের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর এখান থেকে হলি ব্লাড প্রসেশান হয়।
এ বিল্ডিংগুলোর বেশির ভাগ গথিক আর্কিটেচারে তৈরি। গথিক কালচারের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাইবেল, ছোট ছোট মূর্তি দিয়ে দেয়াল ডিজাইন করা হয়েছে। এ সব উঁচু বিল্ডিংয়ে ছোট ছোট জানালা। ভেতরটা গোলাকৃতি, এমনভাবে তৈরি করা যার মধ্য দিয়ে ঘরে আলো প্রবেশ করতে পারে।
স্কয়ার ছাড়িয়ে ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে গায়ে গায়ে ঘেষে চলে গেছে খাল। লম্বা সরু এসব খাল কেমন যেন নেচেনেচে বেঁকে গেছে। এপার-ওপার পাওয়া আসা করার জন্য রয়েছে ছোট ছোট পুল।
ওভাল আকৃতির এই শহরজুড়ে ৪৭০টি ক্যাসেল রয়েছে। এর মাঝে অন্তত ১০টি ক্যাসেল বিশাল আর আভিজাত্যের প্রতীক। একবারে দেখে শেষ করা যাবে না এই শহর। তাই পর্যটকদের সুবিধার জন্য রয়েছে সাইকেল। এই মাইকেল ভাড়া নিয়ে দূর শহরতলীর সৌন্দর্যও দেখা যায়। রয়েছে ক্যানেলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌকা আর ছোট বাষ্পচালিত চাকাওয়ালা জাহাজ।
ছোট জাহাজটি পানির উপর বুক চিড়ে ছুটে চলোজছে গন্তব্যে। মাঝে মাঝে বাষ্প ছেড়ে এনার্জি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। মাল্টি ভাষাভাষি গাইড বলে চলেছে কখন কোন পথে চলেছে জাহাজটি। জাহাজটি যখন পানির উপর দিয়ে পার হচ্ছিজল তার ক্ষাণিক পর পর মাথার উপরে থাকছে ছোট পুল। অনেকটা ছোটবেলা ওপেন টু বায়স্কোপ খেলার মত লাগছিল। এবার একটু যনে ঠান্ডা অনুভব করছি। হঠাৎ এক ঝলক ঠান্ডা বরফ শীতল বাতাস আমার পাশের মানুষটিকে টপকে হুড়হুড় করে কানেড ঢুকে পড়তে লাগলো। সারা গা শিরশির করে উঠল আমার। অমনি খেয়াল হলো। আরে, আমার শ্বাপুটা (টুপি) ফেললাম কোথায়! আসলেই তো। খালি খালি কি মানুষ বলে ইউরোপের আবহাওয়ার ঠিক নেই। রোদ দেখে জাহাজে উঠলাম আর এখন কিনা এত কনকনে ঠান্ডা! শুনছিলাম পুরো শহর জুড়ে ৮০টিরও বেশি পুল রয়েছে। যেতে যেতে দেখলাম সারি সারি বিভিন্ন রংয়ের বাড়ি গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা বাদামী, ইটের রঙ, ছাই আর কমলা মেশানো, লাইন দিয়ে পিরামিড আকারে মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িগুলো। ধারগুলো খাজ কাটা। মনে হচ্ছিেল বাড়িগুলো রেলের লাগোয়া বগির মতো একটা আরেকটার হাত ধরাধরি করে চলছে। ক্যানেলের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আনন্দো ঘুরে বেড়াচ্ছে কত না মানুষ। জাহাজটি শহর ছাড়িয়ে শহরতলীতে ভেসে গেল। দূর থেকে দেখলাম প্রথম উইন্ডমিলটিকে। ১০৭০ সালে গড়া এটি। অবাক ব্যাপার আজও এটি একইভাবে কাজ করছে। পর্যটকদের জন্য এটি এখন উন্মুক্ত। এখানে একটা জাদুঘরও আছে। চাইলে যে কেউ এখানে নেমে পড়তে পারে। জাহাজটি ব্রুশ থেকে ডামি পর্যন্ত চললো। আমরা এখানেই নেমে পড়লাম ।
ওখান থেকে নেমে সরু রাস্তা ধরে চললাম আমরা। এখানে বেশ কয়েকটা লেক রয়েছে। এসব লেক আর সরু গলি ক্যাসলগুলো নিয়ে নানা অলৌকিক কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এমন কি ভৌতিক গল্পও ছড়িয়ে আছে। এই শহরে মিনাওয়াটার নামে একটা পার্ক আছে। এতে আছে একটি স্বচ্ছ পানির বিশাল লেক। শোনা যায়, এক নাবিকের এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। নাম তার মীনা। মেয়েটি ওখানকার আদিবাসী এক যুবককের প্রেমে পড়ে। ওই ছেলের সঙ্গে তার বাবা বিয়ে দিতে রাজী হয় নি। সে পালিয়ে এ জায়গায় চলে আসে। শোনা যায়, এ জায়গায় মীনা তার প্রেমিকের বাহুতে মাথা রেখে মারা যায়। সে থেকে লেকটির নাম মিনাওয়াটার, আর মীনা যে পুলটি পাড়ি দিয়ে লেকের কাছে আসে সেটি লাভার্স পুল বলে পরিচিত।
হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি জন ভ্যান আইকের মূর্তির ঠিক উল্টা দিকে চারতলা সমান উঁচু একটি নীল তিমি গলা উচিয়ে পানি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু কিছুটা সামনের দিকে এগুতেই দোখলাম এ সত্য তিমি না। প্লাস্টিকের তৈরি তিমি। শিল্পীর প্রতিবাদী সতর্কী কণ্ঠ বলছে তোমরা মনে রেখো ১৫০,০০০,০০০;টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে রয়েছে।
এতকিছু দেখতে দেখতে খানিকটা ক্ষিধে পেয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২.৩০। খাবার দোকান খোলা, তবে বসে খাবার জো নেই। কি আর করা। মেয়েরা বললো, চল খাবার খেতে খেতে বাকী জায়গাটুকু দেখে নেব। ক্ষিধে আর ঠান্ডা বাতাসে বেশ শীত অনুভব করছি। যদিও গরম কাপড়ের কমতি ছিল না। তিনজনই ছিলাম প্যাক। হাতে মোজা, পায়ে বুট, গায়ে পশমী কালো কোট। গলায় ভারী মাফলার। কিছুই বাদ দেইনি।করোনায় বাড়তি যোগ মাস্ক। কালারফুল মাস্ক। ড্রেসের সাথে বেশ ম্যাচ হলো।
ছোট মেয়ে বলো, এখানকার ফিঙ্গার টিপস, সস, মেওনেজ আর পটেটো ক্রোকেটের নাম আছে। দেরি না করে তিন বাকেট নিয়ে নিলাম। ঠান্ডায় গরম খাবারের মজাই অন্যরকম। সসে গলিয়ে চললো খাবার। থেমে নেই। চলতে চলতে বাকেট প্রায় খালি আর পারা যাচ্ছের না। তাই শেষটুকু ফেলতে হলো। পাশের ক্যাফে থেকে ক্যাপেচিনো নিয়ে ঠান্ডা জুড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম।
স্যুভেনিরের দোকানে ঢু মারলাম। বিখ্যাত ক্যাসেলটির একটি স্যুভেনিরে নিলাম। ব্রুশ লেখা কলম আর বিখ্যাত লেসের ছোট এক টুকরা লাগানো একটা ট্যুরিস্ট ব্যাগ কিনলাম। ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করতে কত কি যে আছে তা বলে বোঝানো অসম্ভব। টুকটাক কেনাকাটা হলো, বাকী রইল চকলেট।
Dumon Choclatier (ডুমন শকোলেটিয়ার) কথা শুনেছিলাম। হাতে তৈরি মজাদার ক্রিমি বেলজিয়াম চকলেট এখানে পাওয়া যায়। ঢুকে পড়লাম এখানে। একজন নারী এগিয়ে এসে ভেতরে নিয়ে গেলেন। চকলেনট বানিয়ে দেখালেন। সেই সাথে এক টুকরা করে খেতেও দিলেন আমাদের। মোলায়েম ক্রিম আর অরিজিনাল বাদামের সাদ। আহ্ কি সুস্বাদু, সাধারণ বাজার থেকে কেনা চকলেটের সাথে এর পার্থক্য নিমিষে বোঝা গেল। চড়া দাম! তাও ছোট এক প্যাকেট কিনে নিলাম।
ওখান থেকে বেরিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। তখন বেলা ৪.৩০ বাজে। খুব দ্রুতই সন্ধ্যা হবে, তাই কিছুটা তাড়াও আছে। এ চলার পথে ভারী সুন্দর লাগল আরেকটি অতি সাধারণ জিনিস। মাঝে মাঝে অর্বািচিনভাবে ফেলে রাখা হয়েছে একেকটি ছাদ ছাড়া ভাঙ্গা বাড়ি। বাড়িগুলোতে ঝুলানো নানা রংয়ের ফুল, হার্ব-এর গাছ। শুনেছি প্রতিবেশীরা নিজ থেকে এগুলো লাগায়। এগুলো সিক্রেট গার্ডেন বলে পরিচিত। মনে হলো অগোছাল এ সৌন্দর্য পথিককে বার বার এ পথে ফিরিয়ে আনার সফল প্রচেষ্টা।
ফেরার পথে মেয়েদের বায়না ঘরে যেয়ে আজ আর ভাত-মাছ খাবে না। এখানকার স্ক্রিম পটেটোস বিখ্যাত। Potatoes Bar-এর নামডাক শুনেছি। এর ফিঙ্গার চিপস আর ক্রোকেত (croquettes) তো খুবই বিখ্যাত। নিয়ে নিলাম তিনটি ক্রোকেত। দোকানী বললো, এর ভেতর আছে স্ম্যাস ফিল ফিস আর অ্যাসপারাগাছ। খাবার নিয়ে এবার সোজা চলে এলাম স্টেশানে। উঠে পড়লাম রেলগাড়িতে।
তর সইছিলো না কারোরই। ওদের সাথে সাথে আমারও। দ্রুত খাবার মুখে তুলে নিলাম। কামড় দিতেই উপরের মুচমুচে স্তর ভেদ করে মুখে লাগল মাছের আর অ্যাসপারাগাছের ক্রিমি ফ্যাটি টেস্ট। ভারী সুস্বাদু। মুখে লেগে থাকার মতো। দ্রুতই যেন শেষ হয়ে গেল। ব্যাগ থেকে বের করে লেমোনাড দিয়ে শেষ তৃপ্তিটুকু নিলাম। সবাই এখন বেশ চাঙ্গা। হাসি হাসি মুখ। বেশ ভালো কাটল দিনটি। ঘন্টাখানেক বাদে নামলাম এসে নিজ শহরে।
ধন্যবাদ হ্যালো বেলজিয়া। অল্প খরচে সব স্বাদ পেলাম। কে বলে ঘুরতে হলে ছুটে যেতে হবে বহুদূর। খুব কাছের পথেও ঘুরে অনেক আনন্দ পাওয়া যায়।
এ জায়গাটি খুব সুন্দর। তাই একদিন বা সপ্তাহ কিম্বা দশ-বারো দিনের জন্যও এখানে ছুটি কাটানো যায়। আমি নিশ্চিত বলতে পারি একটুও বিরক্তি লাগবে না। চলে আসুন। ঘুরে যান অন্তত একবার আমার ভালো লাগার এ পথে।
রহমান রাফিজা : বেলজিয়াম প্রবাসী লেখক