প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য ফেরাতে ভারতীর উদ্যোগ
ফিচার ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৭:৩৪ পিএম, ৯ মে ২০২২ সোমবার
সংগৃহীত ছবি
রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সনাতন পরিবারে জন্মগ্রহণকারী হতদরিদ্র এক সংগ্রামী নারী ভারতী রানী সেন। স্থানীয় নারী সমাজকে সংগঠিত করে গ্রামবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এখন ওই অঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়নের আইকন হয়ে উঠেছেন।
রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা গঙ্গাদাস বরাইপাড়া গ্রামে ১৯৭৭ সালে তার জন্ম। নয় সদস্যের পরিবারে ভারতী তার তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে পঞ্চম। চরম দারিদ্র্যের কারণে শৈশব থেকেই তাকে অনেক কষ্টে বেড়ে উঠতে হয়েছে। অসংখ্য বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তাকে এগুতে হয়েছে। মাত্র ছয় বছর বয়সে বাড়ির উঠানে খেলার সময় একটি তীর ভারতীর ডান চোখে আঘাত করলে ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি।
সম্প্রতি জীবনের কঠিন পথপরিক্রমার বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতী বলেন, ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর, আমার বাবা-মা আমার ভবিষ্যত নিয়ে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। স্কুলের সহপাঠীরা আমাকে এড়িয়ে চলত। ফলে, হতাশার মধ্যেই আমাকে জীবনকে বয়ে নিতে হয়।
১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার আগে পরিবারে চরম অভাব-অনটনের কারণে, হতদরিদ্র বাবা-মা প্রতিবেশী দরিদ্র দিনমজুর শুশীল চন্দ্র সেনের সাথে তার বিয়ে দেন। তার পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে। ১৯৯৫ সালে তার প্রথম সন্তান কন্যা সঞ্চিতা রানী সেনের জন্ম হয়। পরে আরো দুই পুত্র সাগর চন্দ্র সেন এবং প্রদীপ চন্দ্র সেনের জন্ম হয়।
ভারতী বলেন, পরিবারের পাঁচ সদস্যের জন্য প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। আমার স্বামী প্রায় অসুস্থ হওয়ায় নিয়মিত কাজে যেতে পারতেন না।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতীর সহোদর এক বড় ভাই তার মেয়ে সঞ্চিতাকে লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাকে পাত্রস্থ করেন। পরিবারে অভাবের কারণে তার বড় ছেলে সাগরকে ক্লাস সেভেনেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে এবং একটি হোটেলে মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে চাকরি নিতে হয়।
তিনি বলেন, আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ আমি আশা করেছিলাম, আমার সন্তানরা লেখাপড়া শেষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।
২০০৫ সালে ভারতী স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের একটি মাটি কাটা প্রকল্পে সুপারভাইজার হিসাবে চাকরি পান।
তিনি বলেন, আমি প্রতি মাসে ১,৮০০ টাকা বেতনে ওই প্রকল্পে দু’বছর কাজ করেছি। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পরে আমার জীবনে আবারো ভোগান্তি বেড়ে যায়।
২০০৭ সালে ভারতী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি প্রকল্পের অধীনে স্থানীয় এক কিলোমিটার রাস্তার পাশে রোপণ করা আম, তাল, কাঁঠাল, জলপাই, বরই এবং খেজুর গছের চারা পরিচর্যা করার আরেকটি কাজ পান।
তিনি বলেন, প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি দু’বছর রোপণ করা চারাগুলোর যত্ন করে প্রতি মাসে ৭০০ টাকা আয় করেছি। গাছগুলি এখন স্থানীয় গ্রামবাসীদের প্রচুর ফল দিচ্ছে।
প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর বেঁচে থাকার জন্য জীবন সংগ্রাম ছেড়ে না দিয়ে, ভারতী জীবিকা অর্জনের জন্য কাজের সন্ধান অব্যাহত রাখেন।
২০০৯ সালে এসকেএস ফাউন্ডেশন নমের একটি এনজিও’র কর্মকর্তারা কেয়ার বাংলাদেশের ’সোস্যাল এন্ড ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন অব দি আল্ট্রা পুওর (সেতু)’ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী একটি অংশীদার সংস্থা হিসাবে অত্যন্ত দরিদ্র এলাকা নির্বাচন করতে উক্ত গ্রামে গিয়েছিলেন। প্রকল্পটি তার এলাকার দরিদ্রদের জীবনযাত্রার উন্নতি করতে পারে ভেবে, ভারতী প্রকল্পটির সাথে জড়িত হতে চান। তার দৃঢ আগ্রহ দেখে এসকেএস কর্মকর্তারা ভারতীকে প্রকল্পের জন্য বেছে নেন।
ভারতী তার এলাকার মানুষের জন্য কমিউনিটি নেতৃত্ব, সঞ্চয়ী দল ব্যবস্থাপনা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এনজিও-টি ইউনিয়নের বিভিন্ন 'পাড়া' থেকে ১৪০ জন স্থানীয় নেতাদের নিয়ে হরিদেবপুর ইউনিয়ন ন্যাচারাল লিডারস অর্গানাইজেশন (এনএলও) গঠন করে। ভারতী এ প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এতে করে জনগণের দাবি বাস্তবায়নের জন্য ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার যোগাযোগ ও যাতায়াত বৃদ্ধি পায়।
এসময় তিনি তার গ্রামবাসীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের জীবনে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তন আনার কথা ভাবেন। কারণ তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দারিদ্র্য এবং সামাজিক অভিশাপের দুষ্ট চক্রে আটকা পড়েছিলেন। প্রকল্পটির কমিউনিটি নেতৃত্বাধীন সমন্বিত উন্নয়ন পদ্ধতি মানবসম্পদ, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মূলধন বৃদ্ধির মাধ্যমে রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের জন্য পরিবেশকে সহজতর করে।
আলাপকালে গ্রামবাসীদের মুখে ভারতীর সংগ্রামী জীবনের বর্ণনা মিলে। তারা জানান যে, কীভাবে তারা ২০০৯ সালে ভারতীর নেতৃত্বে কাজ করে চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
ওই গ্রামের গৃহবধু মংলি রানী সেন বলেন, আমরা প্রথমে আমাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সম্মিলিতভাবে সেগুলো সমাধানের সিদ্ধান্ত নিতাম।
গ্রামবাসীরা শুধু প্রকল্পের অনুদানই ব্যবহার করেননি বরং স্থানীয় সম্পদ, সম্ভাবনাকে একত্রিত করে ব্যবহার এবং সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহন করেন। রোগের প্রধান কারণ হিসাবে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের অনুশীলনকে চিহ্নিত করেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীর নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা নিজস্ব সংগঠন গড়ে তোলেন এবং গ্রামের ৬২টি হতদরিদ্র পরিবারকে নিজেদের উদ্যোগে শতভাগ স্যানিটেশন কভারেজের আওতায় আনতে সক্ষম হন।
সেসময় প্রতিবছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে মাঠে ফসল না থাকায় গ্রামবাসীদের সাময়িক অভাব-অনটনে পড়তে হত। তা মোকাবিলা করার জন্য তারা ৩৭জন সদস্য নিয়ে ভারতীকে সাধারণ সম্পাদক করে 'বরাইপাড়া উইমেন সেভিংস গ্রুপ গঠন করেন।
প্রকল্পটির অন্যান্য সুবিধাভোগীদের মতো যমুনা রানী সেন জানান, তিনি ২০১১ সালে বিডব্লিউএসজি থেকে ৮,০০০ টাকা সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে পার্শ্ববর্তী পানবাজারে তার স্বামী অন্ন চন্দ্র সেনের পান ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন।
যমুনা রানী বলেন, আমরা এখন স্বচ্ছল জীবন যাপন করার জন্য ভাল উপার্জন করছি। আমাদের ছেলে অর্জুন এবং গৌতম হাঁস-মুরগির খামারে কাজ করে এবং ছোট ছেলে অজয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।
শ্যামল চন্দ্র সেন জানান, তিনি ২০১১ সালে প্রকল্প থেকে একটি রিকশা ভ্যান পেয়েছিলেন। এখন স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপনের জন্য মালামাল ও যাত্রী বহন করে ভালো আয় করছেন।
এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের আয়বর্ধক কার্যক্রম শুরুর জন্য তাদের দক্ষতার উপর নির্ভর করে প্রকল্পটি প্রতিটি নির্বাচিত পরিবারকে ৭,৫০০ থেকে ১৪,০০০ টাকা পর্যন্ত অনুদান প্রদান করে।
ভারতীর সঠিক নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় তাদের সবাই এখন ভালো আয় করে স্বচ্ছল জীবন-যাপন করছেন এবং তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। ভারতী নিজ উদ্যোগে তখন স্কুলের শিশুদের জন্য বিনামূল্যে কোচিং চালু করেন। তার অনেক শিক্ষার্থী এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর শ্রেনীতে অধ্যয়নরত।
স্থানীয় জনগণের অনুরোধে ভারতী ২০১৫ সালে হরিদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সংরক্ষিত ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে মহিলা সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। তিনি কোন খরচ ছাড়াই উক্ত পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফসহ অন্যান্য সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রামবাসীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। ফলে, এই গ্রামে কেউ এখন আর অভাবী নেই। ভারতী এভাবে জীবনের প্রতিটি বাধাকে জয় করে নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
