ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:১৭:৪৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদা জিয়ার অবস্থা এখনও উদ্বেগজনক আরও পেছাল খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা খালেদা জিয়ার এন্ডোসকপি সম্পন্ন, থামানো গেছে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ আগারগাঁওয়ে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ, নারীসহ দগ্ধ ৬ প্রবাসীদের নিবন্ধন ছাড়াল এক লাখ ৯৩ হাজার

চলুন যাই ‘রেশমনগরী’ রাজশাহী : অনু সরকার

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:৫৬ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০১৯ রবিবার

প্যারিস রোড, রাশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

প্যারিস রোড, রাশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি শহর রাজশাহী। বলা হয়, দেশের মধ্যে ‘রাজশাহী’ এমনই একটি সবুজ শহর, যেখানে নীরবে, নিভৃতে, কোনো ঝামেলা ছাড়াই একান্ত কিছু সময় কাটানো যায়।

পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিভাগীয় এই শহরটি রেশম, আম, লিচু এবং সবুজ-পরিচ্ছন্ন প্রকৃতির জন্য প্রসিদ্ধ।

রেশমি বস্ত্রের কারণে রাজশাহীকে ‘রেশমনগরী’ নামে ডাকা হয়। রাজশাহীর রেশম কাপড়ের খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।

রাজশাহী শহরে উল্লেখযোগ্য এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার অনেকগুলোর খ্যাতি আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে।

দেশের অন্যতম বিদ্যাপিঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও নামকরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য রাজশাহী শহর শিক্ষানগরী নামেও সমান পরিচিত। রাজশাহী শহর এবং এর আশ-পাশে বেশ কিছু বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক মসজিদ, মন্দির ও উপাসনালয় তথা ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। যেগুলো দর্শনে ভিড় থাকে বছর জুড়েই।

কখনও যদি আপনার মনে হয় যে, এই ব্যস্ত নাগরিক জীবনের কোলাহল আর সুউচ্চ অট্টালিকার জঞ্জাল থেকে বেরিয়ে কোনো শান্ত শহরে কয়টা দিন নিরিবিলিতে কাটাবেন। তাহলে রাজশাহীর জুড়ি নেই সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বুক ভরে পদ্মানদীর নির্মল বাতাস নিতে রাজশাহী মহানগরের লালন শাহ পার্কে প্রতিদিন বিকেলে লাখো মানুষ ভিড় করেন। শহরের ভেতরেও বেশ পরিচ্ছন্ন একটা চেহারা চোখে পড়ে। সড়ক বিভাজকজুড়ে সবুজের বেষ্টনীসহ সব মিলিয়ে রাজশাহী এখন একটি নির্মল বাতাসের শহর।

এখানে একদম হাতের কাছেই রয়েছে সব নাগরিক সুবিধা। ইচ্ছে হলেই পাওয়া যাবে প্রয়োজনীয় সবকিছু। কেবল থাকবে না কোনো কোলাহল, ধুলোবালি বা কালো ধোঁয়ার অসহ্যতা, বাস-ট্রাকের অবিরত হর্ন, থাকবে না শিল্প-কারখানার বর্জ্য দূষণের অবিরাম নিঃসরণ।

থাকবে না নিরন্তর জ্যামে বসে থেকে সময়কে অসময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়ার অনিচ্ছাকৃত মন খারাপ। ঠিক এমন করেই যদি কোনো বেড়ানোর জায়গা পেতে চান তো নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারেন এক রাজসিক রাজশাহীতে।

আমের রাজধানী রাজশাহী। আমের কারণে এই শহরের সুখ্যাতি দেশজুড়ে। ছোট-বড় সকলের পছন্দ আম। জৈষ্ঠ্য মাসে রাজশাহীর বিভিন্ন বাগান থেকে নানা জাতের সুস্বাদু আম ভাঙা শুরু হয়। যারা সরাসরি বাগান থেকে আম ভাঙা এবং সেখানে বসেই কনুই ভিজিয়ে রসালো আমের স্বাদ নিতে চান তারা এ সময় যাবেন আমের শহরে।

রাজশাহী শহরের আয়তন ৯৬ দশমিক ৭২ বর্গ কিলোমিটার। শহরের পুরোটাই পদ্মানদী ঘেঁষা। তাই শহরে জীবনের যারা নদীর অবিরাম বয়ে যাওয়া কলকল ধ্বনি শুনতে চান তারা আসবেন এই শহরে।

রাজশাহীর দর্শনীয় স্থান :

পদ্মাপাড় : পদ্মার তীরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে অনেক আগেই। তাই সব সময়ই শহরের আই-বাঁধ, টি-বাঁধ ও বড়কুঠি এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। পদ্মায় পানি থাকুক আর নাই থাকুক নির্মল বাতাস আর বাঁধ ভাঙা আনন্দে মনটাকে যে ভাসাতে পারবেন তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

নদীর পাড়জুড়ে জেগে থাকা ছোট-বড় বালুচর আর রয়েছে ক্ষুদ্র বনভূমি। সেই তপ্ত বালুচরেও খুঁজে পেতে পারেন এক অন্য রকম ভ্রমণ আনন্দ। এই শহর আপনাকে নিয়ে যাবে জীবনের ভিন্ন কোনো রোমাঞ্চকর স্মৃতিতে। কাটবে অনাবিল মুহূর্ত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এই ক্যাম্পাসটি বনভূমি আর অরণ্যে আচ্ছাদিত। অসম্ভব নান্দনিক সাজে সব সময় সেজে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের শুরুতেই সবুজের গালিচা-মোড়া জুবেরি ভবনের বিশাল মাঠ। সেই মাঠ পেরিয়ে কয়েক মিনিট হেঁটে ওপারে গেলেই স্বনামে খ্যাত প্যারিস রোড। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও বাঁক নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একদম সোজা।

এই সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আপনাকে স্বাগত জানাবে বিশাল বিশাল রেইন ট্রি, কেওড়া, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু আর পাতাবাহারের সারি। রাস্তার প্রতিটি সংযোগ সড়ক যা অন্যান্য ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত ৯০ ডিগ্রি কোণে দু’পাশে দু’টি কালভার্ট বা ছোট্ট ব্রিজ বসার জন্য। প্রতিটি ভবনের সামনে আর পেছনে সুবিশাল আর সুস্বাদু আমের বাগান।

প্যারিস রোডের একদম শেষে পৌঁছে ডানে গেলেই এক আধুনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন। পাশেই মুক্তিযুদ্ধের স্বাক্ষর রেখে যাওয়া ভাস্কর্য ‘সাবাস বাংলাদেশ’ স্বচ্ছ আর বিস্মৃত যার উন্মুক্ত মঞ্চ, ঝকঝকে সিঁড়ি, যেখানে রাত কাটে কতশত দুঃখ আর আনন্দমাখা মুখের হাজারো শিক্ষার্থীর।

আছে অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন, অনিন্দ্যসুন্দর লাইব্রেরি, বোটানিক্যাল গার্ডেন, নীরব আর নিরীহ রেললাইন আর তার পাশের চারুকলা। আছে অদ্ভুত সুন্দর এক পুকুর, যে পুকুর কাটা হয়েছে অবিকল বাংলাদেশের ম্যাপের অনুকরণে। ভীষণ আকর্ষণীয় একটা জায়গা এটি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি : চারুকলা থেকে কিছুদূর পেছনে গেলেই পাবেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি। নাম না জানা অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভটি। ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল আবিষ্কৃত একটি গণকবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম এবং স্থানীয় ঠিকাদার জেবর মিয়া গণকবরটি খনন করেন। এ মৃত্যুকূপ থেকে বেরিয়ে আসে হাজারো মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কাল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ শামসুজ্জোহা হল ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি। ৯ মাস ধরে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকার ও আল-বদররা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী কাটাখালি, মাসকাটা দীঘি, চৌদ্দপাই, শ্যামপুর, ডাশমারী, তালাইমারী, রানীনগর ও কাজলার কয়েক হাজার নারী-পুরুষকে এখানে ধরে এনে হত্যা করে।

পাক সেনাদের হাত থেকে রেহাই পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র, কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও। এই হলের পেছনে এক বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ছিল বধ্যভূমি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কাজলা এলাকা এবং রেলস্টেশন এলাকায় পাওয়া যায় আরও কয়েকটি গণকবর।

পুঠিয়ার রাজবাড়ী : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেখা শেষ হলে ঘুরে আসতে পারেন পুঠিয়ার রাজবাড়ী। পুঠিয়া রাজবাড়ীর দর্শনীয় দিকগুলো- পাঁচআনি জমিদারবাড়ী, রাজবাড়ী, গোবিন্দ মন্দির, বড় শিব মন্দির, জগন্নাথ/রথ মন্দির।

রাজশাহীর অন্যতম উপজেলা পুঠিয়া। প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে পুঠিয়ার রাজবংশ বৃহত্তর রাজশাহী জেলার জমিদার বংশগুলোর মধ্যে তৃতীয়। পুঠিয়া রাজবাড়ীর বিশাল চত্বরে রয়েছে নজরকাড়া প্রাচীন মন্দিরগুলো।

এছাড়াও পুকুর-দীঘিসহ নানান প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। রাজশাহী শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার এবং রাজশাহী-নাটোর মহসড়ক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ী।

পুঠিয়ার রানি ভুবন মোহিনী দেবী ১৮২৩ সালে এই রাজবাড়ী প্রতিষ্ঠা করেন। পুঠিয়ায় অবস্থিত অধিকাংশ মন্দিরে পোড়ামাটির ফলক আছে। এখানকার পুরাকীর্তির মধ্যে পাঁচআনি রাজবাড়ী বা পুঠিয়া রাজবাড়ী, চারআনি রাজবাড়ী ও ১৩টি মন্দির রয়েছে।

এর অদূরেই রয়েছে নাটোরের বিখ্যাত রাজবাড়ী। যেখানে বনলতা সেন আর তার কবিতা, রয়েছে দেশজোড়া খ্যাতির কাঁচাগোল্লা, আমবাগানের স্বর্গের ছায়া, লিচুবাগানের আমন্ত্রণ।

এছাড়া রাজশাহী শহর থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে প্রাচীন সোনা মসজিদ। এই মসজিদটি সুলতান হুসাইন শাহর শাসনামলে ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়। মসজিদের ৫০টি গম্বুজ মূল্যবান ধাতু দিয়ে খচিত থাকায় এটিকে ছোট সোনা মসজিদও বলা হতো। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও জাদুঘর বিভাগ মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ করছে। আর ছোট সোনামসজিদ ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলে আখ্যাত।

এটি বাংলার রাজধানী গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর কোয়াটার্স’র তাহখানা কমপ্লেক্স থেকে অর্ধ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কোতোয়ালী দরজা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। বিশাল এক দীঘির দক্ষিণপাড়ের পশ্চিম অংশজুড়ে এর অবস্থান। মসজিদের কিছুদূর পশ্চিমে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিফতরের কয়েক বছরের আগে নির্মিত একটি আধুনিক দ্বিতল গেস্ট হাউস রয়েছে।


বরেন্দ্র জাদুঘর : রাজশাহী আসবেন অথচ বরেন্দ্র জাদুঘরে যাবেন না তাই কি হয়? বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ সংগ্রহশালা রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর। বাংলাদেশের সব চেয়ে প্রাচীন ও প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক এই জাদুঘর বাংলার ব-দ্বীপ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক কোষাগার হিসেবে পরিচিত।

পাল সেন আমলের প্রতিমা ভাস্কর্যের জন্য জাদুঘরটির খ্যাতি সারাবিশ্বে। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের বহুবিধ প্রত্ননিদর্শন এ জাদুঘরে সংগৃহীত রয়েছে।

প্রত্ন নিদর্শনগুলো প্রধানত প্রস্তর, স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, পিতল, ব্রোঞ্জ, লৌহ, মৃন্ময় ইত্যাদি দিয়ে নির্মিত। জাদুঘরে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানি ও মুঘল আমলের অমূল্য সব প্রত্ন নিদর্শন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু কিনে আনা হয়েছে, আবার অনেকে স্বেচ্ছায় দান করেছেন।

১৪টি গ্যালারিতে এগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ময়নামতির অনেক অমূল্য প্রত্নসম্পদ সংগৃহীত রয়েছে।

জাদুঘরের বৌদ্ধ গ্যালারিতে পঞ্চম শতাব্দীর একটি বেলে পাথরের মূর্তি রয়েছে। এ ধরনের মূর্তি বাংলাদেশে চারটি রয়েছে। তার মধ্যে বরেন্দ্র জাদুঘরে দু’টি। বাকি দু’টির একটি কুমিল্লা জাদুঘর ও অপরটি চট্টগ্রাম জাদুঘরে রয়েছে।

এই জাদুঘরে ৩য় ও ৫ম শতাব্দীর হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে। জাদুঘরে বিভিন্ন যুগের প্রায় ৬ হাজার মুদ্রা রয়েছে। স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে ৩৮টি। এছাড়াও রয়েছে দেখার অনেক কিছু।