ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ২০:৩৯:৫১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি ছাড়াবে আগামী সপ্তাহে থাইল্যান্ডের গভর্নমেন্ট হাউসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী চলতি মাসে তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই গাজীপুরে ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ

শহীদ সেলিনা পারভীন : হারানো এক নক্ষত্র

রাতুল মাঝি | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০৮:০৭ পিএম, ২৯ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার

সবকটা জানালা খুলে দাও না/ওরা আসবে চুপি চুপি/যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ…। হ্যা। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা অপেক্ষা করি তাদের জন্য যারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের দিয়ে গেছেন একটি ভূ-খণ্ড, একটি মুক্ত দেশ। আমরা তাদের ভুলিনি, তাদের ভুলতে পারি না।


দেশকে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছেন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন ছিলেন স্বাধীনচেতা এক নারী। একজন নির্ভীক কলম সৈনিক। যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতা করে গেছেন।

১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। তারা চলে আসেন ঢাকায়।


১৯৫৮ সালে সেলিনা ঢাকা আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল পরিচালক হিসেবে চাকুরি নেন। পরের বছর কর্তৃপক্ষের সাথে মতের অমিল হওয়ায় তিনি চাকুরি ছেড়ে দেন। পরে তিনি ’ললনা’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করতেন তিনি ৷ বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলা সব কাজ একাই করতেন। পত্রিকা অফিস থেকে বেতন হিসাবে অনেক সময় তেমন কিছুই পেতেন না।


ছোটবেলা থেকেই সেলিনা পারভীন ভীষণ সাহিত্য অনুরাগি ছিলেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই তিনি গল্প-কবিতা লেখা শুরু করেন।


ললনায় কাজ করতে করতে ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৬৯ বের করেন ’শিলালিপি’ নামে একটি পত্রিকা ৷ নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন ৷ শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মত ৷ শিলালিপিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, আ ন ম গোলাম মোস্তফা ও জহির রায়হান নিয়মিত লিখতেন। দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি এক সময় সকলের নজর কাড়ে স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা হিসেবে। শিলালিপির সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ৷


১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। জাতির ক্রান্তিকালে সেলিনা নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন `৬৯-এর আন্দোলনে, ২১ ফেব্রুয়ারি সভা কিংবা পল্টনের জনসভায়। যোগ দিতেন শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ সভায়ও।


অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারের মত ব্যক্তিত্বদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হয়ে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন কোথাও পালিয়ে যাননি। ঢাকায় নিজ বাসায় অবস্থান করছিলেন পরিবার নিয়ে।


স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তার বাসায় মাঝে মাঝে রাতে তরুণরা আসতেন। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে তারা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর টাকা নিয়ে যেতেন। শিলালিপি বিক্রির টাকা দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। এই তরুণদের সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ৷ চারদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ আর প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ। চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। দেশের এ অবস্থায় ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।


শিলালিপির উপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়গ। হাসেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরে অবশ্য প্রকাশের অনুমতি মেলে। তবে শর্ত হলো নতুনভাবে সাজাতে হবে। সেলিনা পারভীন তার ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির শেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পাকিস্তান সরকার ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান। এ সংখ্যাটি ছিল দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের লেখায় ভরা। সব লেখাই ছিলো স্বাধীনতার পক্ষে। এটাই কাল হলো সেলিনার জন্য। নতুন আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন তিনি।


১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিনদিন বাকি। দেশের বেশ কিছু অঞ্চল ইতমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫ নিউ সার্কুলার রোডে। বাড়িতে তারা তিনজন থাকতেন। শিশু পুত্র সুমনসহ তিনি, মা আর তার ভাই উজিরউদ্দিন ৷


সেদিন শীতের সকালে তারা সকলেই ছিলেন ছাদে। সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিলো। সেলিনা চেয়ারে বসে বসে একটি লেখা তৈরি করছিলেন। সারা শহরজুড়ে তখন কারফিউ চলছিলো৷ রাস্তায় পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সুমনদের বাড়ির উল্টো দিকে ই.পি.আর.টিসি-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামলো ৷ সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কয়েকজন লোক। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা। মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা।


সুমনদের ফ্ল্যাটে এসে একসময় কড়া নাড়ে তারা ৷ সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এ সময় সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে তাদের সাথে নিয়ে যায়। সেই যে তিনি গেলেন, আর ফিরে এলেন না।


১৮ ডিসেম্বর সেলিনার গুলি-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গেলো রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। ডিসেম্বরের হীম শীতের কারণে সেলিনা পায়ে মোজা পড়া ছিলেন। মৃতদেহ যখন পাওয়া যায় তখনও তার পায়ে ছিলো সাদা মোজা। এটি দেখেই তাকে সনাক্ত করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে। পরে ১৮ ডিসেম্বর আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।


নির্ভিক সাংবাদিক সেলিনা পারভীন শুয়ে আছেন আজিমপুর কবরস্থানে। তিনি ঘুমাননি। পাহারা দিচ্ছেন দেশকে। তিনি জেগে আছেন। তিনি ঘুমান না। কারণ শহীদরা জেগে থাকে, শহীদরা ঘুমায় না।