ঢাকা, মঙ্গলবার ৩০, এপ্রিল ২০২৪ ২১:১৫:৩৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ছোটগল্প: দায়িত্ব

সোমা দেব

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৪০ পিএম, ৭ জানুয়ারি ২০২২ শুক্রবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

-'এটাই পাত্রীর সেই আইবুড়ি খালাটা না? এখনও বিয়ে হয় নাই?'

বিয়েবাড়ির খাবার টেবিলে বসে রোস্টের বাটি থেকে একটা লেগপিস নিচ্ছিলাম। সেসময় টেবিলের অপর প্রান্তে বসা দুই নারীর কথপোকথন কানে এলো। আর কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে এটাও নিশ্চিত হলাম।

ওনারা দু'জন আড়চোখে আমাকেই দেখছিলেন। আর পাত্রীর মানে যার বিয়ের খাবার খাচ্ছি তার খালামণি আমিই। 

অন্যজন আবার বলে উঠলেন, 'হ্যাঁ পলি আপা, এটাই সেই খালা। দেখতে তো মোটামুটি, একেবারে খারাপ না। এখনও বিয়ে হয়নি কেন, কে জানে! নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা আছে।' 

বলাবাহুল্য, আমাকে নিয়ে এসব কথা হচ্ছে। আর আমি চোখ-কান বন্ধ করে খেয়ে যাচ্ছি। বিষয়টা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু, বিয়ে বাড়ি, তাও আবার আমার ভাগ্নীর বিয়ে। তাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছি। 

আমি বাড়ির সবার ছোট, আমার মায়ের 'পেটপোছা' যাকে বলে। আমার সবচেয়ে বড় বোন আমার চেয়ে ঊনিশ বছরের বড়। তারপর মেজো আপা, বড় ভাইয়া, মেজো ভাইয়া, ছোট ভাইয়া। এরও দশ বছর পর আমার জন্ম। আমি ঢাকায় থাকি৷ বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে বেশ ভাল পদে চাকরি করি। 

আমার বড় ভাইবোনেরা সবাই বিয়ে করেছে। আমি সবার ছোট বলে অনেক আদরেই মানুষ করেছে সবাই। কেউ কোন কিছু নিয়ে আমার উপর খবরদারি করে না। আমিও তেমন ভাবেই বড় হয়েছি, কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই আমার আর মাথা ঠিক থাকে না। এমনকি অফিসেও কারও উপর কোন অন্যায় হলে আমিই ছুটে যাই বসের কাছে। 

তখন কীভাবে জানি না, আমার একটা শক্তি চলে আসে। কোথায় এত মনোবল পাই জানি না। কিন্তু সেই অন্যায়কে দমিয়েই ছাড়ি। এজন্য অফিসে আমাকে অনেকেই সমঝে চলে, অনেকে ভরসার চোখে দেখে, অনেকেই ভালবাসে। কোন সমস্যা হলেই আমার কাছে ছুটে আসে। আমি পারি না পারি তাদের পক্ষ হয়ে লড়তে পারি। 

টেবিলের অপর প্রান্তে বসা একজন নারী রীতিমতো তার ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করে বলেই বসলেন, 'আচ্ছা, আপনি মেয়ের ছোট খালা না? আপনার এখনও বিয়ে হয়নি?' 

আমি যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে বলার চেষ্টা করলাম, 'আমার বিয়ে হয়নি না। আমি বিয়ে করিনি। আর এখনও মানে কী বোঝাচ্ছেন?' 

ওনারা আর উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। হঠাৎ হট্টগোলে আমরা সবাই ঘুরে তাকালাম। আওয়াজটা আসছে বরকে যেখানে বসানো হয়েছে সেখান থেকে। বরের বড় বোনজামাই চেঁচামেচিটা করছেন। 

আমার উল্টো পাশে যে দু'জন নারী এতক্ষণ বসেছিলেন তারা বরের বড় বোন। এদের একজনেরই স্বামীর গলা পেয়ে খাবার ফেলে দৌঁড়ে চলে গেলেন তারা। আমিও পেছন পেছন গেলাম। 
বরের সামনে খাবারের যে থালা সাজিয়ে দেয়া হয়, সেই সাগরানা প্লেটে মুরগির রোস্ট ছোট আর আইটেম কম ছিলো, এই অভিযোগ করে প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন সেই ভদ্রলোক! আর খুব চেঁচাচ্ছেন, 'আমরা কি ছোটলোক? বস্তি থেকে আসছি? যেনতেন ভাবে আমাদের আপ্যায়ন করা হয়?' 

এমন ভাষায় কথা শুনতে আমরা ভাইবোনেরা মোটেই অভ্যস্ত নই। আমার ভাইবোনেরা আর দুলাভাইরা অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন। সবার একই প্রশ্ন, এমন আচরণ করছেন কেনো ওই ভদ্রলোক?

সাগরানায় মোটেও কম আইটেম ছিলো না। ছোট মুরগিও দেয়া হয়নি। আমার দুলাভাই, বড় ভাইয়া নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাজার করেছেন। তাহলে সমস্যা কোথায়? আমি ওদের এমন ব্যবহার দেখে ভাবলাম, অসম্ভব, এই অসভ্য লোকজনের পরিবারে আমি কিছুতেই সেঁজুতির বিয়ে হতে দেবো না আমি। এটা ভেবে আমি কেবলই বলতে যাচ্ছিলাম, 'আপনারা যা, সেতো নিজের মুখেই বলে দিচ্ছেন। এখনি বেরিয়ে যান এ বাড়ি থেকে। ' 

পরিস্থিতি বুঝে মেজো ভাইয়া আমাকে খপ করে হাত ধরে আটকে দিলেন।  বললেন, 'থাক। বিয়ে বাড়িতে হাজার কথা হয়। হয়তো আমাদেরই ভুল ছিল। তুই আর ঝামেলা বাড়াস না। ' 

একথা বলেই ওদের আবার বুঝিয়ে-সুজিয়ে খেতে বসালেন। বড় বড় রোস্ট, রেজালা সব এনে পাত উপচে খাওয়াতে লাগলেন। উল্টো ক্ষমা-টমাও চাইলেন। আমার খুব আশ্চর্য লাগলো। এ রকম মানসিকতার লোকজনের সাথে সেঁজুতি সারাজীবন  থাকবে কী করে!

সেঁজুতি আমাদের খুব আদরের ভাগ্নী। আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। সম্পর্কে ও আমার ভাগ্নী হলেও আমরা  দুজন বোনের মতোই বড় হয়েছি। খুব লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে ও। তবে ওর একটাই সমস্যা, একদম পড়াশোনা করতে চাইতো না। তাই কোনোভাবে বাড়ির কাছে একটা কলেজ থেকে এমএ পাস করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে ওর বাবা-মা। 

আমি বরাবরই ভাল ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ভাল সাবজেক্টে পড়াশোনা করে চাকরি করছি৷ আমার মতো মানসিকতার কাউকে না পেলে বিয়ে করবো না একথা বাসায় বলে দিয়েছি৷ তাই আমার বিয়ের অপেক্ষা না করে সেঁজুতিকে বিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে।

ওর জন্য ছেলে দেখার বা কথা পাকাপাকির সময় আমি ছিলাম না। ওর বাবা-চাচারাই ছেলে দেখেছে। নানা কথা বলে পাত্র ঠিক করেছেন। আর সেঁজুতিরও কোন আপত্তি ছিলো না। তাই এখানেই বিয়ে ঠিক করেছেন সবাই মিলে। 

আমি অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি বিয়ে খেতে। এইতো কিছুক্ষণ আগেই পার্লার থেকে ওকে সাজিয়ে বিয়ের আসরে বসিয়ে রেখে এসেছি। 

আমি একটু দূরে দূরেই ছিলাম। বিয়েবাড়ির নানা লোকজন আমাকে নিয়ে নানা কথা বলবে। এসব আমার ভালো লাগে না। আবার বিয়েবাড়িতে এদের এসব কথার উত্তর দেয়ার মতো মানসিকতাও আমার নেই। বিয়েবাড়িতে এদিক সেদিক ঘুরতেই নানা কথা কানে আসছিলো, 'এত বড় খালার সামনে ভাগ্নীর কেনো এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছে?'

-'নিশ্চয়ই প্রেমের বিয়ে! নাহলে উপযুক্ত খালা ফেলে এই মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে কেনো?' 

এরকম নানা কথায় খুব বিরক্ত লাগছিলো। সেজো আপা বুঝতে পেরে আমাকে তাড়াতাড়ি বরযাত্রীদের সাথে খাবার খেতে বসিয়ে দেন। আর ঠিক এসময়ই এমন একটা কাণ্ড করে বসলো বরের বোন জামাই। আমাকে মেজো ভাইয়া জোর করে সরিয়ে নিয়ে এলো ওখান থেকে। বিয়ে সারা হয়ে গেলে সেঁজুতিও বরের বাড়িতে চলে গেলো৷ 


এর একদিন পর আমারও ছুটি শেষ হয়ে গেলো। যদিও তখন বাড়ি ভর্তি লোকজন। কিন্তু আমি ঢাকায় চলে এলাম। এসে অফিস করা শুরু করলাম।

অফিসে কাজের চাপে বাসায় খুব একটা কথা বলতেও পারি না। তবে আপা আর আম্মার কাছে জানতে পারি সেঁজুতি বেশ ভালো আছে। মন দিয়ে ঘরসংসার করছে। এর মধ্যে দুয়েকবার বাড়িতে এসে ঘুরেও গেছে বরসহ। এসব শুনে আমি স্বস্তি পাই। যাক, বিয়েবাড়িতে যেমন অস্বস্তিদায়ক একটা ব্যাপার ঘটেছিল, সেটা তাহলে মিটে গেছে। আমিও আবার কাজের চাপে ডুবে যাই৷ 

বেশ কিছুদিন পর মেজো ভাইয়া একটু যেনো ভয়ে ভয়েই আমাকে ফোন করলেন। ওর গলায় কেমন যেনো একটা অস্বস্তির সুর পেলাম৷ কিন্তু আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ক এমন নয়। আমরা একে অপরের সাথে খুব সহজ সম্পর্কটাই বজায় রাখি। আর আমি ছোট বলে সবাই আমাকে ভালবেসে প্রশ্রয় দেয়। কী এমন হলো, ভাইয়া এভাবে কথা বলছে? আমিই বললাম মেজো ভাইয়াকে, 'ভাইয়া, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?'

ভাইয়া বললেন, 'হ্যাঁ কান্তা। কিন্তু তুই রাগ করতে পারবি না। আম্মা আমাকে তোর কাছে বলতে বলেছেন বলেই বলছি। আমরা তো তোর মঙ্গল চাই, তাই না? তোকে কত ভালবাসি। ভালবাসি বলেই তো...' 

আমি ভাইয়াকে থামালাম, 'কী হয়েছে বলবে তো?' 

ভাইয়া বললেন, 'সেঁজুতির চাচাতো ননদের ছেলে তোর বয়সী হবে, ডাক্তার। তোর সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে সেঁজুতি। ওরা বলেছে, মেয়ে দেখতে সুন্দর হলেই হবে। লেখাপড়া কম হলেও আপত্তি নেই। সেঁজুতি বলেছে, খালামণি দেখতেও সুন্দর, পড়াশোনাতেও ভাল।'

ঝরঝর করে মুখস্ত ডায়লগের মতো কতাগুলো বলে গেলেন মেজো ভাইয়া। আর আমার মনে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে, শুধু সুন্দর হলেই হবে, আর আমার সাথে তার বিয়ে! তাহলে আমি এত কষ্ট করে পড়াশোনা করলাম কী করতে? তাহলে তো বাড়িতে বসে শুধু চাল, ডাল, আলু, শশা, পেঁপে বাটা মুখে মাখলেই চলতো। এত খাটাখাটুনি করে পড়াশোনার কী দরকার!

এসব ভাবতে ভাবতে রাগে গা শিরশির করে উঠলো। কিন্তু মেজ ভাইয়ার উপর কোনো রাগ দেখালাম না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।  শুধু বললাম, 'ভাইয়া আমি এসব নিয়ে পরে কথা বলবো।'

ভাইয়াও হয়তো বুঝতে পেরে সেসময় ফোন রেখে দিলেন। মেজো ভাইয়া আমার মেজাজমর্জি অন্যদের থেকে ভাল বোঝেন। ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেছে মনে করে এই বিষয়ে আর অন্য কারো সাথে কথা বলিনি৷

কিন্তু তিনদিন পরই হঠাৎ আম্মার ফোন। ফোন রিসিভ করতেই আম্মার গলা ছেড়ে কান্নার আওয়াজ। ফোনের ওপাশ থেকে বলে যাচ্ছেন, 'কান্তা, তুই কি কোনদিনই বুঝবি না কিছু? শ্বশুরবাড়িতে সেঁজুতির মুখ রাখলি না। ও এত বড় মুখ করে তোর কথা বললো ওর ননদের ছেলের জন্য আর তুই মানা করে দিলি?' 

আমি বললাম, 'মা, আমি তো কিছু বলিনি। তবে সত্যি এখানে বিয়ে করার আমার কোন ইচ্ছা নেই।' 

আম্মা আরও ডুকরে কেঁদে উঠলেন। রীতিমতো বিলাপ করছেন। শুধু ডাক্তার পাত্র পেয়ে নাকি নাতনী সেঁজুতির মান বাঁচাতে তিনি এমন করছেন! নাকি আমাকে পাত্রস্থ করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ভেবে আম্মা ফোনে অনবরত কেঁদেই চলেছেন।

আম্মার এহেন কার্যকলাপে আমি বাকরুদ্ধ। আম্মাকে কোনরকমে থামিয়ে ফোন রাখতেই একে একে বড় আপা, মেজো আপা, ভাইয়া, ভাবীদের ফোন আসতে লাগলো। সবার এক কথা, 'তুই একবার আম্মার কথা শোন। একবার পাত্রটা দেখে আয়। ওরা তোকে পছন্দ করবেই। তুই পরে মানা করে দিস।  আম্মা ফোন করে করে সবাইকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে।'  

সবার অনবরত ফোনে বিরক্ত হয়ে, আম্মার কথা রাখতে বাধ্য হয়ে আমি আবার বাড়িতে এলাম। সেঁজুতির শ্বশুর বাড়ি থেকে সবাই মিলে ঘটা করে আমাকে দেখতে এলো। এর চেয়েও অবাক ব্যাপার, এত আয়োজন করে দেখে ওরা আমাকে নাকচ করে দিয়ে চলে গেলো৷   
পরে ওরা জানালো, আমি অনেক মোটা। সুন্দরী কিন্তু এত শিক্ষিত, চাকরিজীবী পাত্রী ওদের দরকার নেই। ওরা আমাকে বডিশেমিং করেছে এটা ভাবতেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার।  তাছাড়া আমি নাকি বয়স্ক, ছেলের সমবয়সী। 

আচ্ছা, ওরা এতকিছু জেনেও কেন আমাকে দেখতে এসেছিলো! নাকি ইচ্ছা করে অপমান করে গেলো বুঝতে পারছি না। আমি কার উপর রাগ ঝাড়বো সেটাও বুঝতে পারছি না। বাড়ির সবার উপর অনেক রাগ করে ঢাকায় চলে এলাম।  ফোনও দিলাম না কাউকে। 
আমি চাকরি-বাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতেই প্রায় এক বছর চলে গেছে। ওই ঘটনার পর সবাই এমনকি আম্মাসহ আমার সাথে সমঝে কথা বলেন। বিয়ে নিয়ে খুব একটা কথা বলেন না আম্মা। 

একদিন বড় আপাকে ফোন দিয়েছি। নানা কথার পর আপা বললেন, 'সেঁজুতির বাচ্চা হবে, তাই বাড়ি এসেছে। স্বামী বলে দিয়েছে ছেলে হতে হবে। তা না হলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।' 

একথা শুনে ভীষণ রাগ উঠে গেলো আমার।  বললাম, 'এটা কী ধরনের কথা বড় আপা? ওর বর জানে না, সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে এটা মায়ের উপর নির্ভর করে না?'

বড় আপা বললেন, 'এই কথা কি আমি বোঝাতে পারি মা হয়ে?' 

কিছুক্ষণ কথার পর ফোন রেখে দিলাম। আমি বিয়ের দিনই বুঝেছিলাম এই পরিবারের মানুষগুলো বেশি সুবিধার নয়। কিছুদিন পর সেঁজুতির ফুটফুটে একটি মেয়ে হলো৷ তখন আমিও ছুটি নিয়ে সেঁজুতির মেয়েকে দেখে এসেছি। কী মায়াময় চেহারা! 

সেঁজুতি মেয়ে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি ফিরে গেলো বটে। তবে আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেনি। মেয়ে হওয়াতে উঠতে বসতে ওকে নানা খোঁটা শুনতে হয়েছে। আমার ভাইয়ারা, দুলাভাই সবাই মিলে সেঁজুতির শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে এসেছে ওর স্বামীকে। কিন্তু ওরা নানাভাবেই মানসিক নির্যাতন করতে থাকে সেঁজুতিকে।

কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারও সেই একই ঝামেলা। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জানালেন, 'জানিস, সেঁজুতির বর তো সেঁজুতিকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। ওই ছেলে নাকি আবার বিয়ে করবে!' 

আমি বললাম, 'আম্মা, সেঁজুতিকে নিয়ে চলে আসো আর ওই ছেলের নামে পুলিশে নালিশ করো'।

আম্মা আবারও কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'পুলিশের ঝামেলা করলে তো আমাদেরই মান সম্মান যাবে। আর মেয়েসহ ওর দায়িত্ব কে নেবে এখন বল? তুইও তো গোঁ ধরে বসে আছিস। তোর দায়িত্ব কাউকে দিতে পারছি না। মেয়ে মানুষ তোরা। তোদের দায়িত্ব কাউকে দিয়ে যেতে না পারলে মরেও তো শান্তি পাবো না আমি!'

আম্মার মুখে এসব শুনে আমি হতাশ হয়ে বসে থাকি।  তবে আম্মার মুখের ওপর কথা বলি না। 

এদিকে সেঁজুতি আর আমাকে নিয়ে চিন্তায় আম্মা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ফোন করলে বড় ভাইবোনেরা এই কথাই বলেন সবসময়। ওরা সেঁজুতিকে ডিভোর্স দিয়ে নিয়ে আসতে চাইলেও আম্মা সায় দেয় না। এখন সেঁজুতির দায়িত্ব কে নেবে, ওর মেয়ের দায়িত্ব কে নেবে, বাবা-মা কী সারাজীবন ওকে পালবে এসব বলে আম্মা প্রায় সময়ই কান্নাকাটি করেন। আমারও ভাল লাগে না এসব শুনতে, খুব কষ্ট হয়।

মাঝে মাঝে ছুটি পেলে বাসায় যাই আম্মাকে দেখতে। আম্মার সবসময় একই কথা। আমাকে দেখলেই বলতে থাকেন, 'মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছিস। বাঁধন আলগা হয়ে কতদিন ঘুরবি? তোর দায়িত্ব কারও হাতে দিয়ে যেতে না পারলে মরে গিয়ে তোর বাবাকে কী জবাব দেবো?'

আমি বলি, 'আম্মা, একবার তো আমাকে দেখিয়ে অপমানিত হলে। আমি কি তোমাদের বোঝা হয়ে আছি? আমি কি কারও কাছে হাত পেতেছি? আমি তো দিব্যি আছি। বিয়ে যখন করার, করবো৷ তবে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য না, জীবনে ভাল পার্টনার পাওয়ার জন্য বিয়ে করবো।'

আমার কথা শুনে আম্মা বলেন, 'তোদের কথাবার্তা বুঝি না বাপু। তোদের যা ইচ্ছা কর! যা এখন সামনে থেকে!'

বুঝি আম্মা ভীষণ রেগে গেছেন। ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় পরের দিন আবার ঢাকায় চলে আসি। চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এর মধ্যে অফিসের কাজে থাইল্যান্ডে একটা ট্যুরে গিয়েছিলাম। ট্যুর শেষে ফিরে বন্ধুদের একটা গেট টুগেদার ছিল।  কয়েকদিন খুব ব্যস্তই ছিলাম।

ব্যস্ততার মধ্যেই একদিন অফিসের একটা প্রয়োজনে ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডের একটা কফি শপে বসে আছি। একজনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাইরে তুমুল বৃষ্টি, আর সেই ব্যক্তির আসারও কোন খবর নেই। ফার্মগেটে ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছেন উনি। ফোনে জানালেন একটু আগে। আমি একাই বসে আছি। 

হঠাৎ স্ক্রেচারে ভর দিয়ে কফি শপে এক ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখলাম। তাকে খুব পরিচিত লাগলো। উনি একটা টেবিলে বসে কফি অর্ডার করলেন। কেন জানি না, একটু ইতস্তত করেও ওনার সামনে গেলাম। 

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি। ও আমাদের ক্লাসের সিহাব। খুব মেধাবী ছিল। কিন্তু জন্মগতভাবেই একটা পায়ে ত্রুটির কারণে সারাক্ষণ স্ক্রেচারে ভর করে হাঁটতো। গত নয় বছরে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে সিহাবের। একটু মোটা হয়েছে। সেই শুকনো রোগা বাচ্চা বাচ্চা চেহারার ছেলেটা যেনো অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। অনেকদিন দেখা নেই আমাদের বন্ধুদের সাথে সিহাবের। আগে থেকেই কেন যেন ও একটু আড়ালে থাকতেই পছন্দ করতো। ওর সামনে দাঁড়াতেই আমাকে চিনতে পারলো ও।  বলে উঠলো, 'কান্তা না!' 

আমি হাসতে হাসতে ওর সামনে বসলাম।  কতদিন পর দেখা! বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলো, ক্লাস, লাইব্রেরি, আড্ডা, হল, গ্রুপ, সংগঠন, ফুচকা, চটপটির গল্প- অনেক কথাই হলো। 

আমরা নিজেদের খোঁজ নিচ্ছিলাম অনেক দিন পর। সিহাব প্রথাগত কোন চাকরি-বাকরিতে ঢোকেনি। ও নিজে একজন উদ্যোক্তা। সমাজের দুঃস্থ নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছে। ওর তত্ত্বাবধানে প্রায় আশি জন নারী কাজ করছে। 

আমি সিহাবের মুখে এ কথা শুনে প্রথমে খুব অবাক হয়েছি। আমরা ভেবেছিলাম সিহাবের মতো এত মেধাবী ছাত্র হয় বিসিএস ক্যাডার হবে না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। অথচ এসব কিছু না ভেবে যে ও সমাজসেবা করছে, এটা ভেবে খুব অবাক লাগলো। আমি ওর এই মানসিকতার সাথে আগে পরিচিত ছিলাম না। তবে ওর এই প্রচেষ্টার কথা শুনে খুব ভাল লাগলো।  কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, 'ভাবী কী করেন? ছেলেমেয়ে আছে?' 
হো হো করে হেসে সিহাব উত্তর দিলো, 'বিয়ে না করলে ভাবী আসবে কোত্থেকে?' 

বলে আবারও এক চোট হাসলো সিহাব। তারপর বললো, 'জানো কান্তা, অনেক দুঃস্থ নারীর ভাগ্য পরিবর্তনের দায়িত্ব আমি হয়তো নিয়েছি। কিন্তু কোনো বাবা-মা তার মেয়ের দায়িত্ব আমাকে দিতে চান না। আমি দায়িত্ব নিতেও চাই না। আমি শুধু একজন জীবনসঙ্গী খুঁজেছিলাম। কিন্তু কেউ আমার খোঁড়া পাটাকে পছন্দ করলো না।' 

খুব অল্প সময়ে, কফি খেতে খেতে যেনো সিহাব আমাকে ওর কষ্টের অনেক কথাই বলে ফেলছিলো অকপটে। যেনো পুরনো বন্ধুত্ব হঠাৎ দেখায় নতুন রূপ পাচ্ছিলো। সিহাব এতটুকু বলতেই আমার অফিসের সেই ব্যক্তিকে ঢুকতে দেখলাম।

সিহাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি অফিসের কাজে বসলাম, অন্য টেবিলে। কিছুক্ষণ পর সিহাবও ইশারায় হাত নেড়ে কফি শপ থেকে বের হয়ে গেলো। আমি সেই ব্যক্তির সাথে অফিসিয়াল কথায় মনযোগ দিলাম।
এই ঘটনার পর বেশি কিছু দিন কেটে গেছে। তারও অনেক দিন পরের কথা। আমি আর সিহাব কলাবাগানের একটি বাসায় একসাথে থাকি। আমি সিহাবকে বিয়ে করেছি। সেদিন কফিশপ থেকে ফিরে গিয়ে কোথায় যেনো সিহাবের জন্য একটু কষ্ট হচ্ছিলো, মায়া হচ্ছিলো। যেন ওর শূন্যতা, ওর ভেতরের হাহাকার আমাকেও স্পর্শ করেছিলো। ও যে সত্যি একজন মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটা যেনো আমি মন থেকে উপলব্ধি করেছিলাম।

সিহাবের সাথে সেদিনের পর থেকে আমার অল্প বিস্তর কথা হতো। আমরা নিজেদের ভাললাগা শেয়ার করি। মানসিকভাবে খুব কাছে চলে আসি। ওর সমাজসেবার বিষয়ে আমার ইতিবাচক চিন্তা, প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আমার পরামর্শ, নারীদের নিয়ে কাজে আমার সহযোগিতা ক্রমেই আমার প্রতি ওর নির্ভরতা তৈরি হয়েছিলো। ওর আমার প্রতি এক ধরনের ভরসা তৈরি হয়েছিলো। 

আমিও যেনো এমন একজন মানুষকেই খুঁজছিলাম যার আমাকে প্রয়োজন, আমাকে যে ভালবাসে। আমার যাকে প্রয়োজন, এমন নয়। যে বিষয়টা একসাথে পড়ার সময়, বন্ধু হয়ে আড্ডা দেওয়ার সময় টের পাইনি। একদমই বুঝতে পারিনি। যে আমাকে মোটা বলে, বয়স বেশি বলে খোঁটা না দিয়ে, দয়া না করে জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাববে, আমি যেনো তারই অপেক্ষা করছিলাম। 

বেশ কিছুদিন পর আমিই ওকে প্রপোজ করি। সত্যি কথা বলতে ও প্রথমে আমার পরিবারের কথা ভেবেছিলো। সামাজিক বাধার কথা বলেছিলো। ওর প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছিলো। কিন্তু আমাদের নিজেদের বোঝাপড়া, সম্পর্কের দায় থেকে সরে যেতে পারেনি। 

আমাদের বিয়ে হয়েছে একবছর আগে। আমি আমার চাকরির পাশাপাশি সিহাবের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানেও সময় দেই। আমার দায়িত্ব কাউকে নিতে হয়নি। বরং আমি সিহাবের দায়িত্ব নিয়েছি। ওকে মানসিকভাবে ভালো রাখার দায়িত্ব, আমাদের প্রতিষ্ঠানকে বড় করার দায়িত্ব, সমাজের দুঃস্থ নারীদের এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব। শারীরিক অক্ষমতা যেনো সিহাবের ভাল কাজের একনিষ্ঠতাকে নষ্ট না করতে পারে সেই দায়িত্ব আমি নিয়েছি।

বিয়ের দিন আমাদের অনেক আত্মীয়-প্রতিবেশী-পরিচিত অনেকেই আমার রুচির নিন্দা করেছে। 

-'কেন 'খোঁড়া' ছেলেকে বিয়ে করলাম'।

-'এর চেয়ে কত ভালো ছেলে ওদের হাতে ছিলো'।

-'এত বেছে শেষ পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ছেলেকে বিয়ে করলাম, তাও আবার চাকরি নেই'।

-'খোঁড়া ছেলে কান্তাকে কীভাবে পালবে?' এসব নানা কথা কানে এসেছে।

কিন্তু আমার মা এসব কথা গায়ে মাখেননি, আমি যে বিয়ে করছি তাতেই খুশি।  তাদের বলেছেন, 'অত বুঝে তোমাদের কাজ নেই বাবারা৷ কান্তা তো তোমাদের বাড়ি খেতে পরতে যাচ্ছে না!' 

বিয়ের পর আমরা সংসার গুছিয়েছি। অফিস শেষে যখন দু'জন দু' কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসি, নিজেদের কাজের, সংসারের গল্প করি তখন মনে হয়, দিন শেষে এতটুকুই প্রয়োজন। একটু মানসিক সাপোর্ট, একজন কথা বলার মানুষ।

ও হ্যাঁ, সেঁজুতিকে আমি নিজ দায়িত্বে শ্বশুর বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। ওর স্বামী যখন ওকে ডিভোর্স দেবে বলে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছিল, ও কেঁদে আমাকে ফোন করে এসব কথা বলেছিলো। আমি একদিন সময় নিয়ে ওকে আমার কাছে এনেছি। ওর স্বামীর সাথে ডিভোর্স করিয়েছি।  সিহাবের প্রতিষ্ঠানে ওর চাকরির ব্যবস্থা করেছি৷ আর সবচেয়ে ভাল খবর হলো এখানেই ও ওর নিজের মতো জীবন সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে। ছেলেটা সিহাবেরই বন্ধু। 

সপ্তাহ শেষে ছুটির দিন আমার বাসায় সবাই মিলে দারুণ আড্ডা চলে। সেঁজুতির মেয়ে সেদিন সারাবাড়ি ছুটে বেরিয়ে দারুণ জমিয়ে রাখে আমাদের। #