ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৬:৩৭:২২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

আশাপূর্ণা দেবী: আটপৌরে ঘরণার আধুনিক কথাশিল্পী

অণিমা মিত্র

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:১৮ পিএম, ১০ জানুয়ারি ২০২১ রবিবার

আশাপূর্ণা দেবী: আটপৌরে ঘরণার আধুনিক কথাশিল্পী

আশাপূর্ণা দেবী: আটপৌরে ঘরণার আধুনিক কথাশিল্পী

আশাপূর্ণা দেবী।  বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন সৃজনশীল সফল কথাশিল্পী। অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঔপন্যাসিক হিসেবেও খ্যাতিমান তিনি। শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তার অবদান অপরিসীম। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষত সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তার রচনার মূল উপজীব্য।

ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ আশাপূর্ণা ছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষায় তার জ্ঞান ছিল না। বঞ্চিত হয়েছিলেন প্রথাগত শিক্ষালাভেও। স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তার। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তি তাকে দান করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকের আসন।

নিজের সময়ের থেকে অনেক দূর এগিয়ে ছিলেন আশাপূর্ণা। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন ‘আমি মনের জানলা খোলা রেখেছিলাম যে’ ….. তার প্রতিটি নারী চরিত্রই স্বতন্ত্র। স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।

তার প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতা-বকুলকথা উপন্যাসত্রয়ী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম বলে বিবেচিত হয়।

তার একাধিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। দেড় হাজার ছোটোগল্প ও আড়াইশো-র বেশি উপন্যাসের রচয়িতা আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কারসহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপে ভূষিত করেন।

আশাপূর্ণা দেবীর জন্ম হয় ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি (বাংলা ২৪ পৌষ, ১৩১৫) শুক্রবার সকালে উত্তর কলকাতায় মাতুলালয়ে। বাবার নাম হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং মায়ের নাম সরলাসুন্দরী দেবী।

হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কমর্শিয়াল আর্টিস্ট। সেযুগের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকাগুলিতে ছবিও আঁকতেন। রক্ষণশীলতার বিপরীতে অবস্থান করতেন তার মা সরলাসুন্দরী দেবী। সাহিত্যপাঠই ছিল তার জীবনের একমাত্র ‘পরমার্থ’। রাজনৈতিক আদর্শে ছিলেন কট্টর ব্রিটিশ-বিদ্বেষী স্বদেশী।

আশাপূর্ণা প্রথম নারী হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ পান। অথচ অদ্ভুত কথা হল তিনি কোনোদিন স্কুলে পড়েননি। হ্যাঁ এটাই সত্যি। কারণ বাড়ির বারণ ছিল। তার মা সরলাসুন্দরী দেবী কিন্তু স্কুলে পড়া বিদুষী ছিলেন। মা খুব চেষ্টা করেছিলেন তার মেয়েরা স্কুলে পড়ুক। কিন্তু তার শাশুড়ির অনমনীয় জেদের কাছে হার মেনে যান। আশাপূর্ণা দেবীর  ঠাকুমা শেষমেশ মত দেননি।

গুপ্ত-পরিবারের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার বেগমপুরে। যদিও আশাপূর্ণা দেবীর জীবনের সঙ্গে এই অঞ্চলটির কোনও প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তার ছোটোবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতাতেই, ঠাকুরমা নিস্তারিনী দেবীর পাঁচ পুত্রের একান্নবর্তী সংসারে। পরে হরেন্দ্রনাথ যখন তার আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নিজস্ব বাসভবনে উঠে আসেন আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর। কিন্তু ছোটবেলার ওই কয়েকটি বছর তার মনে গভীর ছাপ রেখে যায়। পরবর্তীকালে সাহিত্যেও নানা ভাবে এঁকেছিলেন ‘দেহে ও মনে অসম্ভব শক্তিমতী’ তার সেই ঠাকুরমার ছবি।

আগেই বলেছি, প্রথাগত শিক্ষার সৌভাগ্য আশাপূর্ণার হয়নি ঠাকুরমার কঠোর অনুশাসনের কারণে। পরবর্তী জীবনে এক স্মৃতিকথায় এই প্রসঙ্গে আশাপূর্ণা বলেছিলেন, ‘...ইস্কুলে পড়লেই যে মেয়েরা... বাচাল হয়ে উঠবে, এ তথ্য আর কেউ না জানুক আমাদের ঠাকুমা ভালোভাবেই জানতেন, এবং তার মাতৃভক্ত পুত্রদের পক্ষে ওই জানার বিরুদ্ধে কিছু করার শক্তি ছিল না।’

তবে এই প্রতিকূল পরিবেশেও মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে দাদাদের পড়া শুনে শুনে শিখে গিয়েছিলেন পড়তে। বর্ণপরিচয় আয়ত্ত করেছিলেন বিপরীত দিক থেকে। মা সরলাসুন্দরী ছিলেন একনিষ্ঠ সাহিত্য-পাঠক। সেই সাহিত্যপ্রীতি তিনি তার কন্যাদের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছিলেন।

সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সবুজপত্র, বঙ্গদর্শন, বসুমতী, সাহিত্য, বালক, শিশুসাথী, সন্দেশ প্রভৃতি ১৬-১৭টি পত্রিকা এবং দৈনিক পত্রিকা হিতবাদী তো বাড়িতে আসতই, তাছাড়াও সরলাসুন্দরী ছিলেন স্বনামধন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, জ্ঞানপ্রকাশ লাইব্রেরি ও চৈতন্য লাইব্রেরির সদস্য। বাড়িতে সে যুগের সকল প্রসিদ্ধ গ্রন্থের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডারও ছিল। এই অণুকূল পরিবেশে মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই পাঠ্য ও অপাঠ্য নির্বিশেষে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করে দেন আশাপূর্ণা।

পরবর্তীতে এই বাল্যকাল সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘হিসেব মতো আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে, সংসার ঊর্ধ্বের একটি স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ।’

ছেলেবেলার দিনগুলি সম্পর্কে আশাপূর্ণা বলেছেন, ‘...খুব ডাকাবুকো ছিলাম। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ওড়াতাম, মারবেল খেলতাম। ক্যারাম খেলতাম দাদাদের সঙ্গে।’

আবার পিতামাতার সবচেয়ে বাধ্য মেয়ে হওয়ার জন্য তাদের সবচেয়ে প্রিয়পাত্রীও হয়ে উঠেছিলেন। সেদিনের নির্মীয়মান কলকাতা মহানগরী ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। আর প্রিয় ছিলেন দিদি রত্নমালা ও বোন সম্পূর্ণা। তারা তিনজনে ছিলেন, আশাপূর্ণার ভাষায়, ‘...একটি অখণ্ড ট্রিলজির অংশ। এক মলাটে তিনখানি গ্রন্থ।’

আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নতুন বাড়িতে উঠে আসার কিছুদিনের মধ্যে এই অখণ্ড আনন্দে বিচ্ছেদের সুর বাজে। বিয়ে হয়ে যায় দিদি রত্নমালার। সেই নিঃসঙ্গতা দূর করতে একদিন আশাপূর্ণা ও সম্পূর্ণা করে ফেলেন এক দুঃসাহসিক কাজ। দুই বোনের সাক্ষরে চিঠি পাঠান রবীন্দ্রনাথকে। আবদার, ‘নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে একটি উত্তর দেবেন।’

কাঙ্ক্ষিত সেই উত্তর আসতেও দেরি হয়নি। আর এর পরেই বহির্বিশ্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘স্যাঁতস্যাঁতে বাংলাদেশের বিদ্রোহিনী নারী’র।

১৯২৪ সালে, মাত্র ১৫ বছর ৮ মাস বয়সে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কালিদাস গুপ্তের সাথে বিয়ে হয় আশাপূর্ণা দেবী। ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে একমাত্র কন্যা পুস্পরেণু ও দুই পুত্র প্রশান্ত ও সুমান্তের জন্ম হয়। তার লেখক ও পারিবারিক জীবন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সাংসারিক নানা ব্যস্ততায়ও তিনি তার লেখক স্বত্তা রক্ষা করতে পেরেছেন সফলভাবে। একজন সুগৃহিনীর পক্ষে একজন সু লেখক হওয়া যে সম্ভব তা তিনি প্রমান করেছেন।

সাহিত্যে তার অনুরাগ আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল শ দেড়েকেরও বেশি উপন্যাস, বেশ কিছু ছোটগল্প এবং শিশুতোষ রচনা। এসবের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়েছে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, এবং ‘বকুলকথা’। এই তিনটি উপন্যাস আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যাদা পেয়েছে। আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যের ভাষা সহজ, সরল কিন্তু গভীর তাৎপর্যময়। জীবনকে তিনি আবিষ্কার করেছেন কর্মের মধ্যে, সংগ্রামের মধ্যে, বিপর্যয়ের মধ্যে, বিপর্যয় থেকে উঠে দাঁড়াবার অদম্য প্রয়াসে–এক কথায় জীবনের নিরন্তর গতিশীলতার মধ্যে। তার রচনা স্বদেশচিন্তা ও সমাজ ভাবনা আশ্রিত, মননশীলতায় ঋদ্ধ।  
তার উল্লেখযোগ‍্য কয়েকটি ছোটগল্প- পাতাচাঁপা, সর্ষে ও ভূত, ডেইলি প‍্যাসেজ্ঞার, কামধেনু, শুনে পুন‍্যবান, অভিনেত্রী, ক‍্যাকটাস্ প্রভৃতি।

১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই আশাপূর্ণা দেবী প্রয়াত হন।