হারিয়ে যাচ্ছে হালখাতা প্রথার রীতি
নিজস্ব প্রতিবেদক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১১:০৭ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০২৩ শুক্রবার
সংগৃহীত ছবি
বছর ঘুরে আবার এসেছে পহেলা বৈশাখ। যদিও গত কয়েক বছর করোনা ও বিভিন্ন কারণে ভাটা পড়েছে এ উৎসবের। তবে ব্যবসায়ীরা করছেন বাঙালি ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ-হালখাতার আয়োজন। কিন্তু আগের মতো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হালখাতা প্রথার রীতিও নেই এখন। তবুও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে কিছু কিছু আড়তে এখনও দেখা মেলে হালখাতা খোলার আয়োজন। এছাড়া হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বাংলা বছরের প্রথমদিন খোলা হয় হালখাতা।
আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে হালখাতার আয়োজন হয়ে আসছে। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা পুরনো খাতা বন্ধ করে নতুন করে হিসাবের খাতা খোলেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ফুল দিয়ে সাজানো হয়। দেনাদারদের আপ্যায়ন করা হয় মিষ্টি দিয়ে। শুধু এই দিনেই বকেয়া থাকা কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়।
নগরের ব্যবসাপাড়ায়, বিশেষ করে স্বর্ণের দোকানগুলোতে বরাবরের মতো এবারও থাকছে হালখাতার আয়োজন। খাতুনগঞ্জের পুরনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হালখাতার দিনে পূর্বপুরুষদের ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও গ্রাহকদের কার্ড পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ, নতুন খাতা খোলা, মিষ্টিমুখ করানোর ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
মেসার্স অনঙ্গ মোহন দেব
পূর্বপুরুষদের ধারাবাহিকতায় খাতুনগঞ্জের মেসার্স অনঙ্গ মোহন দেব প্রতিষ্ঠানটিতে এবারও নেয়া হয়েছে হালখাতার প্রস্তুতি। ১৯২০ সালে তামাক, সুপারি ও জর্দার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে এ প্রতিষ্ঠানটি। তখন থেকেই হালখাতার প্রচলন ছিলো প্রতিষ্ঠানটিতে।
অনঙ্গ মোহন দেবের নাতি রাজীব দেব বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, বৈশাখের প্রথমদিন পুরনো লেনদেনের খাতা বন্ধ করে নতুন খাতা খোলা হয়। আগেকার যুগে ব্যবসায়ীদের নিয়ম ছিলো কঠোর। মহাজনের কাছে টাকা বাকি থাকলে পণ্য দেয়া হতো না ওই ব্যবসায়ীকে। তবে তখনকার ব্যবসায়ীরা ঋণী থাকতে চাইতেন না। তারা যেভাবেই হোক দেনা পরিশোধের চেষ্টা করে যেতেন। বৈশাখের প্রথমদিন ছিলো তাই ব্যবসায়ীদের কাছে উৎসবের দিনের মতো। এখনও আমরা এই দিনটিতে গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুনভাবে লেনদেন শুরু করি।
মেসার্স পীতাম্বর শাহ্
খাতুনগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পীতাম্বর শাহ্’র দোকানে পহেলা বৈশাখে এক বছরের হিসাবের সমাপ্তির জন্য হালখাতার আয়োজন করা হয়। এর আগে কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকদের দোকানে নিমন্ত্রণ করা হয়। হালখাতার দিনে আগত গ্রাহকদের করানো হয় মিষ্টিমুখ। পঞ্জিকার মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করে এখানে হালখাতার আয়োজন শুরু করা হয়। ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এই দোকানে হয়ে আসছে হালখাতার আয়োজন।
পীতাম্বর শাহের বংশের বর্তমান প্রতিনিধি ভাস্বর মাধব বণিক বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, বছরের শেষে পুরনো হিসাবের দাগ টেনে নতুন হিসাব খোলা হয়। পার্টিরা পুরো টাকা দিয়ে দিলে তাদেরকে বিশেষ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। গণেশের নাম দিয়ে তার চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন খাতা খোলা হয়। খাতায় মাটি আর সিঁদুর মিশিয়ে এক টাকার কয়েনের মাধ্যমে পাঁচটি ফোঁটা দিয়ে খাতা খোলা হয়। এছাড়া খাতা খোলার সময় ফুল, বেলপাতা, তুলসী পাতা, ঘি, মধু ও দুই পদের চন্দন ব্যবহার করা হয়। ঘি দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো ও মাসমঙ্গলের তালা তৈরি করা হয়। পঞ্চ শস্য, ফুল, বেল পাতা, ঘি, মধু, দুই পদের চন্দন, দই, স্বর্ণ ও মাছ দিয়ে তৈরি করা হয় এ তালা। এরপর খোলা হয় নতুন বছরের হালখাতা।
মেসার্স ধীরেন্দ্র লাল মহাজন
খাতুনগঞ্জের আরেকটি পুরনো প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স ধীরেন্দ্র লাল মহাজন। এখানেও পহেলা বৈশাখে পুরনো বছরের লেনদেন শেষ করার জন্য খোলা হয় হালখাতা।
ধীরেন্দ্র লাল মহাজনের নাতি রাজা রায় বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৭১ বছর আগ থেকে চলছে হালখাতার আয়োজন। তবে আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে হালখাতা অনুষ্ঠানের পরিসর। আগের মতো গ্রাহকরা এখন ঠিক সময়ে বকেয়া টাকা পরিশোধ করেন না।
সাব্বির এন্টারপ্রাইজ
সাব্বির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ছৈয়দ ছগীর আহম্মদ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, পহেলা বৈশাখকে বরণ করতে আগে খাতুনগঞ্জে জমজমাট আয়োজন হতো। তবে গত ৮-১০ বছর ধরে এই আয়োজনের পরিসর অনেক ছোট হয়ে আসছে। তখন মিষ্টি খাওয়ানো আর পাওনা টাকা আদায়ের মধ্য দিয়ে পুরনো বছরের লেনদেনের ইতি ঘটতো। ডিজিটাল এই যুগে কয়েকজন ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ আর সেভাবে হালখাতার আয়োজন করেন না।
হালখাতার ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার কারণে ব্যবসায় যে মন্দা নেমে এসেছিলো, এ বছর সেই মন্দা কাটিয়ে কিছুটা সুবাতাস বইছে। গত দুই বছরের চেয়ে বিক্রি তাই বেশ ভালো।
নগরীর বক্সিরহাট সড়কের এসবি বাইন্ডিং হাউজ প্রায় ৭০ বছরের পুরনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মালিক প্রণব রঞ্জন ঘোষ জানান, প্রতিবছর কয়েক লাখ হালখাতা বাঁধাই হয় তার বাইন্ডিং হাউজে। সারাবছর কম বেশি তৈরি হলেও পৌষ মাস থেকে হালখাতা তৈরির ব্যস্ততা বাড়ে। কিন্তু গেল দুই বছর লকডাউন থাকায় ব্যবসায়ীরা দোকান খুলতে পারেননি, ছাপাখানাও বন্ধ রাখতে হয়েছিলো। তবে এ বছর পুরোদমে কাজ চলছে, হালখাতাও তৈরি হচ্ছে।
চট্টগ্রামের বাইরে সিলেট, হবিগঞ্জ, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে হালখাতা পাঠায় এসবি বাইন্ডিং হাউজ।