ঢাকা, বুধবার ০৮, মে ২০২৪ ৭:৫৬:৫৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ জিম্মি মুক্তিতে হামাসের সম্মতির পরও গাজায় যুদ্ধবিরতি অনিশ্চিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক রুটিনে ক্লাস শুরু আজ হজের ফ্লাইট শুরু ৯ মে পুলিৎজার পেল রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস

জননী সাহসিকার জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলী

দিলরুবা খান | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:০৯ এএম, ২০ জুন ২০২২ সোমবার

ফাইল ছবি।

ফাইল ছবি।

আজ ২০ জুন সোমবার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা, ব্যাক্তিত্ব, নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রসেনানী, শক্তির প্রতিক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী বেগম সুফিয়া কামালের ১১১তম জন্মদিন। আজ আমরা তাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। 
কবি সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের এই দিনে বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারে মাতুলাললয়ে জন্মেছিলেন। তার বাবা সৈয়দ  আব্দুল বারি এবং মা সাবেরা খাতুন। স্বামী কামাল উদ্দিন। সুফিয়া কামালের পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু। সেই সময় মেয়েদের বাংলা পড়তে  দেওয়া হতো না। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঘর থেকেই। মায়ের কাছে বাংলা শিখেছেন তিনি। মামা খোদাবক্সের ছিল বিশাল এক লাইব্রেরি। তাতে বিভিন্ন ভাষার বই ছাড়াও ছিল দেশি-বিদেশি ম্যাগাজিনের ছড়াছড়ি। লাইব্রেরিতে আসত প্রবাসি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকা। যা থেকে সুফিয়া কামালের ভেতরে লেখালেখির সুদৃর ইচ্ছা -তিনি লিখতে পারবেন। তার এ বিশ্বাস থেকেই মত্র ১০/১১ বছর বয়সেই তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। লেখা  প্রকাশ হওয়ার কারণে তার মামা ভীষণ রেগে যান। শুধু  তাই নয়, শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের কঠোর অবরোধ প্রথার জন্য স্কুলেও যাওয়া হয়নি তার। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর শায়েস্তাবাদ ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে বরিশাল চলে আসেন। স্বামীর সহযোগিতায় তার শিক্ষা ও কাব্য প্রতিভার বকাশ ঘটে। সেই সময় বিপ্লবী অশ্বিনী দত্তের ভাই তরুণ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। সেই পত্রিকায় সুফিয়া কামালের লেখা প্রথম ছোট গল্প ‘সৈনিক বধু’ ছাপা হয়। তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষা’। পত্রিকায় লেখা ছাপা নিয়ে পরিবারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয় এবং নানা গঞ্জনাও সইতে হয় তাকে। 
এরপর তার স্বামী মারা গেলে তার সঙ্গে নানা অসহযোগিতা শুরু হয়। এসময় তিনি মা ও শিশুকন্যাসহ কলকাতায় চলে আসেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই  সুফিয়া কামাল কলকাতা করোনেশন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। ক্রমশ উঠে দাড়ালেন নিজের পায়ে। নিজেকে তৈরি করে নিলেন কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে। নতুন করে মন দিলেন সাহিত্যচর্চায়। দিনে খুব একটা  সময় পেতেন না। বেশিরভাগ লেখাই লিখেছেন রাতে। রাতের এই নিভৃতিচারি লেখকই  পরবর্তী সময়ে বিশ্বভুবনে জায়গা করে নেন। 
সাহিত্যক্ষেত্রে জায়গা করে নেয়ার পেছনে যাদের অবদান আছে তারা হলেন, কাজী নজরুল ইসলাম এবং সওগাত সম্পাদক  মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন ৷ নাসির উদ্দীন তার মধ্যে  আবিষ্কার করেন  যথার্থ  কাব্য প্রতিভার। তিনি শুধু সুফিয়া কামালের কবিতাই ছাপেননি, মহিলা সংখ্যা সওগাতে ছেপে দেন তার ছবিও। সে সময় এটা ছিল এক চরম বিষ্ময়কর ঘটনা! 
১৯৪৭ সালে বেগম পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হলে নাসির উদ্দীন তার ওপর সাপ্তাহিক বেগম সম্পাদনার ভার দেন। 
ঐ বছর ২০ জুলাই বেগম পত্রিকার সম্পাদকীয়তে সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন-‘মুসলিম সমাজ আজ কঠোর  দায়িত্ব গ্রহণের সম্মুখীন। অর্জিত স্বাধীনতা, সম্মান ও গৌরবের স্থান  রাখতে হলে কেবল পুরুষেরই  নয়, নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে। এজন্য আমাদের মানসিক প্রসার ও আকাঙ্ক্ষার ব্যাপ্তি আর জীবন সম্পর্কে হোক স্থির ধারণা’। 
সাহিত্যচর্চায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ লাভ করেন সুফিয়া কামালি। কবির জন্মদিনে একটি কবিতার মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন তিনি। তার প্রথম কবিতা ‘সাঝের মায়া’ কবিগুরুকে উপহার পাঠালে তিনি কবিতাটি পড়ে মন্তব্য করেছিলেন-‘তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করেছে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উচ্চে এবং নিশ্চিত তোমার প্রতিষ্ঠা’। বিশ্বকবির এ  প্রত্যাশা সত্যি হয়েছিল। সুফিয়া কামালের কবিতা ও গল্প রাশিয়া এবং আমেরিকায় অনুদিত হয়েছে। এছাড়াও  বিভিন্ন ভাষায় তার কবিতা অনুবাদ হয়েছে। নবাব পরিবারে মানুষ হলেও সুফিয়া কামাল নানারকম কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। কিশোর বয়সেই  ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত করেন তিনি। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বাসভবন হয়ে ওঠে  মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম কেন্দ্র।
সুফিয়া কামালের জীবনের উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে ১৯২৫ সালে অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়  গান্ধীজী বরিশালে এলে নিজে চড়কায় সুতা কেটে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। ২৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কলকাতার লেডি ব্রেবোন কলেজে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করেন তিনি। 
সুফিয়া কামালই ছিলেন সে যুগের প্রথম বাঙালি মুসলমান নারী, যিনি সমাজের নিন্দা উপেক্ষা  করে পাইলটের সঙ্গে বিমানে চড়েছিলেন। মাত্র ১৩/১৪ বছর বয়সেই তিনি মাতৃমঙ্গল সমিতি  গঠণ করেছিলেন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের  সঙ্গে আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম গঠন করেন। ওয়ারী মহিলা সমিতি, নারী পুনর্বাসন সংস্থা, বেগম ক্লাব, বুলবুল ললিত কলা একাডেমি, ছায়ানট প্রভৃতির সঙ্গে  শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন তিনি। ছায়ানট ও সোভিয়েত মৈত্রি  সমতির দীর্ঘদিন সভাপতিত্ব করেছেন। কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার, প্রতিষ্ঠাতা এবং উপদেষ্টা, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে বাহাদুর শাহ পার্কে সুফিকামালসহ অন্য নারীরা সভা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পুরস্কার পান, যা তিনি  ছাত্র আন্দোলনের  সময় ফিরিয়ে দেন।  
সুফিয়া কামাল যেসব পুরস্কার পেয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হলো-১৯৬২ সালে  বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যা বিনোদিনী পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক, শেরে বাংলা জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার। 
আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে  রয়েছে, ১৯৭৭ সালে রাশিয়া থেকে লেনিন পুরস্কার, ২৯৮১ সালে চেকোস্লোভাকিয়া সংগ্রামী নারী পরিষদ পুরস্কার। এই পুরস্কার বিশ্বের ১৬টি দেশের সংগ্রামী নারীদের দেয়া হয়। ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেম্বার অব কংগ্রেস পুরস্কার এবং ক্লাব অব বোস্টন সনদ পান। 
সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য  বইগুলো হচ্ছে, কেয়ার কাঁটা, সোভিয়েতের দিনগুলো, মায়াকাজল, একালে আমাদের কাল, সাঁঝের মায়া, উন্মুক্ত পৃথিবী, মন ও জীবন, প্রশান্তি ও প্রার্থনা, দিউয়ান, মৃত্তিকার ঘ্রাণ, স্বনির্বাচিত কবিতা, ইতল বিতল, নওল কিশোরের দরবারে প্রভৃতি। 
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর এই মহীয়সী নারীর মহাপ্রয়াণ ঘটে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে, জাতির সংকটে, বাতিঘরের মতো বাংলাদেশের মানুষকে যিনি পথ দেখিয়েছেন, সব কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যিনি ছিলেন সোচ্চার তিনি থাকবেন দেশের মানুষের হৃদয়ে চির ভাষ্মর হয়ে।