আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে জানি নে
অনু সরকার
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৯:০০ পিএম, ৭ জুলাই ২০২৫ সোমবার
প্রতীকী ছবি।
"নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে"................
গ্রীষ্মের স্তব্ধ, থমথমে, অগ্নিক্ষরা সময়ের পর শান্তির বার্তা নিয়ে যে ঋতু আসে সেই ঋতুই বর্ষাকাল নামে বাংলাদেশে পরিচিত। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে প্রকৃতি যখন অতিষ্ট তখন ঝরঝর ধারায় বৃষ্টি এসে জানিয়ে দেয় বর্ষা এসে গেছে। আকাশে শোনা যায় দুরুদুরু মেঘের আওয়াজ। বৃষ্টির পানিতে গাছপালা ও জীবজন্তু যেন প্রাণ ফিরে পায়। সবুজে শ্যামলে ভরে যায় প্রকৃতি।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। তার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বর্ষাকাল। আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস নিয়ে বর্ষাকাল। গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহের পর বর্ষাকাল আসে আনন্দের সংবাদ নিয়ে। বর্ষাকালের আগে থেকেই আকাশে বাতাসে বর্ষার আগমনবার্তা পাওয়া যায়। কালো মেঘে ঢেকে যায় আকাশ, দক্ষিণ দিক থেকে আসে ঝড়ো হাওয়া। ঝরঝর ধারায় মেঘ থেকে নেমে আসে বৃষ্টি। বর্ষার পুরো সময়টা ধরেই বাংলাদেশের সকল অঞ্চল কালো বা ধুসর রঙের মেঘে ঢাকা। গাছে গাছে ফুটে কদম ও কেয়াসহ আরো নানান প্রকার ফুল।
আকাশে কালো মেঘের আভাস ও ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আওয়াজ কানে এসে জানিয়ে দেয় বর্ষা এসে গেছে। বর্ষার এই বৃষ্টির রয়েছে ভৌগলিক কারণ। বর্ষাকালে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় মৌসুমি বায়ু। এই মৌসুমি বায়ু দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রচুর পরিমাণ জলীয়বাষ্প ধারণ করে। এই জলীয়বাষ্প হিমালয়ের পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশের উপর বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। তাই বর্ষাকালে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়।
গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড তাপে যখন প্রকৃতি অসহ্য গরমে ছটফট করতে থাকে তখনই বর্ষা আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। বর্ষা আসে কালো মেঘ নিয়ে গর্জন করতে করতে। সেই গর্জনে মানুষের জনজীবনে আসে আনন্দ, গাছপালা আবার প্রাণ ফিরে পায়, গাছে গাছে ফুটে নতুন ফুল ও পাতা। বাংলার আকাশে বাতাসে আসে আনন্দের নতুন জোয়ার। কবি সুফিয়া কামালের ভাষায়-
“আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি,
মায়ার কাজল চোখে, মমতার বর্মপুট ভরি।”
বাংলাদেশে আবহাওয়া ও জলবায়জনিত কারণে বাংলাদেশে কখন বর্ষা আসে এবং কখন তা চলে যায় তা বোঝা মুশকিল। বাংলাদেশে বর্ষাকাল প্রায় আশ্বিন মাস পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। মহাকবি কালিদাস প্রথম আষাঢ় মাসে আকাশে কালো মেঘ দেখেছিলেন। তবে সাধারণত আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসেই বর্ষার প্রকোপ বেশি থাকে। বর্ষার মেঘের গর্জন, বর্ষার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সব মিলিয়েই বর্ষাকালের পূর্ণতা।
৮০ হাজার গ্রামের দেশ বাংলাদেশ। বাংলদেশের প্রতিটি গ্রামই বর্ষাকালের আগমণে নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। আকাশে দেখা যায় কালো ও ধুসর মেঘের খেলা। মেঘের গর্জনে সারাদিন মত্ত থাকে প্রকৃতি। সারাদিন ধরে চলে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির আবার নানান রূপ। কখনো সে আসে ইলশেগুড়ি হয়ে, আবার কখনো ঝরঝর ধারায় চলে তার চরচর আওয়াজ। কখনো আবার ঝড়ো হাওয়া নিয়ে সে আসে গর্জন করতে করতে। এই সময়ে মাঠে মাঠে দেখা যায় সবুজ ঘাস। গাছে গাছে আসে নতুন পাতা ও ফুল। গাছপালা ও প্রকৃতি যেন নতুন জীবন ফিরে পায়। নদীতে চলে পালতোলা নৌকা। গ্রামের ছোট ছোত শিশুরা নদী ও পুকুরের পানিতে ঝাপ দেবার আনন্দে মেতে উঠে। এসময় নদী, খাল-বিলে ধরা পড়ে প্রচুর মাছ। কেয়া, জুঁই, কামিনী ইত্যাদি ফুলের গন্ধে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠে। তাইতো কবিকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছেঃ
"গুরু গুরু ডাকে দেয়া, ফুটিছে কদম কেয়া
ময়ুর পেখম তুলে সুখে তান ধরেছে
বর্ষার ঝরঝর সারাদিন ঝরছে।"
বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে বর্ষার কারণে আসে নানান বৈচিত্র্য। বর্ষার বর্ষণকে সামনে রেখেই বাংলার কৃষকেরা মাঠে বীজ বুনে থাকেন। বর্ষার বর্ষণের কারণেই মাটিতে আসে পলি আর সেই পলিমাটিতে ফলে সোনার ফসল। কৃষকের মুখে ফোটে ফসলের হাসি। সেই হাসিতে ভাসে সারা দেশ। কারণ বাংলাদেশ এখনো কৃষিনির্ভর দেশ। বাংলদেশের কৃষকদের ফসলের দিকেই তাকিয়ে থাকে সারা বাংলাদেশ। আর এই ফসলের পূর্বশর্ত হলো যথেষ্ট পরিমাণে পানি যার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগই এই বর্ষাকালের বর্ষণের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এসময়ে বাংলাদেশের নদীতে, খালে-বিলে পাওয়া যায় প্রচুর মাছ। এই মাছ বিক্রি করে জেলেরা অনেক লাভবান হয়।
বর্ষার ফুল কেয়া, কদম, শিউলি বর্ষার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন বলেন, "কাহার ঝিয়ারি কদম্ব-শাখে নিঝুম নিরালায়, ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দিয়াছে, অস্ফুট কলিকায়।" এসময় খাল-বিল ও হাওড়ে জন্ম নেয় অসংখ্য শাপলা ফুল। সারা বিল যখন সাদা শাপলায় ভরে যায় তখন মনে হয় দীঘির জলে আকাশের তারা ফুটে আছে। হিজল আর কেয়াফুলের অপরূপ দৃশ্য বর্ষাকালের সৌন্দর্যে আনে নতুন মাত্রা। বর্ষার ফলগুলো হলো আনারস, আমড়া, পেয়ারা প্রভৃতি।
বর্ষাকালে বাংলার নদীগুলো তাদের পূর্ণযৌবন ফিরে পায়। এসময় বৃষ্টির কারণে নদ-নদীগুলো কানায় কানায় ভর্তি থাকে। নদী মাঝে মধ্যে এতটাই প্রশস্ত হয় যে কখনো কখনো একটি পুরো গ্রাম নদীর তলায় চলে যায়। চারিদিকে তখন থৈ থৈ করে পানি। বড় নদীতে আসে প্রবল স্রোত। ছোট বড় চরগুলো পানির তলায় চলে যায়। নদীর পাড়ের ঘাসগুলো সবুজে সবুজে ভরে ওঠে।
মানব মনে বর্ষার প্রভাব অপরিসীম। বর্ষা মানুষের মনকে করে তোলে সহজ, সরল ও সৃষ্টিশীল। বর্ষা হৃদয় ও মনে আনে অফুরন্ত আবেগ। বর্ষাই বাংলা সাহিত্যকে করেছে রসসমৃদ্ধ ও কাব্যে এনেছে বৈচিত্র্য। প্রেম ও ভালোবাসার অনুভূতিও বর্ষা আমাদের উপহার হিসেবে দিয়েছে।
বাঙালির সাংস্কৃতিক, ভাবগত জীবনেও বর্ষা ঋতুর রয়েছে এক অনন্য ভূমিকা। বর্ষার সরস সজল স্পর্শ, শুধু বাংলার প্রকৃতিকেই প্রাণবন্ত করেনি বরং বাঙালির মনকেও করেছে সরস এবং নব নব সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে উদ্বুদ্ধ। তার সবুজ শ্যামলা রূপ দেখে দূর-দিগন্তে বাঙালি ছড়িয়ে দিয়েছে তার মুক্ত মনের বিহঙ্গ-ডানা। বর্ষাকাল শুধু তৃষ্ণার্ত ধরিত্রীর মরুবক্ষকেই সিক্ত করে নি, পৃথিবীর মানুষের মনকেও করেছে বিচিত্র ভাবরসে রঞ্জীবিত। বাঙালির গৃহাঙ্গন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা উৎসব-আনন্দে। রচিত হয়েছে নানান উৎসবমুখর পরিবেশ। রচিত হয়েছে অনেক সঙ্গীত ও কাহিনী। স্নিগ্ধ-সজল বাংলার মানুষের মনকে করেছে কল্পনা-বিলাসী। মানুষের হৃদয়ে দিয়েছে নিত্যনতুন ভাব-সম্পদের সন্ধান। তাদের চারিত্রকে করেছে কোমলে-কঠোরে সহনীয়।
বর্ষার সরস রূপ বাংলা সাহিত্যেও এনেছে বৈচিত্র্য। বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো কবি-সাহিত্যিক হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি এই বর্ষা সম্পর্কে কিছু লিখে যাননি। বর্ষাকালের বর্ষণের প্রতিটি ফোটায় মিশে আছে কবি সাহিত্যিকদের রচিত কবিতা ও কাব্যের সূরধ্বনি। বর্ষাকালের সারাদিন বৃষ্টির সেই ঝমঝম আওয়াজ কবিদের মনকে করে দোলায়িত। তাইতো কবিগুরু লিখেছেনঃ
"এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরষায়।"
কবির দৃষ্টিতে বর্ষা গভীর অর্থব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। বর্ষা হলো অবকাশের, নিষ্প্রয়োজনের ঋতু। এসময়ের মানুষ কাজ-কর্ম ছেড়ে ঘরে অবস্থান করে। তাই কবি-কণ্ঠে উচ্চারিত হল, ‘এই মেঘাসৃত বর্ষমঞ্জির-মুখর মাসটি সকল কাজের বাহিরে, ইহার ছায়াবৃত প্রহরগুলোর পসরায় কেবল বাজে কথার পণ্য।’ কবিগুরু আরো বলেন-
"আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে
জানিনে জানিনে
কিছুতে কেন যে মন লাগে না
আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে।"
বাংলাদেশে বর্ষার উপকারি দিক বলে শেষ করা যাবে না। বর্ষাকালে বাংলাদেশে সারা বছরের প্রায় ৮০ ভাগ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বর্ষাকালেই গাছপালা সারা বছরের পানির জোগান পেয়ে থাকে। বর্ষাকালের বৃষ্টির জন্যই বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বলা হয়। বর্ষাকালের বৃষ্টিতে মাটি উর্বর হয়। নদী থেকে চাষের জমিতে পলিমাটি এসে জমা হয়। সেই পলিমাটিতে ফলে কৃষকের সোনার ফসল। বর্ষাকালে নদীপথে চলাচলে সুবিধা হয়। উত্তপ্ত পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়। ময়লা ধুলাবালি দূর হয়ে পরিবেশ ও বাতাস শুদ্ধ হয়।
বর্ষাকালের সকল উপকারিতাসহ অনেক অপকারিতাও বিদ্যমান। বর্ষাকালের বর্ষণে খরস্রোতা নদী ফুলেফেপে উঠে মাঝে মাঝে লাগামছাড়া হয়ে বন্যা ডেকে আনে, ভাসিয়ে নেয় উপকূলের অনেক মানুষের বসতবাড়ি। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ঘুর্ণিঝড় ইত্যাদি বর্ষাকালেই বেশি আঘাত হানে। অতিবৃষ্টির ফলে অনেক সময়ই ফসল নষ্ট হয় এবং মানবজীবনে এনে দেয় স্থবিরতা। অনেকসময় বর্ষাকালে মহামারী ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তোলে।
বাংলাদেশে বর্ষার রূপ অতুলনীয়। বর্ষা বাংলার সৌন্দর্যের অন্যতম ধারক ও বাহক। বর্ষা না থাকলে বাংলাদেশের এই অপরূপ দৃশ্যগুলো হয়তো ছবির মতোই কল্পনা থেকে যেত। বর্ষাকাল মানুষের মনে আনে অনন্ত বিরহ-বেদনা। একদিকে সে মানুষের মনে আনে আশা, অন্যদিকে সে কখনো ছিনিয়ে নিয়ে যায় মানুষের শেষ সম্বলটুকুও। তার একচোখে হাসি, অন্যচোখে অশ্রু। বর্ষা তাই বাংলার জনগণের কাছে আদরের ঋতু, আনন্দের ঋতু এবং অনন্ত বেদনার ঋতু।
