ওই যে ডাকে হারিয়ে যাওয়া শৈশব
সালেহীন বাবু
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ০২:৩২ পিএম, ১ অক্টোবর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৩:০৬ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০১৮ রবিবার
ফাইল ছবি
শৈশব! ছিল না কোন বালাই। ছিল না কোন গন্ডি। দুরন্তপনার ক্ষেত্র ছিল অবারিত। মধ্যে চলে গেছে অনেকগুলো বছর। সেই সময়ের শিশুদের শৈশব আর এই সময়ের শিশুদের শৈশবের ফের পার্থক্য। আধুনিক যুগে শহুরে শিশুদের শৈশব যেন খাঁচায় থাকা ছটফটে চড়ুঁই পাখিটার মত। প্রাণ আছে। কিন্তু সেই প্রাণে আনন্দের লেশ নেই।
সেই অতীতে আমাদের শৈশবে সবার কাছে নিজের স্কুলটা ছিল সবচাইতে প্রিয় জায়গা। তখন এখনকার মত এত স্কুল ছিলনা। গ্রামে কিংবা শহরে সরকারি স্কুলগুলোতেই সবাই পড়ত। সকালে চোখে ঘুম নিয়ে রেডি হতে হত। ব্যাগে থাকত পড়ার বইয়ের সাথে কমিক বই। আরও থাকত পাঁচ ছয়টা করে কলম। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে সর্বোচ্চ দুইয়ের বেশি কলম থাকেনা। হিসেবেও তাই ঠিক। তাহলে ঐ পাঁচটি কলম নেওয়ার অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল।
সরকারি স্কুলের বিশাল মাঠ। বিদ্যালয়ের সবচেয়ে রাগী শিক্ষক পিটি স্যার। হাতে তার জালি বেত। মারলে লাগত বেজায়। তাই সকালের শুরুতেই পিটিতে কেউ মার খেতে চাইতোনা। পিটি শেষে যে যার ক্লাসে চলে যেত। নিয়মিত প্রতি ক্লাসে স্যাররা আসত। পড়া না পারলেই মার। সেই বেতের বাড়িতে যেন একটা মায়া থাকত। ঠিকই স্যার পড়াটা আবার বুঝিয়ে দিত সবাইকে।
অনেকের কাছে ক্লাস দীর্ঘ লাগত। মনে হত কখন যে টিফিন হবে। ভাবতে ভাবতে টিফিনের বেল। অনেকেই টিফিন খেত বাটারবন, ক্রিমরোল। এখন বাটারবন দেখা গেলেও দুই একটা টনের দোকান ছাড়া ক্রিমরোলের দেখা পাওয়া যায়না। অনেকে গেটে থাকা দারোয়ান মামাকে পাটাত। দারোয়ান মামা ঝালমুড়ি এনে দিত। গেটের বাইরে ফুসকা বিক্রি হত। ছোটদের বাইরে যাওয়া নিষেধ হলেও বড়রা ঠিকই দারোয়ান মামাকে পটিয়ে বাইরে থেকে ফুসকা খেয়ে আসত। গরমের সময় মালাই আইসক্রীম বিক্রি হত। ১ টাকা, ২ টাকা করে।
অনেকে আবার খাওয়া বাদ দিয়ে টিফিন সময়ে মাঠে খেলায় ব্যস্ত। ছেলেরা বল দিয়ে ফুটবল খেলায় ব্যস্ত। অন্যদিকে ক্লাসরুমেও কলম ফাইট, কাটাকাটি, বাক্স খেলা। শুধু মাত্র কলম দিয়ে কাটাকাটি খেলার জন্যই এক এক জন এতগুলা কলম নিয়ে আসত। অনেকেই ব্যস্ত কমিক বই পরিবর্তনে। সে সময় কাগজের কমিকস বই ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। চাচা চৌধুরী আর সাবু, দ্যা এডভেঞ্চার অফ টিনটিন, বিল্লু কমিকস পড়ে অনেকেই টিনটিন, বিল্লু ভাবত নিজেকে।
মেয়েরা পছন্দ করত পিংকি কমিকস। বড় ক্লাসের ছেলেমেযেরা তিন গোয়েন্দা,মাসুদ রানা,কুয়াশা পড়ত। সে সময় সেবা প্রকাশনীর এ বইগুলোতে যেন প্রাণের অস্বিত্ব ছিল। ক্লাসে বন্ধুরা একজন আরেকজনকে তিন গোয়েন্দার নাম অনুসারে কিশোর,মুসা,রবীন বলে ডাকত। এভাবে এক ক্লাসে অনেকগুলো কিশোর,মুসা,রবীন হয়ে যেত। ক্লাসের বিশিষ্ট ভাল ছাত্রছাত্রীরা আবার এসব পড়ত না। তারা পড়ত জাফর ইকবালের সায়েন্সফিকশন বই। সরকারি স্কুলগুলোতে মাঝে মাঝে মিটিং হত। এই সুযোগে স্কুল আগে ছুটি হলে সবাই আনন্দ করত। ছুটি শেষে সবাই বাসায়। কেউ কেউ বিকেলে প্রাইভেত পড়তো। হাতে গোণা কোচিং সেন্টার ছিল। তবে বেশিরভাগই বাসায পড়ত। বিকেলে বাইরে গিয়ে আবার খেলা। এর মধ্যে বাড়ির কাজ শেষ করে ফেলত অনেকে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসা।
পড়া শেষে রাত ৯টার অপেক্ষা। কখন শুরু হবে! ম্যাকগাইভার, ডিএটীম, সিনবাদ। ম্যাকগাইভারের মতও অনেকে হতে চেষ্টা করত। মীনা কার্টুনের গানটি মুখস্ত ছিলোনা এমন কিশোর কিশোরী খুজে পাওয়া কষ্ট ছিলো। আমি বাবা মায়ের শত আদরের.. দারুন একটা গান। রাত ১০ টা বাজলেই ঘুম। কাউকে বলতে হতনা। অনেকে আবার রাতের পড়া শেষে গল্পের বই পড়ত। ছেলে মেয়েরা ক্যাসেট প্লেয়ার দিয়ে গান শুনত আবার ক্যাসেট প্লেয়ারের ফিতা দিয়ে মজার খেলাও খেলতো।
সে সময়টায় এখনের মত এত চকলেট,ক্যান্ডি ছিলনা। ছিল নাবিস্কো লজেন্স। সবচেয়ে ভালর মধ্যে ছিল ডেইরি মিল্ক মিমি। চিপসের মধ্যে ছিল পটেটো,মি: টুইস্ট।
শীতকালে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে সবাই নানাবাড়িতে যেত পিঠা পায়েশ খেত, খুব মজা করত। সময়ের সাথে সাথে পার হয়েছে অনেকগুলো বছর। আমুল পরিবর্তন হয়েছে সব কিছুই।
এখনকার সময়ের শৈশব পুরোটাই আগের সময়ের থেকে আলাদা। শহুরে সকালে যে ছেলে বা মেয়ে ঘুম থেকে উঠে তার উপর থাকে বিশাল দায়িত্ব। সকালে ফ্রেশ হয়েই রুটিন অনুসারে একগাদা বই গুছানো। আবার সেই বইয়ের বেজায় ওজন। ছোট ছোট শিশুরা সেই ব্যাগের ভারেই নুইয়ে পড়ে। ওদেরও করার কিছুই নাই। বই সব নিয়ে গেলে স্যার-ম্যাডাম খুশি হবেন। শুধু বই না সাথে ইয়া মোটা মোটা গাইড বই। স্কুলে যাওয়ার জন্য এখর আর হাঁটতে হয়না। এখন সবখানেই স্কুল। অনেকে আবার গাড়ি ব্যবহার করে। অনেক অভিভাবকরা সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন। স্কুলের পড়া শেষ করে আবার ফ্ল্যাট বাসায়। গোসল করে খেতে খেতে কোচিংয়ের সময় হয়ে যায়। তাদের ছুটতে হয় কোচিংয়ের পানে। এখানেই কি শেষ। তা নয়।
বাসায় আসার পর প্রাইভেট টিচার। শেষ পর্যন্ত নিজের পড়ার সময় বের করতেই কঠিন হয়ে যায়। এর মধ্যে ফুরসত পেলে ট্যাবে গেম খেলা। অনেকে আবার প্লে স্টেশনে গেম খেলে। ঐ সুউচ্চ চার দেয়ালের জেলখানা। যেখানে সাধারন জীবনের আওয়াজ যায় খুব কম। শিশুটি শৈশব থেকে এভাবেই বেড়ে উঠে। মনে করে এটাই হয়ত ছোট থেকে বড় হওয়ার আধুনিক সিস্টেম। বাবা-মা যে যার মত চাকরী করে বাসায় এসে ক্লান্ত। সন্তানের সাথে তেমন একটা বোঝাপড়া হয়ে উঠেনা। গতানুগতিক বন্ধু বা বান্ধবীর জন্মদিন হলে যাওয়া। কেক কাটা, ছবি তোলা।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ তো নতুন ক্লাশে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং শুরু করা। দম ফেলবার কোন সময় নেই। মানুষিক বিকাশ হওয়ারও কোন সুযোগ নেই। অনেক সময় দেখা যায় এই সব শিশু বাইরের কোনো মানুষের সাথে ভালোভাবে মিশতেও পারে না। একধরনের সংকোচবোধ কাজ করে। প্রযুক্তির ছোবলে সুবিধার পাশাপাশি তাদের শৈশবকে তছনছ করে দিচ্ছে।
এখনকার শিশুদের শৈশব কৌল্পিক, মোহময় এবং আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় বেশ উচ্চতর মাপের। সেই সময়ের শৈশবটা ছিল মনের আনন্দে ভরপুর আর এখন হচ্ছে ভার্চুয়াল সৌন্দার্য্যে ভরপুর। এই কারণে বয়স ১০ না হতেই চোখে চশমা চলে আসে।
এখন সবই আছে কিন্তু কোনো কিছুতেই আনন্দ নেই। শিশুদের শৈশব যেন এক যান্ত্রিক রোবটের মত। চলছে তো চলছেই। অভ্যস্তও হয়ে গেছে ওরা। হতেই তো হবে। করার যে কিছুই নেই।