বর্ষার ছায়ায় জীবন দর্শন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
আসাদুজ্জামান খান মুকুল
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:২৬ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২৫ শুক্রবার
প্রতীকী ছবি।
বর্ষা কেবল একটি ঋতু নয়, এ এক রহস্যময় জীবনদর্শন। নীল আকাশ যখন ঘনকালো মেঘে ঢেকে যায়, তখন প্রকৃতির অন্তর্গত ছন্দ যেন ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। সোঁদামাটির গন্ধ, কদম ফুলের বাহারী রূপ আর টিনের চালে বৃষ্টির নাচন-- সবমিলিয়ে এক অনির্বচনীয় রূপকল্প গড়ে ওঠে। এ যেন প্রকৃতির আপন রূপে ঘরে ফেরা। কিন্তু বর্ষা শুধু প্রকৃতির রঙেই নয়, ইহা মানুষের হৃদয়েও ফেলে গভীর প্রভাব। আনন্দ,বিষাদ, প্রত্যাশা আর স্মৃতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ হয়ে ধরা দেয় এই ঋতুতে।
দর্শনের দৃষ্টিতে বর্ষা এক আত্মদর্শনের সময়। বাইরে মেঘের গর্জন যতই হোক, ভেতরে খুলে যায় নীরবে অন্তর্জগতের দ্বার। জগতের চঞ্চলতা স্তিমিত হয়ে আসে।আর মানুষের মনে জন্ম নেয় এক ধ্যানী আবহ। যেমন জলধারা নেমে আসে নিরবধি, তেমনি আমরা কখনও কখনও ডুবে যাই নিজের গভীরে। আত্মজিজ্ঞাসা জাগে- কোথায় যাচ্ছি, কী চাই, কতটা পেয়েছি আর কতটা হারিয়েছি?
দ্বৈত সত্তায় ফিরে আসে বর্ষা, সৃষ্টি ও ধ্বংসের প্রতীক হয়ে। একদিকে সে ভরে তুলে ফসলের মাঠ, অন্যদিকে ডেকে আনে প্লাবন আর দুর্ভোগ। ভাঙে নদীর কূল, আবার গড়ে তুলে নতুন পলিজমির স্বপ্ন। তাই বর্ষাকে ঘিরে মানুষের মনে জন্ম নেয় দ্বৈত অনুভব। ছেলেবেলায় টিনের ছাউনির নিচে বসে বৃষ্টির ছন্দে ঘুমিয়ে পড়া আর বড়বেলায় সেই একই বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ রাস্তায় আটকে পড়া- এই দুই অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনদর্শনের রঙ পাল্টে দেয়।
বর্ষা মানে প্রতীক্ষা। কৃষকের প্রহর গোনা আকাশের পানে চেয়ে। আবার কবির প্রতীক্ষা- মনের গহন অরণ্যে জমে থাকা ভাবনাগুলোকে শব্দের গাঁথুনিতে কবিতায় পরিণত করার। বর্ষা যেন সময়কে থমকে দেয়। শহরের কোলাহল স্তব্দ হয় একটুখানি, তরুরাজি ধুয়ে-মুছে আরও সতেজ হয়ে ওঠে-, আর মানুষের চোখের কোণে জমে ওঠে একরকম আর্দ্রতা- যা জন্ম নেয় অন্তর থেকেই।
সাহিত্যে বর্ষা এক গভীর অনুরাগের উৎস। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ- সবাই বর্ষায় খুঁজে পেয়েছেন প্রেম, বিরহ, আশা আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ। যেমন জীবনানন্দ দাস লিখেছেনঃ
"বৃষ্টির রঙ রাত্রির মতো,
জল কোথা থেকে যে নামে
অন্ধকারের ছাদের নিচে ---"
বৃষ্টির এই নিঃশব্দ বিষন্নতায় জেগে ওঠে মানুষের মনের গভীর বেদনা, যা শুধুমাত্র বর্ষার বাতাসেই বোঝে।
বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছে ভালোবাসার নিঃশব্দ ভাষা, যা প্রকাশ করে চোখে জমে থাকা অনুচ্চারিত কথামালা। এভাবেই সাহিত্যকে স্পর্শ করে মানুষের অন্তরাত্মার গভীরে, যেখানে বৃষ্টি হয়ে ওঠে ভালোবাসার এক সুর। কোনো কোনো ফোঁটা হয়ে ওঠে দীর্ঘশ্বাসে ভরা বেদনা- যার উৎস হয়তো বহুকাল আগের কোনো অসমাপ্ত গল্প।
বর্ষা যেন প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে এক নিঃশব্দ চুক্তি। এই ঋতুর আরেকটি বিস্ময়কর দিক তার অনিবার্যতা। যত বাধাই আসুক, বর্ষা ঠিক আসে নির্ধারিত সময়ে, অনিবার্য ভঙ্গিতে। এই ধারাবাহিক আগমনের মাঝেই লুকিয়ে থাকে জীবনের এক চিরন্তন বার্তা-" দূর হবে অন্ধকার, আসবে নবজীবনের ধারা"। বর্ষা শেখায়- সব শুষ্কতা চিরস্থায়ী নয়, কোনো এক প্রহরেই ঝরে পড়বে বৃষ্টির ধারা, আর তাতেই ধুয়ে যাবে যন্ত্রণার জমে থাকা ধূলো।
এই সময়টাতে মানুষ ও প্রকৃতি যেন পরস্পরের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। জমে থাকা ধূলিকণা যেমন ধুয়ে যায়, তেমনি মানুষের মনে জমে থাকা দুঃখ, ক্লান্তি, হতাশাও ধুয়ে যায় এই মোহময় ধারায়। বৃষ্টি তার ভাষায় বলে- সবকিছু যাবে, বয়ে যাবে, তবু কিছু অনুভব থেকে যাবে হৃদয়ের গভীরে কোমল স্মৃতির মতো।
যখন সন্ধ্যার আকাশে ভাসে বিজলির চমক, আর দূর কোথাও থেকে আসে একফোঁটা কদমের সুবাস, তখন সত্যিই মনে হয়- এইতো জীবন। সবকিছু হারিয়ে যাওয়ার মাঝেও থাকে একবিন্দু ভালোলাগা, এক চিলতে আশ্রয়, এক মুহূর্তের শান্তির পরশ। বর্ষা সেই নরম নিঃশ্বাস, যা হৃদয়ের প্রাচীরে প্রতিধ্বনি তোলে- ‘এই যে আছি, এই যে ভালোবাসি, এই যে থাকবো-- বৃষ্টির মতোই চিরকাল ---।’
