ঢাকা, মঙ্গলবার ১৯, মার্চ ২০২৪ ১১:২৮:৪৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
হিলিতে পেঁয়াজের দাম কেজিতে কমেছে ৫০ টাকা ভোরে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ২০ রোহিঙ্গাদের জন্য ইউএনডিপিকে যে আহ্বান জানালেন প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ আরো শিশুসহ ৪ জনের মৃত্যু তিনদিনের সফরে সুইডেনের রাজকন্যা ঢাকায় গাজীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ আরও দুজনের মৃত্যু

তরুণ লেখক প্রকল্প: সেই সব জলপতনের গান

শান্তা মারিয়া | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:৫৫ পিএম, ২০ আগস্ট ২০১৯ মঙ্গলবার

সকাল থেকেই ঘুরে ফিরে একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে। আমার কবিতা নয়। রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দও নয়। মনে পড়ছে মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা কবিতার দুটি পংক্তি। ‘দেখি তুলে তার বুকের আচ্ছাদন, সেখানে এখনও বাস করে কিনা মন’। কেন মনে পড়ছে তারও কোন সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। এমন হয়, কোন কোন কবিতার চরণ অকারণেই মাথার ভিতর ঘুরপাক খায় কিছুতেই সরানো যায় না। তেমনি অকারণেই কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করে, লিখতে ইচ্ছা করে। এর কোন সাহিত্যিক মূল্য নেই। কলাম লিখে রোজগারের মতো আর্থিক উদ্দেশ্যও নেই।

আজকে আমার খুব ইচ্ছা করছে তরুণ লেখক প্রকল্পের দিনগুলো নিয়ে লিখি। কারও হয়তো জানার বা শোনার আগ্রহও নেই, কিন্তু সে যে আমার তারুণ্যের দিন, ভালোবাসার দিন, জলপতনের অবিশ্রাম শব্দে মুখরিত দিন।

৯৫ এর শেষ দিকে মাত্র মাস্টার্স শেষ হয়েছে। সে সময় সেশন জট ছিল প্রবল প্রতাপে। তাই ৯৩ তে যে মাস্টার্স শেষ করার কথা তা গড়িয়ে গড়িয়ে ৯৫তে এসে ঠেকেছে। তখনও রেজাল্ট বের হয়নি। হলেই এমফিলে ভর্তি হয়ে যাব।

ডিসেম্বরে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমিতে কোন একটা কাজে। সেসময় মহাপরিচালক ছিলেন ড. মনসুর মুসা। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন ছোটবেলা থেকেই। দাদার ছাত্র ছিলেন, সেই সুবাদে বাবাকে ‘তকীভাই’ বলে ডাকতেন এবং যথেষ্ট সম্মান করতেন। তিনিই বললেন, বাংলা একাডেমিতে তরুণ লেখক প্রকল্প নামে একটা কর্মসুচি চলছে। প্রথম ব্যাচ এখন শেষ পর্যায়ে। দ্বিতীয় ব্যাচের জন্য আবেদন পত্র নেওয়া শুরু হয়েছে। ‘তুমি কালকেই আবেদন পত্র জমা দাও’।

আবেদনের সঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ২০টি লেখাও জমা দিতে হবে পত্রিকার কাটিংসহ। সেসব নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না। বাবা ফাইল করে আমার সব প্রকাশিত লেখা গুছিয়ে রাখতেন। তড়িঘড়ি আবেদন পত্র জমা দেওয়া হলো। একটা মৌখিক পরীক্ষা হলো। ফলাফল প্রকাশিত হলে প্রকল্পে সুযোগ পাওয়া ৪০ জনের ভিতরে আমার নাম(চতুর্থ স্থানে) দেখে উত্সাহিত হলাম। প্রথম স্থানে ছিলেন মতিন রায়হান।

১৯৯৬ সাল। জানুয়ারির এক তারিখে ক্লাস শুরু হলো। শুরু হলো স্বপ্নময় ছয়টি মাসের অভিযাত্রা। প্রকল্পের প্রথম দিনটিতে আমার আলাপ হয়েছিল অনু ভাইয়ের (প্রয়াত ড. অনু হোসেন) সঙ্গে। তিনি আমার বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়েছিল প্রবল। তার সঙ্গে আমৃত্যু সেই বন্ধুত্ব অটুট ছিল। তিনি তখন বাংলা একাডেমিতে কোন প্রকল্পে ছিলেন। কবি সরকার আমিন তখন বাংলা একাডেমিতে চাকরি শুরু করেছেন কিনা আমার মনে নেই। তবে তিনি লেখক প্রকল্পের তরুণদের সঙ্গে খুব আড্ডা দিতেন। প্রথম ব্যাচে আরও ছিলেন চঞ্চল আশরাফ, শোয়েব জিবরান, মুজিব ইরম, সাকী মোহাম্মদ, জেনিস মামুন, ফাতিমা তামান্না, ইশাররফ হোসেন, আবদুল বাতেন। অনুভাই এবং সুজাতা আপার (ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের মেয়ে) সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছিল।

লেখক প্রকল্পে আমাকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছিলেন কবি রফিক আজাদ। রফিক ভাই অনবদ্য একজন মানুষ। আপাদমস্তক কবি। তিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন প্রকল্পে। কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, কবি আসাদ চৌধুরি এবং কবি রফিক আজাদ তিনজন ছিলেন নিবিড় প্রশিক্ষক। সুব্রত বড়ুয়া গদ্য বিষয়ক ক্লাস নিতেন। মনসুর মুসা স্যারও কখনও কখনও ক্লাস নিতেন। সেলিনা আপাও। হুমায়ূন আজাদ, নরেন বিশ্বাস, রূপা চক্রবর্তিসহ আরও অনেক শিক্ষক ক্লাস নিয়েছেন মনে পড়ে।

কবিতার জন্য তিনটি গ্রুপ ভাগ হয়েছিল। আমি ছিলাম আসাদ চৌধুরির গ্রুপে। আসাদ ভাই গল্প করতে ভালোবাসতেন। রুপার তৈরি পানের কৌটা থেকে পান খেতেন। পান খাওয়াকে রীতিমতো শিল্পে পরিণত করেছিলেন আসাদ ভাই। আসাদ ভাইয়ের কথায় পরে আবার আসবো। প্রথমে রফিক আজাদভাইয়ের কথা বলি।

আমি তখন জীবনানন্দে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রফিকভাই উপদেশ দিলেন, জীবনানন্দকে বর্জন করতে। বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দ খুব মারাত্মক কবি। তার কবিতা মাদকের চেয়ে বেশি নেশাগ্রস্ত করে। তাকে ভুলতে না পারলে নিজস্ব কবিতা-ভাষা তৈরি করা যাবে না। মনে হবে জীবনানন্দের ওয়েস্টপেপার বাস্কেট থেকে তুলে এনে কবিতা লিখছ।’

লেখক প্রকল্পে আমাদের কয়েকজন তরুণ লেখকের চোখে তখন দুর্দান্ত সব স্বপ্ন। সেই স্বাপ্নিক অভিযাত্রায় তিনি ছিলেন পথ দেখানো আলো। তিনি আমাকে এবং আমাদের অনেককে শিখিয়েছিলেন স্বপ্ন দেখতে। শিখিয়ে ছিলেন নিজের স্বপ্নকে ভালোবাসতে। প্রকৃত জৈমিনী হয়ে তিনি আমাদের সামনে খুলে দিয়েছিলেন এক নতুন জগৎ। তবে শুধু স্বপ্ন নয়, কবিতা নয়, তিনি প্রায়ই বলতেন, প্রতিটি শিল্পই রক্ত দাবি করে। দাবি করে সমগ্র জীবন। শিল্পের পথে যারা চলাচল করে তাদের জীবন বড় কষ্টের, বড় যন্ত্রণার। সেই যন্ত্রণার স্বরূপ তিনি দেখিয়েছিলেন। তবে রূঢ় ভাবে নয়, বরং আশ্চর্য মায়ায়।

শৈশবে তিনি ছিলেন আমার কাছে ‘রফিকচাচা’ যেহেতু বাবাকে তিনি ভাই বলতেন। কিন্তু লেখক প্রকল্পে তিনি হয়ে গেলেন ‘রফিকভাই’। কি অনায়াসে তিনি মুছে ফেললেন বয়সের কাঁটাতার|। কত সহজে, কত অসংকোচে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন, গল্প করতেন তা ভাবলে এখন আমি অবাক হই। তখন কিন্তু সেই বিস্ময় বোধটুকু জাগেনি। কারণ সেটা ছিল এতই অনায়াসলব্ধ যে এর ব্যতিক্রম কিছু হতে পারে তা ভাবনায় আসেনি। তারমতো বিখ্যাত কবি আমাদের মতো তরুণ সদ্য লিখতে শুরু করা, হাঁটিহাঁটি পা ছেলেমেয়ের সঙ্গে এমন সহজে জীবন ও শিল্পের জটিল রহস্যগুলো তুলে ধরতেন যে মনে হতো তিনিও আমাদের বন্ধু।

তিনি আমাদের কবিতা বিষয়ক ক্লাস নিতেন। মাঝেমধ্যেই বলতেন, ‘চলো এখানে না। এখানে বড্ড বেশি ক্লাস আর পড়াশোনা গন্ধ। চলো বরং বটের ছায়ায়। ’সত্যি আমাদের আড্ডা জমতো বাংলা একাডেমির বিখ্যাত বটগাছের ছায়ায় বাঁধানো বেদীতে বসে। তার কাছে শুনেছিলাম এটাকে নাকি বলা যায় বোধিবৃক্ষ। ঠাট্টা করেই বলতেন অবশ্য। ভীষণ ভালো লাগতো বোধিবৃক্ষের তুলনাটি। রফিকভাইয়ের মতো এতবড় কবির আচরণ ছিল কি সহজ। সত্যি কথা হলো, অন্তঃকরণে শিশুর সহজ সারল্য না থাকলে এত বড় হওয়া যায় না। তার কথা উদ্ধৃত করেই বলি ‘আগে মানুষ হিসেবে ভালো হওয়া তারপর তো বড় কবি’।

রফিকভাই ছিলেন আপাদমস্তক কবি। তিনি বেহিসেবী, বেখেয়ালি মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন বাংলা কবিতার ছন্দ ও ইতিহাস। বলাবাহুল্য মোটেই স্কুলমাস্টারি ভঙ্গিতে নয়। গল্পচ্ছলে। কথায় কথায় তিনি শোনাতেন বিশ্বকবিতার ইতিহাস। মনে পড়ে বলতেন লোরকা, জীবনানন্দ, এসেনিন আরও অনেকের কথা। একবার তিনি অ্যাক্রসটিক নিয়ে একটি ক্লাস নিলেন। আমি তাকে নিয়ে একটি অ্যাক্রসটিক লিখে তাকে দেখালাম| কবিতার প্রতিটি লাইনের প্রথম অক্ষরগুলো মেলালে হয় ‘কবি রফিক আজাদ’। কবিতাটি তাকেই উত্সর্গ করা। এই ছেলেমানুষী দেখে তিনি হাসলেন।

বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণটি ছিল আমার অতি আপন। প্রকল্পে আমাদের মূল কাজ ছিল আড্ডা দেওয়া। বাংলা একাডেমিতে আমরা সারাদিন গড়াতাম বলা যায়। মতিন রায়হান, মহিবুল আলম, বায়তুল্লাহ কাদেরি, তপন বাগচী, রণক মুহম্মদ রফিক, আয়শা ঝর্ণা, আইরিন পারভিন, মিল্টন বিশ্বাস, নাজিব তারেক, কুমার বিপ্লবসহ আমরা কয়েকজন ছিলাম বেশি ঘনিষ্ট। একটা কবিতা লিখে পরদিনই সবাইকে দেখানো চাই। আমার একটা খাতা ছিল। ওটাতে প্রতিদিন কবিতা লিখতাম। সেগুলো অবশ্য কবিতাও হয়নি, কবিতার জাতও হয়নি। কিন্তু কলমটা তৈরি হচ্ছিল। (চলবে)

শান্তা মারিয়া: প্রবাসী কবি ও কলামিস্ট