রবী ঠাকুরের কাছারিবাড়ি: কত স্মৃতি, কত কথা
ফিচার ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৮:৪৫ পিএম, ৯ জুলাই ২০২১ শুক্রবার
ফাইল ছবি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়ি সিরাজগঞ্জ থেকে ৪০.২ কিলোমিটার দূরে শাহজাদপুরে। পথ চলতে চলতে সেখানেই সন্ধান পাবেন হলুদ একটি বাড়ির। সামনেই প্রশস্ত বাগান, আর তারপরেই দোতলা এই বাড়ি। অত্যন্ত যত্নে রয়েছে বলাই বাহুল্য। তাহলে নিশ্চয়ই এই বাড়ির ইতিহাস রয়েছে। শাহজাদপুরের এই বাড়িটি যে একসময় ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের। স্থানীয়দের কাছে এর পরিচয় ‘রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়ি’ হিসেবে।
এই বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ইতিহাস, বহু সৃষ্টি। একটা সময় নীলকর সাহেবদের অধীনে ছিল এটি। ১৮৪০ সালে জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিলামে এই বাড়িটি কিনে নেন। তখন এই বাড়িটিরও রূপ বদলে যায়। একসময় এই বাড়ি ছিল নীলকর সাহেবদের আড্ডা; উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি এসে সেটাই হয়ে গেল বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের কাছারি এস্টেট। এখানেই হয়ত ব্যাপারটা থেমে যেত, যদি না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের মানুষটি এখানে আসতেন…।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার এই কুঠিবাড়িটির গুরুত্ব অনুধাবন করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহপূর্বক একে একটি জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আগে রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। তিনি নিজে এখানে জমিদারি করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালের দিকে কবি এখানে জমিদার হয়ে আসেন। এবং এখানে তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করেছেন। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩ টাকা ১০ আনায় এই জমিদারি কিনে নিয়েছিলেন। এর আগে কাছারি বাড়ির মালিক ছিল নীলকররা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে বসেই রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, বৈষ্ণব কবিতা, দুইপাখি, আকাশের চাঁদ, পুরস্কার, হৃদয়, যমুনা, চিত্রা, চৈতালী, ইত্যাদি, গীতাঞ্জলী কাব্যের কাজও শুরু করেন। যাতে পরবর্তীতে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। পোস্ট মাস্টার গল্পের 'রতন' চরিত্রও শাহজাদপুরে বসেই লেখা। চিত্রা, শীতে ও বসন্তে, নগর সঙ্গীতে এবং চৈত্রালীর ২৮টি কবিতা, ছিন্ন পত্রাবলীর ৩৮টি, পঞ্চভূতের অংশবিশেষ এবং বিসর্জনের নাটক তিনি শাহজাদপুরে বসেই রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত মোট ৭ বছর এখানে জমিদারির কাজে শাহজাদপুরে অবস্থান করেছেন। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িটি গৌরবময় স্মৃতিরূপে সংরক্ষিত করা হয়। এখন সকল দর্শনার্থীদের জন্য এটি উন্মুক্ত।
প্রতি বছর অনেকে হাজির হন এই বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি, ছবি, ব্যবহৃত জিনিসপত্র-সহ দুটো বোট এবং পালকিও সযত্নে রক্ষিত রয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখেন এসব। বর্তমানে এই পুরো ভবনটি জাদুঘর হিসেবে সাধারণ দর্শকদের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে। জাদুঘরের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ১৬টি কক্ষ রয়েছে । এই ১৬টি কক্ষেই রয়েছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কৃষক বন্ধু রবীন্দ্রনাথ অর্থাৎ নানা বয়সের এবং নানা সময়ের বিচিত্র ভঙ্গির সব ছবি । তার একদম ছোটবেলা থেকে মৃত্যুশয্যায় ছবি পর্যন্ত এখানে সংরক্ষিত আছে। তাছাড়াও এখানে কবির নানান রয়েছে সকল শিল্পকর্ম এবং তার ব্যবহার্য আসবাবপত্র। যা দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো এটি। কবির ব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলোর মধ্যে আরো আছে চঞ্চলা ও চপলা নামের তার ব্যবহার করা দুটো স্পিডবোট, পল্টন, ৮ জন বেহারার পালকি, কিছু কাঠের চেয়ার, টি টেবিল, সোফাসেট, আরাম চেয়ার, পালংক ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস।
কিন্তু দৃষ্টি একটু অন্যদিকে ফেরানো যাক। বেশিদূর নয়, কাছারি বাড়ির চত্বরে ঘুরলেই দেখা মিলবে তার। এটিও একটি পুরনো বাড়ি; তবে ভগ্নপ্রায়। যত্নের কোনো ছাপ নেই। একদিকে রবীন্দ্রনাথের বাড়ির ঝাঁ-চকচকে পরিবেশ, ঠিক পাশেই এমন ভাঙা একটি বাড়ি। গোটা দেহে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। এর পরিচয় কী?
ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে, কাছারি বাড়ির পুরনো অংশ এটি। বর্তমানে যত্নের অভাবে অবস্থা খারাপের দিকে। দরজা, জানলা সব ভেঙে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এই বাড়িটিকেও যাতে মেরামত করে ভালো রূপে ফিরিয়ে আনা হয়, তারই আবেদন করা হয়েছে। আশা করা যায়, শীঘ্রই এই ইতিহাসটিরও যত্ন হবে। কাছারি বাড়ি মিউজিয়ামের পাশে এটিও দাঁড়িয়ে থাকবে ফেলে আসা সময়ের সাক্ষী হয়ে…।