ঢাকা, শুক্রবার ১৯, এপ্রিল ২০২৪ ৮:১৪:৫৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

আজও অবহেলিত পলাশডাঙায় বিধবা বিবাহের প্রথম কন্যার ভিটা

প্রলয় চক্রবর্তী, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:০০ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০২১ সোমবার

অবহেলিত হয়ে পরে আছে পলাশডাঙায় বিধবা বিবাহের প্রথম কন্যার ভিটা।

অবহেলিত হয়ে পরে আছে পলাশডাঙায় বিধবা বিবাহের প্রথম কন্যার ভিটা।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা। সেই ১৮৫৬ সালের কথা। সময়ের প্রবাহে প্রায় দুইশ বছর আগের ইতিহাস। গোবরডাঙার খাঁটুরার শ্রীশচন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে হল বর্ধমান প্রেসিডেন্সি বিভাগের পলাশডাঙা গ্রামের নয় বছরের বিধবা কন্যা কালীমতির। বর্তমানে পলাশডাঙা বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী ব্লকের অন্তর্গত। সেই প্রথম বিধবা বিবাহ। সময় কাল ৭ ডিসেম্বর, ১৮৫৬। এই বিয়ে সুসম্পন্ন করার জন্য বিদ্যাসাগরকে কম কাঠখড় পোয়াতে হয়নি। কোথায় পাওয়া যাবে এমন পাত্রী?  পাত্রই বা কোথায়? কে এই অচল সমাজের সব বাধা ঠেলে এগিয়ে আসবেন এমন ধারা সৃষ্টিছাড়া বিয়ে করতে!

বিধবাদের বিয়ে হবে— এমন কৌতুক ও একরাশ মজায় যখন কলকাতা মশগুল, তখন  বিদ্যাসাগরও যেন কিছুটা বিভ্রান্ত, হতাশ। ইয়ংবেঙ্গল এর সদস্যরা পিছটান দিয়েছেন। কেউ এগিয়ে এসে বলছেন না এই ‘ম্লেচ্ছ’ কাজে তারা বিদ্যাসাগরের পাশে থাকবেন। মুখে বলা আর কাজে করা যে এক নয়, বিদ্যাসাগরের মতো কে না তা জানে।

বিদ্যাসাগর এবার নিজেই উদ্যোগ নিলেন। পাত্র তাঁর সংস্কৃত কলেজের একদা প্রিয় ছাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। শ্রীশচন্দ্র তখন মুর্শিদাবাদে জজ পন্ডিতের কাজ করছেন। বিদ্যাসাগরের কথায় রাজি হলেন শ্রীশচন্দ্র। কিন্তু  পাত্রী?  কে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিধবা মেয়েকে পুনরায় পাত্রস্থ করবেন!

পাওয়া গেল পাত্রী বর্ধমানের গণ্ডগ্রাম পলাশডাঙায়। কলকাতায় নয় কিন্তু!  বিশিষ্ট আইনজীবি দুর্গাদাস চট্টেপাধ্যায় বিদ্যাসাগর মশাইকে নিয়ে এলেন নিজের গ্রাম পলাশডাঙায়। দুর্গাদাসবাবু কলকাতায় আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। থাকতেন কলকাতার বেলতলায়। কোনও এক সূত্রে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। দুর্গাদাস বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের নীরব সমর্থক ছিলেন। দুর্গাদাসবাবুর মধ্যস্থতায় বিয়ের পাকা কথা হয়। কথিত আছে দুর্গাদাসবাবুর গ্রামে স্বয়ং বিদ্যাসাগর এসেছিলেন বিয়ের কথা বলতে।

কালীমতি ও তাঁর মা লক্ষীমনি ছিলেন দুর্গাদাসবাবুর প্রতিবেশী। দুর্গাদাসবাবুর  বাড়িতেই ছিলেন বিদ্যাসাগর। চারদিন তিনি পলাশডাঙায় থাকেন। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, পলাশডাঙা নয়, বিয়ের কথা হয় নদীয়ার শান্তিপুরে, এখানেই ছিল লক্ষীমনির বাপের বাড়ি। লক্ষীমনি ও তাঁর স্বামী ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায় এর কন্যা ছিলেন কালীমতি। চার বছর বয়সে কালীমতির বিয়ে হয় কৃষ্ণনগরের কাছে বাহিরগাছি গ্রামের হরমোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ছয় বছর বয়সে কালীমতি বিধবা হন। স্বামী মারা যাওয়ার পর স্বামীর ঘর করা দূর্বিষহ হয়ে উঠলে কালীমতি মায়ের কাছে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে লক্ষীমনির স্বামী ব্রহ্মানন্দও মারা যান। দুই অসহায় বিধবার জীবনে নেমে আসে চরম দারিদ্র।

বিধবা মা লক্ষীমনি তাঁর নয় বছরের স্বামীহারা কন্যাটিকে নিয়ে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করতেন। দুর্গাদাসবাবু সময় অসময়ে এই দরিদ্র পরিবারটিকে সাহায্য করতেন। তিনিই সিদ্ধান্ত নেন নয় বছর মাত্র বয়সের বিধবা কালীমতির জীবন বদলে দেওয়ার। শাস্ত্র, দেশের আইন, সর্বোপরি বিদ্যাসাগর সহায়। বিধবা বিবাহে আর কোনও বাধা নেই। সমাজ বিপ্লবের এক সন্ধিক্ষনে দুই যুগন্ধর পুরুষ যেন এক হচ্ছেন। দুর্গাদাসবাবু বিদ্যাসাগরকে হদিস দিলেন বিধবা পাত্রীর।

কালীমতিকে কেউ মনে রাখেনি। তেমনই দুর্গাদাসবাবুর ভূমিকাও বিস্মৃতির অন্তরালে। অথচ নীরবে এবং কোনওরূপ আত্মপ্রচার ছাড়াই এই মানুষটি ইতিহাসের এক ঘটনাবহুল সময়ের অনুঘটকের কাজ করেছিলেন।

লক্ষীমনি ও কালীমতি দেবীর ভগ্ন ও প্রায় হারিয়ে যাওয়া ভিটে পলাশডাঙা গ্রামে আজও চোখে পড়ে। আর আছে দুর্গাদাস চট্রোপাধ্যায়-এর ভিটে বাড়ি ও দুর্গাদালান। প্রায় পৌনে দুশোবছর ধরে চট্রোপাধ্যায় পরিবার দুর্গাপূজা করে আসছেন।  এবছর করোনাকালেও এর ছেদ পড়েনি।

অনেক কথা-কাহিনীর এক ঐতিহাসিক পশ্চাৎপট যেন দশমীর বিকেলে ঠাকুর দালানের আঙিনায় জীবন্ত এক চিত্রমালা মেলে ধরছিল আমাদের সামনে, যেখানে কুশীলব বিদ্যাসাগর, লক্ষীমনি-কালীমতি, দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায় আর পলাশডাঙা গ্রামখানি।

সূত্র : পেজ ফোর