সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক, আমাদের প্রিয় মিনু আপা
কাজী সুফিয়া আখ্তার
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:১০ এএম, ৫ আগস্ট ২০২১ বৃহস্পতিবার
কাজী সুফিয়া আখ্তার
সংবাদ পত্রিকা অফিস তখন বংশাল রোডে। চট্টগ্রাম থেকে কয়েক মাস হলো ঢাকায় এসেছি। ঢাকা আমার কাছে অচেনা শহর। ১৯৮৩ সালের কোনো একদিন সাহসে ভর করে ঠিকানা ধরে খুঁজে খুঁজে দুরু দুরু বুকে গেলাম সেই অফিসে। প্রথমে মেয়েদের পাতার সম্পাদকের খোঁজ করলাম। জানলাম তিনি সকালের দিকে অফিসে সাধারণত আসেন না। কোন সাহসে জানি না আমি সাহিত্য সাময়িকী পাতার সম্পাদকের কথা বলতেই একজন আমাকে 'আসেন আমার সাথে' বলে একটি রুমে তাঁর টেবিলের কাছে নিয়ে গেলেন। বেশ কয়েকজন একই রুমে বসে কাজ করছেন। আমি পরিচয় দিয়ে লেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। ইতোপূর্বে ঢাকার পত্রিকা দৈনিক সংবাদ-এর মেয়েদের পাতায় দুটো লেখা ও সচিত্র সন্ধানীতে আমার একটি ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে। তিনি দেখেছেন বললেন। মহিলা পরিষদ করি শুনে তিনি আমাকে আরেকটি রুমে নিয়ে গেলেন। একটা বড় টেবিলে কয়েকজন নিবিষ্ট মনে কাজ করছেন। একজনের কাছে গিয়ে 'মিনু' বলে ডাক দিলেন। তিনি চোখ তুলে তাকাতেই আমাকে দেখিয়ে দিলেন এবং চলে গেলেন। আমার সাথে মিনু আপাই কাজ করতে করতে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। আমি জানলাম মেয়েদের পাতার সম্পাদক শামীম আখতার। সাহিত্য সম্পাদকের নামও জানা হলো। চা খাওয়ালেন। আমি মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এলাম। তাঁর ব্যবহার, কথাবার্তার সৌজন্য, মিষ্টি, স্নিগ্ধ সুষমায় ভরা মুখ আমার হৃদয়ে গভীরভাবে আঁকা হয়ে গেল! সেই মুগ্ধতা আজো কাটে না।
মিনু আপার সাথে মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় অফিসে দেখা হতো। মাঝে মাঝে সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে। আমি এনজিওতে চাকরি নিয়ে বিভিন্ন জেলাতে যাই। ফিরে এসে একবার শামীমের পুরান ঢাকার দেড়শো বছরের পুরাতন বাড়িতে পা ছড়িয়ে বসে কফি পান করতে করতে প্রাণখোলা আড্ডা দিতে যাই। মাঝেমধ্যে সেই আড্ডাতে মিনু আপাও আসেন। ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে মিনু আপার সঙ্গে তাঁর মাধুর্য্যময় খোলা মনের প্রশস্ততায়। আরও বাড়লো সংবাদে লেখার মধ্যে দিয়ে। নাসিমা হক নামে মিনু আপা কলাম লিখতে শুরু করেন। আমরা তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম। এতো ভালো লিখতেন কিন্তু কেন জানি লেখা বন্ধ করে দিলেন। সুফিয়া কামাল এর জীবনীগ্রন্থের পরে তাঁর আর কোনো বই প্রকাশিত হয়নি।
মিনু আপা চটপট খুব ভালো রান্না করতে পারেন। আমি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদের সম্পাদিকা থাকাকালীন 'মুক্তিযুদ্ধদিনের স্মৃতি' গ্রন্থটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। আমাকে তখন অনেকদিন কাঁশবন মুদ্রায়ণ,নবাবপুরে যেতে হয়েছে। তখন আমি বেশ কয়েকদিন মিনু আপার বাসাতে গেছি। তখন আমার টেলিফোন ছিল না। আগে জানান দিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। একদিন দুপুরে প্রেস থেকে আমিও তাঁর বাসাতে গেছি, তিনিও কেবল অফিস থেকে ফিরেছেন। বৈশাখের গরমে মাথার চান্দী ফেটে যাওয়ার উপক্রম। ওমা মিনু আপা আমাকে দেখেই একগাল হাসি উপহার দিলেন। তারপর ছটপট ঘরে ঢুকে ফ্রিজ খুলে কই মাছ বের করে পানিতে ভিজালেন। লেবুর শরবত করলেন। গল্প করতে করতে তৃপ্তি নিয়ে তা শেষ করলাম দু'জনে। তারপর আমার হাতে ভারতীয় একটা পত্রিকা ধরিয়ে দিয়ে তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন। পয়তাল্লিশ মিনিটে টেবিল ভর্তি খাবার। খেয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি। কবিতা পড়া। সুদৃশ্য কাপে বিকেলে চা পান করে দু'জনেই মহিলা পরিষদের অফিসে।
মিনু আপা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদের সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনো মহিলা পরিষদের কাজে যুক্ত আছেন। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এক সময়ে কবিতা লিখতেন। গানও করতেন। বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। এখন ছাদবাগানে অনেক ফুল ফোটান। নিয়মিত গাছের যত্ন নেন। বই পড়তে ভালোবাসেন। আর সুদূর আমেরিকায় থাকা একমাত্র সন্তান দিঠি ও একমাত্র নাতনি শ্রেয়সীর সঙ্গে গল্প করতে ভালোবাসেন। সঙ্গীত প্রিয় পুরো পরিবার।
হাসনাত ভাই মৃত্যুবরণ করেছেন আজ দশ মাস হতে চলছে।
আজ ৪ অগাস্ট। মিনু আপার জন্মদিন। ভেবেছিলাম তাঁর সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়িতে যাবো। লকডাউনের জন্য তাঁর বাসাতে যাওয়া হল না। সহজ ছন্দে চলার প্রিয় মানুষ মিনু আপা ভালো থেকো সবসময়। ফুলের গন্ধ বিলিয়ে যেও মানুষের মধ্যে।
শুভ জন্মদিনে অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
৪ অগাস্ট ২০২১
কাজী সুফিয়া আখ্তার : লেখক ও সমাজকর্মী