আয়রে পাখি লেজঝোলা, আয়রে হাঁড়িচাচা
আইরীন নিয়াজী মান্না
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:৫১ পিএম, ২৭ মে ২০২৫ মঙ্গলবার

সংগৃহীত ছবি
বহু বছর আগর কথা! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সবুজ মাঠে বসে আছি। বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। আমরা কয়েকজন বন্ধু গল্প করছি। হঠাৎ দেখি দূরের আম গাছ থেকে উড়ে এসে আমাদের মাথার ওপর কড়াই গাছের ডালে বসলো একটি অদ্ভুত সুন্দর পাখি। কিছুক্ষণ পর আরো একটি পাখি এসে বসলো আগেরটির পাশে। এদের ওড়ায় বেশ ছন্দ আছে। ফটফট শব্দে গোটা কয়েক ডানার ঝাপটা, ডানা ও লেজ ছড়িয়ে শূন্যে ভেসে চলা, আবার ডানার ঝাপটা, আবার ভাসা। অল্প দূরে আর একটা গাছে গিয়ে বসা।
ওড়ার সময় দেখা যায় ডানার কয়েকটা পালক সাদাটে। লেজের মাঝের পালকও তাই। দুপাশে কালোর মাঝে যেন ফ্রেম আঁটা। পাখিটির নাম হাঁড়িচাচা। ইংরেজি নাম Tree pie কিংবা Tree crow, বৈজ্ঞানিক নাম Dendrocitta vagabubda। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাকের জ্ঞাতিভাই এই হাঁড়িচাচাকে বেশ কিছু আঞ্চলিক নামে ডাকা হয়। যেমন কুটুম পাখি, লেজ ঝোলা, ঢেঁকিলেজা ইত্যাদি।
হাঁড়িচাচা সুন্দর পাখি। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম। লম্বায় লেজসহ ১৬ থেকে ১৮ইঞ্চি। শুধু লেজটাই লম্বায় প্রায় ১০ থেকে ১২ইঞ্চি। বাংলাদেশের লেজওয়ালা পাখিদের মধ্যে এই পাখিটি অন্যতম। এতো বড় লেজের কারণে পাখি প্রেমীদের দৃষ্টি কাড়ে সে। হাঁড়িচাচার শরীরের পালকের রঙ বাদামি পাটকিলে। মাথা, গলা এবং বুকের কিছু অংশ পাটকিলে আভাযুক্ত ফিকে কালো। হাঁড়িচাচার লেজে মোট ১২টি পালক থাকে। লম্বা লেজের মাঝের পালক দুটি বেশি লম্বা। ছোট ডানা ও লেজের রঙ ধূসর সাদা। বাকিগুলো কালো। লেজের অগ্রভাগ কালচে। কাকের মতো শক্ত মোটা ও ধারালো চঞ্চু। কালচে স্লেট ধূসর চঞ্চু কিছুটা চাপা ও বাঁকা। পায়ের রঙ গাঢ় স্লেট ধূসর। পেছনের নখযুক্ত পা একটু বড়। চোখের মণি লালচে।
হাঁড়িচাচা সর্বভুক পাখি। পোকা-মাকড়, ব্যাঙ, ইঁদুর, বিছে, ছোটসাপ, টিকটিকি, গিরগিটি সবই খায়। এতো সুন্দর পাখিটি কখনো কখনো খুব রুচিহীন কাজ করে বসে। এদের কখনো কখনো বিভিন্ন জীবজন্তুর মৃতদেহও খেতে দেখা যায়। অন্য সব ফলাহারী পাখিদের সাথে মিলেমিশে হাঁড়িচাচারাও দল বেঁধে বট আর অশ্বত্থ গাছে বসে পাকা ফল খায়। পাখির ডিম ও ছানা খেতে ওরা এক নম্বর ওস্তাদ। ছোট ছোট নিরীহ পাখিদের ওরা পরম শত্রু। ওরা নিয়মিত ছোট পাখিদের বাসা লুট করে ডিম ও ছানা খেয়ে ফেলে।
গাছের সরু শুকনো ডালপালা, লতা-পাতা, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ওরা কাকের বাসার চেয়ে আরো একটু বড় বাসা বাঁধে। তার মধ্যে পেতে রাখে নানা রকম শিকড়-বাকড়, কাঠি ইত্যাদি। পাতা ভরা ঘন বড় গাছের অনেক উঁচু ডালে ওরা বাসা বানায়। বাসাটি পাতার আড়ালে লুকানো থাকে। বাসার স্থান নির্বাচন এবং বাসা তৈরি ও সন্তান পালনে স্ত্রী-পুরুষ দুজনেই সমান শ্রম দেয়।
ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত হাঁড়িচাচার প্রজননকাল। কখনো কখনো আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গড়ায় এ সময়। তবে বাসা বেঁধে ফেলে মার্চের শেষ থেকে জুনের মধ্যেই সাধারণত। হাঁড়িচাচা সাধারণত ২ থেকে ৩টি ডিম পাড়ে। কখনো কখনো ৪ থেকে ৫টি পর্যন্ত ডিম দেখা যায়। ডিমের রঙ হালকা সবুজ, তার উপরে ধূসর ছিট ও ছোপ্ থাকে। কোনো কোনো ডিমের রঙ খুব ফিকে লাল তার ওপর লাল এবং গায় পাটকিলে রঙ এর ছোপ ও ফিকে বেগুনি দাগ থাকে। ডিম সরু এবং মুখের দিকটা কিছুটা সুচালো। ডিমের মাপ লম্বায় ১.১৭ ইঞ্চি, চওড়ায় ০.৮৭ইঞ্চি।
ঢাকা শহর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সকল অঞ্চলেই হাঁড়িচাচার দেখা মেলে। হাঁড়িচাচাকে দেখা যায় সব বাগানেই। স্বভাবে কিছুটা লাজুক হলেও মানুষজনের বসতির কাছাকাছি থাকতেই পছন্দ করে বেশি। গভীর জঙ্গল এদের পছন্দ নয়। ওরা বেশ সামাজিক স্বভাবের পাখি। সর্বত্র সপরিবারে ঘোরাঘুরি করে এবং নিজেদের মধ্যে উঁচু ক্যারকেরে গলায় কেঁ-কেঁ-কেঁ-কেঁ শব্দে আওয়াজ করে প্রচুর আড্ডা দিয়ে থাকে। হাঁড়িচাচা কণ্ঠনালী থেকে এক রকম গম্ভীর কর্কশ আওয়াজ বের করে। এছাড়া নানা রকম সুরেলা ডাকও ওরা ডাকতে পারে। যে ডাকটি ওরা প্রায়ই পুনরাবৃত্তি করে। প্রজনন ঋতুতেই এই ডাক শোনা যায়। পুরুষ পাখি পিঠ ঠেকিয়ে মাথাটি গুঁজে লেজ ঝুলিয়ে বেশ হাস্যকর ভঙ্গিতে বসে সঙ্গিনীকে এই ডাক শোনায়।
পৃথিবীতে অনেক রকম, নানা আকার ও রঙের হাঁড়িচাচা রয়েছে। বাংলাদেশে আরও এক রকম হাঁড়িচাচা খুব কম সংখ্যায় আছে। ওর নাম হচ্ছে সাদাবুক হাঁড়িচাচা।
শহর থেকে পল্লী গাঁয়ের অতি পরিচিত পাখি হাঁড়িচাচা। শরীরে রঙের বাহার আর আকর্ষণীয় লম্বা লেজের কারণে ব্যাপক পরিচিত এই পাখি উঠে এসেছে বাংলা সাহিত্য তথা ছড়া,গল্প, কবিতায়। তাইতো যুগে যুগে মা তার শিশু সন্তানকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ছড়া কাটেন:
আয়রে পাখি লেজঝোলা
খোকন নিয়ে কর খেলা,
খাবি-দাবি কলকলাবি
খোকাকে মোর ঘুম পাড়াবি।
লেখক বাংলাদেশ বার্ড ওয়াচার সোসাইটির আহবায়ক।