ও আমার দেশ: তোমায় বড়ো ভালোবাসি
তপতী বসু
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৮:৫৫ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার
প্রতীকী ছবি
কাকে বলে দেশের প্রতি ভালোবাসা! আলম নামের ছেলেটি ডিম ভাজা আর গরম ভাত বড়ো ভালোবাসতো। ১৯৭১ সালে মায়ের কাছে বলেছিল, ‘দেশ স্বাধীন হইলে মা একদিন গরম ভাত আর হাঁসের ডিম ভাজা খামু’৷
একটি মুখের হাসির জন্যে আলম মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে গিয়ে ফিরে আসেনি আর৷
স্বাধীন দেশে আলমের মা বহুদিন ভাত মুখে তুলতে পারেন নি৷
কবি মন্দ্রীন্দ্র গুপ্ত ‘চিঠি’ কবিতায় বন্ধু সুশান্তকে জানাচ্ছেন ‘সরলার মা’-র কথা৷ পূর্ববাংলায় ফরিদপুরের ওদিকে সিঁদূরমুখী আমগাছের ছায়ায় সরলার মায়ের ছোট্টকুড়ে ঘর ৷ স্বামী আর সরলার সাথে ছিলো রহিম-করিমের ছেলেমেয়েরা৷ দেশভাগের পর সব ছেড়ে একদিন চলে যাওয়া। কবির বাড়ি সে ঘর মোছে, বাসন মাজে৷ গাঁয়ের বধূ থেকে শহরের কাজের মাসী ...!
স্বামী আর মেয়ে সরলাকেও সে হারিয়েছে৷ মন ভালো থাকে না তাঁর। তারপরও সরলার মার একদিন মন বেশি খারাপ দেখে কারণ জানতে চান কবি৷
পূর্ববঙ্গে ঝড় হয়েছে। সেই ১৯৭০ সালের নভেম্বরের ঝড়ের খবরে বুড়ির মন কেমন করছে। সেই সিঁদূরমুখী আমগাছ আর রহিম করিমের জন্যে৷ হতবাক কবি তাকে সান্ত্বনা দেন। যাদের নিয়ে যেখানে সে আছে, সেই কথা ভাবতে বলেন।কিন্তু সরলার মায়ের সেদিন কাজেকর্মে মন থাকে না৷ সে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে থাকে৷
কবি সুশান্তকে বলেন, শুধুমাত্র শিক্ষিত লোকেরাই দেশকে ভালোবাসে এমন ধারণা, আর তাই নিয়ে তাদের গর্ব। কিন্তু সরলার মায়ের মতন শিরায় শিরায় এমনভাবে দেশকে বুকের মাঝে বহন করতে পারার কথা তারা ভাবতে পারে!
কয়েক বছর আগের কথা, কোলকাতায় এক দিদির সাথে পরিচয় হয়েছিল৷ বরিশাল থেকে বহুদিন আগে এসেছেন ৷ সব কিছুই ছেড়েছেন ,অনেক কষ্ট সয়েছেন গল্পে গল্পে জানাতেন৷ একদিন বললেন, ‘পাতিলের তলায় আলা রাকছিলাম, নেতাই গ্যাছে৷’ আমি অনেক কষ্টে বুঝলাম হাড়ির নিচে তামাক রেখেছিলেন, শুকিয়ে গেছে৷ আমি জানতে চাইলাম, সব ছেড়েছেন, ভাষাটা রেখেছেন কেন?
দিদি ম্লান হাসেন। বলেন, সব কিছু ছেড়ে গেছে- প্রাণ থেকে ভাষা নিতে পারেনি...।
দাদু ছিলেন রাশভারি মানুষ৷ কোলকাতা আর ফকিরহাটের মূলঘর মিলিয়ে তাঁর পরিবার ছিল জমজমাট৷ এক সময় চলে আসলেন৷ নিজের সুবিশাল ছায়াময় মায়াঘেরা বাড়ি ছেড়ে ছোট, এক ঘরের ভাড়া বাড়িতে৷ সারাদিন বসে থাকতেন গলিরমুখে, কেউ চেনে না, জানে না৷ খুব কষ্ট লাগত তাঁর৷ বহুবছর পরে, এক নাতি জাহাজের ক্যাপ্টেন হয়ে পৃথিবীর নানা দেশে যায়৷ একবার জাহাজ যাবে চট্টগ্রাম৷ দাদুকে জানালো, যাবে মূলঘর৷ যে দাদু কোনো দিন কারো কাছে কিছু চাননি, তাঁরও ছিল গোপন চাওয়া৷- ‘একটুখানি দেশের মাটি নিয়ে আসিস’৷
আমার এক ভাসুর এসেছেন সত্তর বছর আগে, এখন বয়স পঁচাশি৷ পৃথিবীর বহুদেশ ঘুরেছেন কাজে এবং কাজের অবসরে৷ অথচ তাঁর সাথে কেউ কথা বলতে গেলে শোনাবেন বাল্যবন্ধু বদরের সাথে সুপারী গাছে দোল খাওয়া অথবা খেঁজুর গাছ থেকে রসচুরির স্মৃতির কথকতা৷ বারবার ছুটে যাবেন, যেতে চান সেইখানে, যেখানে তাঁর মা সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপ দেখাতেন৷
তাহলে দেশকি আলম নামের ছেলেটির ডিম ভাজা আর গরম ভাত!
সরলার মায়ের রহিম-করিম বা পুবদুয়ারী আমগাছ৷! দাদুর একটুখানি বাল্যভিটার মাটি বা কারো কাছে মায়ের সন্ধ্যার প্রদীপ দেখানো আলো!
তখন ছোটো বেলা।ভাইবোনেরা, মাকে নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর রাত বারোটায় তোপোধ্বনি শুনতাম। গুনতাম এক...পাঁচ..বত্রিশ৷ আধঘুমের নেশায় খুব ভালোলাগত৷ স্টেডিয়ামে যেতে হবে, ভোরে উঠতাম৷ উঠানের পাশে কাঁঠাল গাছে ডাকতো ভোরের দোয়েল৷ সব স্কুল মিলে সেদিন একটা স্কুল৷ একটা পতাকা একটা গান৷ যে গান চিরসত্য, চিরদিনের সত্য৷ আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি........!
প্রাণের চেয়ে মাগো, তোমায় বড়ো বেশি ভালোবাসি! আমার কাছে দেশ! কুয়াশায় মাখামাখি একখানি সকাল, ভোরের দোয়েল,...কতদিন এদের হয়নি দেখা! আর কিছু মানুষও৷ যাদের সাথে একসাথে বড়ো হয়ে ওঠা, একভাষায় কথা বলা৷ এক বেঞ্চে দুখানি হাত পাশাপাশি রেখে মিলানো, কে কতটা ফর্সা... তারপর সব ঝাপসা, অস্পষ্ট...৷
তাদেরও যে বড়ো ভালোবাসি৷
