সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালায় একদিন
আইরীন নিয়াজী মান্না
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:২৭ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ রবিবার
নড়াইলে সুলতান সংগ্রহশালায় শিল্পী এস এস সুলতানের সমাধি। ছবি: উইমেননিউজ২৪.কম।
মাথার ওপর শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ। আকাশজুড়ে পেজা তুলোর মত মেঘের ছুটে চলা। গরমটা যেন একটু বেশিই। সদ্য উদ্বোধন করা পদ্মাসেতু দেখতে দেখতে আমরা নড়াইল চলে এসেছি। উঠেছি সেই বিখ্যাত চিত্রা নদীর পাড় জুড়ে গড়ে ওঠা চিত্রা রিসোর্টে। দশ বিঘা জমির ওপরে গড়ে ওঠা এই রিসোর্ট এক মনোরম সবুজের চাদরে ঢাকা। বাংলার সবুজ প্রকৃতি এ রিসোর্টে যেন ধরা দিয়েছে হাসতে হাসতে। সে গল্প আরেকদিন।
প্ল্যান হয়েছিলো পরিবারের সবাই মিলে দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি কাটাবো চিত্রায়। পদ্মাসেতুও দেখা হবে, আবার নিরিবিলি পরিবেশ দুটি দিন শান্তিতে কাটানো হবে। এ যেন রথ দেখাও হবে, আবার কলা বেচাও হবের মত অবস্থা। যদিও পদ্মাসেতু আমি গত মাসেই দেখে গেছি টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার পথে। কিন্তু পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরই সেই অতি প্রত্যাশিত সেতু দেখা হয়নি। প্ল্যানমত বৃহস্পতিবার দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা বেড়িয়ে পরি নড়াইলের উদ্দেশ্যে।
নড়াইল যাবো আর বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী এসএম সুলতানের বাড়িতে যাবো না তাতো হয় না! ২০০৪ সালে আমি সুলতান মেলার নিউজ কাভার করতে প্রথম নড়াইল গেছিলাম। এবারও সবাই মিলে সেই শ্রদ্ধেয় শিল্পীর সমাধি দেখতে যাবো এই ছিলো ইচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমরা নড়াইলে গিয়ে পৌঁছালাম। সবাই ফ্রেস হয়ে সেদিন রিসোর্টের মনোরম পরিবেশেই সময় কাটালাম। কথা হলো শুক্রবার সকালে আমরা বজরায় করে চিত্রা নদী দিয়ে শিল্পীর বাড়িতে যাবো। কিন্তু যান্ত্রিক গোলোযোগের কারণে রিসোর্টের মালিকের বজরাটি কাজ করছিলো না। অগ্যতা আমাদের গাড়িতে করে রাজপথ ধরেই যেতে হলো এসএম সুলতান সংগ্রহশালায়।
আমাদের শিল্প জগতের এক অনন্য নাম এসএম সুলতান। পুরো নাম শেখ মোহম্মদ সুলতান। শৈশবে বাবা তার নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল জেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে মাছিমদিয়া গ্রামে বাবা মেছের আলী ও মা মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন সুলতান। ১৯২৮ সালে ভর্তি হন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুলের অবসরে রাজমিস্ত্রি বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন সুলতান। এ সময় ছবি আঁকার হাতেখড়ি তার। সুলতানের কাছে তার বাবা ছিলেন একজন শিল্পী। তৎকালীন জমিদার বাড়ির অনেক নকশা তার বাবার করা। সুলতান সেসব কাজ দেখেছেন একদম কাছ থেকে যা তাকে পরবর্তীতে শিল্পী হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সুলতানের আঁকা সেইসব ছবি স্থানীয় জমিদারদের দৃষ্টি আর্কষণ করে। এরপর নানা বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে খ্যতিমান চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠেন সুলতান।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
শিল্পচর্চার পাশাপাশি তিনি ছিলেন সুরের সাধক, বাঁশিও বাজাতেন। ১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ম্যান অব এশিয়া পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর তিনি একুশে পদক পান।
এই গুণী শিল্পী তার জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তার শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তার ছবিতে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণির দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির হালও ফুটে উঠেছে। তার ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
১৯৮২ সালে নড়াইল শহরের চিত্রা নদীর পাড়ে কুড়িগ্রাম এলাকায় একটি বাড়ি নির্মাণ করেন এই শিল্পী। বাড়ির চারপাশে ছিল নানারকম ফুল-ফলের গাছ, আর ছোট একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। পাশেই নদীর তীরে ছিল একটি বড় নৌকা, যেটিতে শিশুদের নিয়ে নদীতে ভেসে ভেসে ছবি আঁকা শেখাতেন। আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত সেই বসতবাড়ি আজ এসএম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা।
শিল্পীর মৃত্যুর পর তার বাড়িটিকে সংগ্রহশালায় পরিণত করেছে সরকার। এ বাড়িটি যদিও তার জন্মভিটা নয়, কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি এ বাড়িতে কাটিয়েছেন। এ বাড়িতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এখানেই রয়েছে তার শেষ সমাধি।
কুড়িগ্রাম এলাকার সেই বাড়িতে সুলতানের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এক কোটি পচাত্তর লাখ টাকা ব্যয়ে সুলতান কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয় ২০০৩ সালে। চিত্রা নদীর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রায় ২৭ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত সুলতান কমপ্লেক্সের চারপাশ দুর্লভ প্রজাতির বিভিন্ন সবুজ বৃক্ষে ঢাকা। অজস্র পাখির কলতাণে মুখরিত এই কমপ্লেক্সের সবুজ প্রকৃতির মাঝে শায়িত আছেন শিল্পী সুলতান।
প্রধান গেইটি দিয়ে ঢুকতেই সামনে একটি একতলা চোখে পড়বে। এখানেই তিনি থাকতেন। আগে এটি টিনের ঘর ছিলো। পরে দালান করা হয়েছে। যে ঘরে তিনি ঘুমাতেন সে ঘরে তার ব্যবহারিত খাট, আলনা, বাক্স, ড্রেসিং টেবিল পরিপাটি করে রাখা হয়েছে। কারো এ ঘরে প্রবেশের অনুমতি নেই। বাইরে থেকে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখা যায় সব।
লাল সিরামিকে মোড়া এই কমপ্লেক্সের দ্বিতল আধুনিক ফটোগ্যালারিতে শিল্পীর চিত্রকর্ম ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। প্রায় ৩৮ ফুট লম্বা আর্ট গ্যালারীতে সভ্যতার ক্রমবিকাশ, ধান মাড়াই, জমি কর্ষণ, গাঁতা চাষসহ মোট ২৩টি ছবি রয়েছে। আরও আছে শিল্পীর ব্যবহার করা রঙ-তুলি-কালি। আছে তার ব্যবহার করা বেশ কিছু কাপড়-চোপড় (আলখাল্লা), দেয়াল ঘড়ি, ছড়ি, বাদ্যযন্ত্র ও বই।
এসএম সুলতান শিশুদের ছবি আঁকা শিখানোর জন্য ‘শিশু স্বর্গ’ নামে একটি নৌকা (বজরা) তৈরি করেছিলেন। সুলতান শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের টানে, প্রকৃতি প্রেমে মুগ্ধ হয়েই সুলতান দ্বিতল নৌকা গড়ে তোলেন। সেই নৌকায় করে চিত্রা নদীতে শিশু-কিশোরদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার মৃত্যুর পর নৌকাটি চিত্রা নদীর পাড়ে তুলে রাখা হয়েছে। নৌকাটি সুরক্ষিত ও দৃষ্টিনন্দন করতে ‘সুলতান ঘাট’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা অনেক দিন ধরেই থমকে আছে। বর্তমানে কমপ্লেক্স সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত শিশুস্বর্গে বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখানো হয়।
জীবজন্তুর প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি একটি চিড়িয়াখানা তৈরি করেন। কিন্তু বর্তমানে সেই চিড়িয়াখানাটিও আর নেই।
শিল্পী সুলতানের বাড়িতে নির্মিত এই কমপ্লেক্সকে ঘিরে প্রতিবছর ১০ আগস্ট শিল্পীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা ও ৭ দিন ব্যাপী সুলতান মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতিদিনই বিশ্ববরেণ্য এই চিত্রশিল্পীর দূর্লভ চিত্রকর্মগুলো দেখতে দূর দূরান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী আসেন।
এই স্মৃতি সংগ্রহশালার কিউরেটর তন্দ্রা মুখার্জী বলেন, বিশ্বমানের সব চিত্রকর্ম এখানে রয়েছে। সারাবছরই এখানে দর্শনার্থী আসেন। শিল্পী সুলতান শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের জন্য তিনি দ্বিতল নৌকা গড়ে নাম দেন ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ। সেই নৌকায় করে চিত্রা নদীতে শিশু-কিশোরদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।
তিনি আরও বলেন, শিল্পীর মৃত্যুর পর নৌকাটি চিত্রা নদীর পাড়ে তুলে রাখা হয়েছে। এখন অন্য একটি ঘরে শিশুদের আঁকাআঁকি শেখানো হয়। আমরা শিল্পীর স্মৃতি ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
সংগ্রহশালার মালি কাম গ্যালারি গার্ড গোলাপ কাজী বলেন, এখানে প্রায় ২৫ বছর ধরে চাকরি করছি। শীত মৌসুমসহ সারাবছরই দর্শনার্থী আসেন এখানে। দেশি-বিদেশি পর্যটক সুলতানের শিল্পকর্মের টানে এখানে ছুটে আসেন। তবে লোকবল সংকটসহ পর্যটন সুবিধা অনেক কম।
সরকারী ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯.৩০ থেকে বিকাল ৪.৩০ টা পর্যন্ত সুলতান কমপ্লেক্স খোলা থাকে। এসএম সুলতানের স্মৃতি সংগ্রহশালা সপ্তাহের প্রতি রোববার বন্ধ থাকে। সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা (জনপ্রতি), শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৫ টাকা (জনপ্রতি)।