ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ৪:০৫:০৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ধূসর স্মৃতির অতলে মুরাদনগরের জমিদার বাড়িগুলো

হীমেল আরমান

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:২৪ পিএম, ১৩ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার

ধূসর স্মৃতির অতলে মুরাদনগরের জমিদার বাড়িগুলো

ধূসর স্মৃতির অতলে মুরাদনগরের জমিদার বাড়িগুলো

সময় কেটে গেছে বহু। সময়ের প্রবাহে হারিয়ে গেছে জমিদারদের প্রতাপ। বিলুপ্ত হয়ে গেছে জমিদারি প্রথা। শুধু ইতিহাসের পাতায় সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা ও কীর্তি। প্রথা বিলুপ্ত হলেও যুগের পর যুগ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার এ অনন্য নিদর্শন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি জমিদার বাড়ি।

সৃষ্টি আর ধ্বংসে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত। আবার কারোর দায়িত্ব হীনতায় কালের গহব্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক অতীত। বর্তমান যেমন গুরুত্ববহ সোনালী অতীতও তেমনি অনুপ্রেরণা যোগায়।

আমরা বাঙালি, আমাদের রয়েছে ঐতিহাসিক অতীত। বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জমিদারিত্বের স্মৃতি চিহ্ন। এ সব স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ আমাদের মনে করিয়ে দেয় কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িগুলোর স্বর্ণালী দিন গুলোর কথা। এ জমিদার বাড়িগুলো কুমিল্লা জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে মুরাদনগর অবস্থিত।

জাহাপুর জমিদার বাড়ি: ৪শ’ বছর আগে এ জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন স্বর্গীয় কমলাকান্ত রায়। কমলাকান্ত রায়ের জন্ম ১২১৯ বাংলা এবং মৃত্যু ১২৭৯। জমিদার বাড়ির প্রবেশ পথে রয়েছে মুখোমুখি দুটি সিংহ। এখানে রয়েছে অনেক বড়ো একটা জগন্নাথ মন্দির, বিভিন্ন সময় পূজা পালন করা হয়, এছাড়াও বাড়ির চারদিকে জমিদারদের ব্যবহারিক অনেক জিনিস পত্র ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে ।

বাঙ্গরা রূপবাবু জমিদার বাড়ি (বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়ন): প্রায় ২৫০ বছর আগে ৯ টি গ্রামজুড়ে ছিলো রূপবাবুদের জমিদারি। জমিদার রূপবাবু তার বাবা উমালোচন মজুমদারের মতো প্রজাবৎসল জমিদার ছিলেন। রূপবাবুর বাবা জমিদার উমালোচন মজুমদার ১৮৮৫ সালে বাঙ্গরায় একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯০০ সালে রূপবাবুর মা শান্তমনি দেবীর নামে অসাধারণ নকশায় একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন সেখানে প্রজারা চিকিৎসা নিতেন।

এখন এ দতব্য চিকিৎসালয়টি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নকশায় জং ধরেছে, ক্ষয়ে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তারা। এছাড়াও বাঙ্গরা বাজার, জেলা প্রশাসকের ডাক বাংলো রূপ বাবুদের দেওয়া। বাঙ্গরা বাজারে অগ্রণী ব্যাংক শাখাও রূপ বাবুদের নামে। জমিদার রপবাবুর এক ছেলে। নাম মানিক বাবু। মানিক বাবুর তিন ছেলে। দেবী প্রসাদ মজমুদার, শিবু প্রসাদ মজুমদার ও শ্যামা প্রসাদ মজুমদার। তাদের মধ্যে শ্যামা প্রসাদ ও দেবী প্রসাদ মজুমদার ঢাকায় থাকেন। কুমিল্লায় পানপট্টির বাংগরা হাউজে থাকেন শিবু প্রসাদ মজুমদার। তিনি বিভিন্ন সময়ে তারা বাপ-দাদার ভিটেতে যান।

মেটংঘর দারিকসাহা জমিদার বাড়ি (আকবপুর ইউনিয়ন): জমিদারদের উত্তররসূরী দয়ালসাহ ( ৮১ ) ঢাকায় বসবাস করছেন।

তিনি জানান, আমার বাবা দারিকসাহা বৃটিশ শাসনামলে জমিদারী লাভ করেন। আইয়ুব খানের আমলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত আমাদের জমিদারী বিদ্যমান ছিল। আমি চাকুরি থেকে অবসর নেয়ার পর গ্রামের জায়গা-জমি বিক্রি করে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি।

বর্তমানে জমিদার বাড়ির সবচেয়ে বেশি বয়স্ক ব্যক্তি শ্রীমতি চম্পক লতা রায় ( ৯৫)। তিনি বলেন, আমার দাদা শ্বশুর দারিকসাহা ছিলেন বড় জমিদার। সবাই তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।

রহিমপুর মনমোহন পোদ্দার জমিদার বাড়ি (নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়ন): পুরানো স্থাপনা আর ইটের কারু কাজ দেখলেই বোঝা যায় বহু বছর আগে কোন জমিদারী প্রথা ছিল বাড়িটিতে। প্রবেশ করে দেখা হয় বাড়ির বর্তমান কর্তা পিংকো পোদ্দারের সাথে।

তিনি জানান, তাদের এ বাড়িগুলোর বয়স ১১৫-১২০বছর। জমিদারী প্রথা উঠে যাওয়ার পর থেকে সেই থেকে ঘরগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। আমার দাদামহ এ বংশের জমিদার ছিলেন। শুনেছি বাঙ্গরা রূপবাবু কুমিল্লার জমিদাররাও আমার দাদামহ মনমোহন পোদ্দারের কাছে আসা যাওয়া করতেন। তার বেশ প্রতিপত্তি ছিল।

থোল্লার মীর আশ্রাফ আলী জমিদার বাড়ি (নবীপুর পূর্ব ইউনিয়ন): কুমিল্লা থোল্লার জমিদার মীর আশরাফ আলী খানের বাসভবন ছিল বর্তমানে যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল-ফজলুল হক ,মুসলিম হল, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল এশিয়াটিক সোসাইটি। সেখানকার সমগ্র এলাকা নিয়ে ছিল কুমিল্লার মুরাদনগরের থোল্লার প্রভাবশালী জমিদার মীর আশরাফ আলী খানের (১৭৫৫-১৮২৯) ঢাকার বাসভবন।

বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্ত তার এ জমিদারি ছিল ত্রিপুরার বরদাখাত (মুরাদনগর-নবীনগর-বাঞ্ছারামপুর) পরগণায়। প্রজাহিতৈষী জমিদার মীর আশরাফ আলী খান ছিলেন ব্রিটিশের অনুগত ভক্ত। জমিদারির সদর দপ্তর থোল্লার পোশাকী নাম এখন বাখরনগর। সম্রাট শাহ আলমের পুত্র নবাব সৈয়দ করিম কুলি খানের বংশধর ছিলেন তিনি। তার আগে আগা বাকের এ জমিদারি পেয়েছিলেন ঈসা খাঁর বংশধর কিশোরগঞ্জের হায়বত খানের মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার সুবাদে। শের শাহের আমলে (১৫৩৯-৪৫) পরগণার নাম দেওয়া হয়ে ছিল বলদাখাল। ১৯১০ সালের গেজেটে নাম হয় বরদাখাত।

আগা বাকেরের পুত্র আগা সাদেকের আমলে এ জমিদারির বিস্তৃতি ছিল বরদাখাত, গঙ্গামন্ডল, লৌহগড় ও পাটিকারা প্রভৃতি পরগণায়। আগা সাদেকের মৃত্যুর পর (১৭৩২) তিনপুত্র মির্জা মোহাম্মদ ইব্রাহিম (মির্জা ভেলা), মির্জা আবুল হোসেন (আগা নবী) ও মির্জা মোহাম্মদ জাফর এ জমিদারি লাভ করেন। মির্জা মোহাম্মদ ইব্রাহিম (মির্জা ভেলা) লাভ করেন বরদাখাত পরগণা।

মির্জা মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ছিল তিন মেয়ে। তারা হলেন ১. আজিওন্নেছা খানম (স্বামী মীর আশরাফ আলী খান), ২. রওশন আরা খানম (স্বামী বিহারের পাটনার নবাবপুত্র মির্জা মোহাম্মদ বাকের), ৩. তৃতীয় কন্যা মেহেরুন খানম (স্বামী নারায়ণপুরের জমিদার দৌহিত্র কবি মির্জা হোসেন আলী)। মির্জা মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর (১৭৬৩) এ তিন মেয়ে জমিদারি লাভ করেন।

জমিদার মীর আশরাফ আলী খানের উত্তর পুুরুষ (প্রপৗত্র) নবাব সৈয়দ মোহাম্মদ আজাদ খান বাহাদুর (১৮৫০-১৯১৬) ছিলেন একজন উর্দু সাহিত্যিক ও সরকারী চাকুরে। তিনি ছিলেন বঙ্গের রেজিস্ট্রেশন বিভাগের ইনস্পেক্টর জেনারেল। তিনি ফরিদপুরের নবাব খান বাহাদুর আব্দুল লতিফের (১৮২৮-৯৩) জামাতা।

এ ব্যাপারে মুরাদনগর উপজেলার সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকেরা জানায়, মুরাদনগরের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িগুলো যদি শীঘ্রই সরকারীভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয় তাহলে কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাবে এর স্মৃতি চিহৃ। আমরা চাই জমিদার বাড়ি সমূহ সংরক্ষণ করে সাজিয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখা হউক। তাহলে জমিদারি প্রথা সম্পর্কে নূন্যম ধারণা পাবে বর্তমান ও ভবিষৎত প্রজন্ম।

এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আহসানুল আলম সরকার কিশোর বলেন, মুরাদনগরের জমিদার বাড়ি গুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। শীঘ্রই এ বাড়িগুলোকে সরকারীভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

মুরাদনগর উপজেলায় আরও কিছু জমিদার ছিলেন বলে জানা যায়, যাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি।  এর মধ্যে রয়েছে, কামাল্লা জমিদার বাড়ি (কামাল্লা ইউনিয়ন), মধ্যে নগর দূর্গারাম লুথ জমিদার (মুরাদনগর সদর ইউনিয়ন) এবং ছালিয়া কািন্দ জমিদার বাড়ি (ছালিয়াকান্দি ইউনিয়ন)।

সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকেরা জানায়, মুরাদনগরের পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ি গুলি যদি শীঘ্রই সরকারিভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয় তাহলে কালের পরিক্রমায় ডুবে যাবে এর স্মৃতি চিহ্ন।  আমরা চাই জমিদার বাড়িসমূহ সংরক্ষণ করে সাজিয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখা হউক। তাহলে জমিদারি প্রথা সম্পর্কে নূন্যম ধারণা পাবে বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজন্ম।

কিভাবে যাবেন?
ঢাকার সায়েদাবাদ ও রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে কুমিল্লা অথবা কোম্পানীগঞ্জগামী সৌদিয়া, তিশা অথবা অন্য কোন লাক্রারিয়াস বাসে উঠবেন।  ময়নামতি (ক্যান্টেনমেন্ট) পৌঁছবেন (কুমিল্লা শহরের আগে) মাত্র ২ ঘন্টায়।  কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠলে আর বাস পরিবর্তন করতে হবেনা।  কুমিল্লার বাসে উঠলে ময়নামতিতে নামুন। এখান থেকে অবার কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠে দেবিদ্বারের পান্নারপুলে নামুন।  এখান থেকে বাখরাবাদ রোডে ১০ কিলোমিটার গেলেই জাহাপুরে পৌঁছতে পারবেন।

প্রতিদিন বহুদূর থেকে লোকজন এসব স্থাপনা দেখতে আসছে। স্মৃতি হাতরে দেখছে অতীত। আর ভাবাভাবি নয়, এক্ষুণি চলে আসুন আপনিও।

ফেরার পথে :
যদি নিজস্ব যানবাহনে আসেন তাহলে দিনে দিনেই ফিরতে পারবেন।  সমস্যা হলে কোম্পানীগঞ্জ অথবা দেবিদ্ধারের কোন হোটেলে উঠুন।  অথবা ১ ঘন্টা হাতে নিয়ে কুমিল্লা শহরের নূরজাহান, আশিক হোটেলসহ অন্য যে কোন হোটেলে উঠুন।  বাসায় ফেরার সময় প্রিয় জনের জন্য ঐতিহ্যবাহী খদ্দরের পোশাক এবং রস মলাই নিয়ে যেতে ভুলবেন না কিন্তু!