খুদি, জুবেদা খাতুন এবং একটি সঙ্গীতের ইতিকথা
তপতী বসু
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৩:২৮ পিএম, ১২ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার
ফাইল ছবি।
১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট। পঞ্চাশ বছরের ফাঁসুড়ে শিবু ডোম ফাঁসি দিতে চলেছে সবে ১৮ বছর পেরিয়েছে, এমন এক সদ্য তরুণকে।ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত লোকজনদের দিকে তাকিয়ে সে হাসে। মঞ্চে উঠিয়ে তার হাত দুটি পিছন দিকে বেঁধে দেওয়া হয়। শিবু গলায় ফাঁসির দড়িটা পরানোর সময় ছেলেটির প্রশ্ন ‘ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’ সেদিন সাহসী তরুণের কথায় চমকে উঠেছিল জেলার সাহেবসহ অন্যান্যরা...!
ফাঁসির আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল একবার দিদির সাথে দেখা করতে চান।
মা-বাবার অকাল মৃত্যুর পর বড় হয়েছিলেন মেদিনীপুর শহরে দিদি অপরূপা দিদির কাছে। আর এক দিদি ‘জুবেদা খাতুন’- রক্তের সম্পর্ক না থাকা শহরের নামী উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন জুবেদা খাতুন। আদরের খুদে-খুদির প্রতি সেদিন নিজের দিদির মত হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন জুবেদা। প্রত্যেক বেলার খাবার তিনিই খাওয়াতেন।
আদালতে মামলা শুরু হলে আনুষঙ্গিক সমস্ত খরচ জুগিয়েছেন জুবেদা খাতুন। ভাইয়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারেনি দিদি অপরূপা। কিন্তু সব বাঁধা কাটিয়ে ছুটে এসেছেন জুবেদা। মেদিনীপুর থেকে মজফ্ফরপুর গিয়ে ক্ষুদিরামের সাথে দেখা করতে দুবার ভাবেননি তিনি। নাই বা থাকলো রক্তের সম্পর্ক, কিন্তু দিদি হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী ভাইয়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ না করে থাকতে পারেননি তিনি।
ভাই যে তাঁর ক্ষুদিরাম বসু।
আর একজন বরিশালের যজ্ঞেশ্বর দে- চারণ কবি মুকুন্দ দাস নামে যাঁকে সবাই চেনে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে, দেশের পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার প্রেরণা জোগাতে যে সব কবিরা গান গেয়ে ও যাত্রাভিনয় করে স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তাদের চারণ কবি বলে।
চারণ কবি মুকুন্দ দাসের লেখা এবং সুর দেওয়া এমন একটি দেশাত্মবোধক গান। যা নিজেই একটি ইতিহাস সৃষ্টি করে- একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংলন্ডবাসী।
হাতে যদি থাকতো ছোরা
তোর ক্ষুদি কি পড়তো ধরা মাগো
রক্ত-মাংসে এক করিতাম
দেখতো জগতবাসী
শনিবার বেলা দশটার পরে
জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো
হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি
বারো লক্ষ তেত্রিশ কোটি
রইলো মা তোর বেটা বেটি মাগো
তাদের নিয়ে ঘর করিস মা
মোদের করিস দাসী
দশ মাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো
তখন যদি না চিনতে পারিস
দেখবি গলায় ফাঁসি ।
অনেকের মতে গানটি রচনা ও সুর করেছেন লোককবি পীতাম্বর দাস৷
জানা যায়, ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিন বরিশালসহ বাংলার অনেক ঘরে সেদিন উনুন জ্বলেনি৷ মুকুন্দ নিজে সারাদিন ঘুরে ঘুরে এই গানটি গেয়েছিলেন ৷ গানের কথা আর সুরে ভেসে যাননি, সেদিন এমন কোনো বাঙালি ছিলেন না!
পরে ‘সুভাসচন্দ্র বসু’ চলচিত্রে লতা মুঙ্গেসকরের কণ্ঠে গানটির সুর দিগ-দিগন্তে ছড়িয়ে যায়! দেশপ্রেমী আর দেশের জন্যে যারা আত্মত্যাগ করে মারা গেছেন, তাঁদের পরিজনদের আজও এই গান অশ্রুসজল করে তোলে৷
দিদি জুবেদা খাতুন- ক্ষুদিরাম আর ভালোবাসার গান ‘একবার বিদায় দে মা...’ আরো সহস্র বছর ধরে জেগে থাকবে সত্যিকার বাঙালির মনে!
