ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ২২:০১:০২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

একাত্তরে ডা. বদরুন নাহারের নৌকায় ভাসমান যুদ্ধ

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:১৪ পিএম, ২৯ মার্চ ২০২১ সোমবার

ডা. বদরুন নাহার।  ছবি সংগৃহীত।

ডা. বদরুন নাহার। ছবি সংগৃহীত।

ময়মনসিংহের সন্তান ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে গ্রামে গ্রামে ছুটোছুটি করে চিকিৎসা করেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। অস্ত্র চালনা এবং আত্মরক্ষা কৌশলের উপর প্রশিক্ষণও নিয়েছে যুদ্ধের শুরুতেই। কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ১১টি অঞ্চলে নৌকায় করে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে৷ যোদ্ধাদের জন্য কাজ করতে গিয়ে পড়েছেন নানা বিপদে। কিন্তু পিছ পা হননি কোনো অবস্থাতেই। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে কাজ করে গেছেন শক্তহাতে। আজও দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন বিনামূল্যে।
১৯৫০ সালের ১৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ বাবা সৈয়দ দরবেশ আলী এবং মা সৈয়দা হোসনে আরা বেগম৷ ১৯৬৯ সালে ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে পড়ার সময় সমমনা রাজনৈতিক আদর্শের অন্যতম নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র তোফাজ্জল হায়দার নসু চৌধুরীর সাথে বিয়ে হয় তার। স্বামী-স্ত্রী দু'জনই দেশের মুক্তিযুদ্ধে একাত্ম ছিলেন৷
১৯৭১ সালে এমবিবিএস শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলেন বদরুন নাহার৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই দেশপ্রেমী নারী৷ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নি এবং তার স্বামী ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে চাঁদপুরে চলে যান৷ চাঁদপুরে পৌঁছেই সেখানে প্রথম গঠিত স্থানীয় সরকারে যোগ দেন তারা৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১২০৪ সাব-সেক্টরের অধীনে জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বাধীন মধুমতী কোম্পানিতে মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন ডা. বদরুন নাহার৷ ওই অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এটিএম হায়দার৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ওলিপুর গ্রামের প্রশিক্ষণ শিবিরে অস্ত্র চালনা এবং আত্মরক্ষা কৌশলের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বদরুন নাহার৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো নয় মাস তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে বাইরে ছিলেন৷ এসময় তিনি অধিকাংশ সময় নৌকায় করে সাথী যোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা করেছেন৷
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করে বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ১১টি অঞ্চলে আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করেছেন বীর সাহসী নারী ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ ফলে এই ভয়াবহ সংকটের দিনে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন তাকে৷ সেসব ঘটনার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, সেদিন ছিল ২৯ সেপ্টেম্বর৷ আশ্বিন মাসের শেষ দিন৷ হাজীগঞ্জের অফিস চিতোষী এলাকায় একটি স্কুলে পাকসেনাদের ঘাঁটি ছিল৷ আমি অনেকটা  দূরে নৌকায় ছিলাম৷ আমার কাছে কমান্ডার জহিরুল হক পাঠান খবর পাঠালেন, ওই স্কুলে পাকসেনারা বেশ কিছু নারীকে আটকে রেখেছে এবং তাদের উপরে পাশবিক নির্যাতন করেছে৷ খবর পেয়ে আমি রওয়ানা দিলাম৷ মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যে পাকবাহিনীর ওই ঘাঁটি আক্রমণ করে৷ দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়৷ কিছু লাশ এবং কিছু মেয়ে সেখানে রয়ে যায়। আমি মনে করি, নয় মাসের যুদ্ধের অনেক ঘটনার মধ্যে এটিই ছিল কাছে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক৷ আমি সেই স্কুলের ভেতরে গিয়ে দেখি ১২ থেকে ১৩ জন আতঙ্কিত মেয়ে সেখানে রয়েছে৷ পাকসেনাদের পাশবিক অত্যাচারের প্রতিটি চিহ্ন তাদের গায়ে৷ তারা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় সেখানে ছিল৷ সেই স্মৃতি এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। তাদের কথা স্মরণ করলে এখনও আমি কান্না ধরে রাখতে পারি না৷ এ অবস্থায় আমার এবং আমাদের সাথিদের কাপড়-চোপড় তাদের দেই। আশেপাশের মানুষদের সহায়তায়ও কিছু কাপড় পাই আমরা। এ সব কাপড় দিয়ে মেয়েগুলোকে জড়িয়ে ফেলি৷ এরপর তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেই৷ পরে আমি যে নৌকায় থাকতাম এবং বিভিন্ন জায়গায় যেতাম, সেই নৌকায় করে তাদের নিয়ে আসি৷ সেসময় আমার কাছেও খুব বেশি ওষুধ-পত্র ছিল না৷ তবু সেসব দিয়েই তাদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলি৷ পরে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাদের পৌঁছে দেই৷ আমার কাছে এখনও মনে হয়, আমার চিকিৎসা জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন, আমি সেই নির্যাতিত মেয়েদের চিকিৎসা সেবা দিতে পেরেছি৷
যুদ্ধে উত্তার সারা বাংলাদেশ। জায়গায় জায়গায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলছে। গোলা-বারুদ আর বোমায় আওয়াজে প্রলঙ্করিকাণ্ড ঘটছে সারা দেশজুড়ে। এ অবস্থায় রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ খুব কঠিন ছিলো সেই পথচলা। জীকনের ঝুঁকি নিয়ে দিনে পর দিন তিনি ছুটে চলেছেন গ্রামের পর গ্রামে। একাধিকবার তার নৌকা পাকসেনারা আটকও করে৷ তবু নানা কৌশলে তিনি রক্ষা পান পাকহানাদারদের হাত থেকে৷
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফরিদগঞ্জ এলাকায় আমাদের ক্যাম্পের একটি ছেলে সম্মুখ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়৷ তার নাম ফারুক৷ আমার কাছে তখন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না৷ তবুও আমি তার শরীরের গুলি বের করতে সক্ষম হই৷ কিন্তু তার যে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তা কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারিনি৷ এমনকি তাকে তখন অন্য কোথাও চিকিৎসার জন্য পাঠানোরও কোনো উপায় ছিল না৷ ফলে আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি৷ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে আমার সামনে মারা যায়৷
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরসহ কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে নৌকায় করে ঘুরে ঘুরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন ডা. বদরুন নাহার৷ কিন্তু যুদ্ধের সময় কোনো এলাকাতেই বেশি দিন অবস্থান করতে পারতেন না৷ কোনো বাড়িতে দুয়েকদিন থাকলেই সে এলাকায় খবর হয়ে যেত, এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা এসেছে৷ সে কারণে খুব ঘন ঘন জায়গা বদল করতে হতো৷ এছাড়া দিনের বেলায় চলাফেরা করলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল৷ তাই রাতের আঁধারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন তিনি৷ তবুও একাধিকবার পাকসেনাদের কবলে পড়েছেন এই সাহসী নারী৷
এমন বিপদজনক মুহূর্তে কীভাবে পাকসেনাদের কবল থেকে উদ্ধার পেয়েছেন সেসব ঘটনা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় বড় একটা সেতু আছে৷ ওই সেতুর নিচ দিয়ে যখন আমার নৌকা যাচ্ছিল, তখন পাকসেনারা আমাকে থামায়৷ কিন্তু যুদ্ধের সময় থেকে আমি আমার স্বাভাবিক কাপড়-চোপড় না পরে বরং বোরকা পরে ছদ্মবেশে থাকতাম৷ ওরা আমার নৌকা আটকায়৷ আটকিয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করে৷ তখন মাঝি কোনো একটা জায়গার নাম বলে, উনাকে সেখানে রাখতে যাচ্ছি৷ আমার দুয়েকটা কথাবার্তাতেও তারা আমাকে আর সন্দেহ করেনি৷ ফলে সে দফা ছেড়ে দেয়৷ আরেকবার অনেক রাত্রে আমি নৌকায় করে যাচ্ছি৷ পাকসেনারা আমার নৌকা আটকায়৷ তখন আমার মাঝি আমাকে বললেন, খালাম্মা, আপনি পানিতে নেমে যান৷ আমি তো প্রথমে খুব আঁৎকে উঠলাম তার কথা শুনে৷ কিন্তু উপায় নেই দেখে শেষ পর্যন্ত পানিতে নেমে পড়ি৷ নৌকার পেছন দিক ধরে পানিতে আস্তে করে ভাসতে থাকি৷ পাকসেনারা নৌকাটা ভালোভাবে দেখল, কেউ নেই৷ মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, তিনি খালি নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন৷ তখন ওরা নৌকাটা ছেড়ে দিল৷ আমি যখন নৌকা ধরে পানিতে ছিলাম তখন আমার মনে হলো পাশ দিয়ে কী যেন ভেসে যাচ্ছে৷ সেই মুহূর্তে জীবনের ভয় তো সবারই হবে৷ তারপর সৈন্যরা যখন চলে গেছে তখন আমি দেখলাম, আমার পাশ দিয়ে দুই তিনটা মৃতদেহ ভেসে গেছে৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এমবিবিএস পরীক্ষা সম্পন্ন করেন বদরুন নাহার৷ এরপর চিকিৎসক হিসেবে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন৷ চাকুরির এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান ডা. বদরুন নাহার৷ সেই পদে থেকেই ২০০৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি৷ তবে চাকুরি থেকে অবসর নিলেও এখনও সেই মহান পেশায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন৷ পাশাপাশি সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন এই বীর নারী৷ এছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন৷
স্বাধীনতা যুদ্ধে ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকার জন্য ২০১২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে তার হাতেও স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দেন৷
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি৷ এখন এই স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং দেশকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব তাদের৷ বাংলাদেশ যেন গোটা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সেজন্য আমরা যেমন দায়িত্বশীল হবো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও তেমনি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে এটিই আমার বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা৷