ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১২:৩০:১৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতীরা রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে আজ বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া

জয় পেনসেলভেনিয়া, জয় ফিলাডেলফিয়া!

মনিজা রহমান | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:৩০ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০২০ শনিবার

লিবার্টি বেল, আমেরিকার স্বাধীনতার প্রতীক।  বহু বছর ধরে এ বেল বাজানো হয়না।

লিবার্টি বেল, আমেরিকার স্বাধীনতার প্রতীক। বহু বছর ধরে এ বেল বাজানো হয়না।

সারা পৃথিবীর চোখ এখন পেনসেলভেনিয়াতে।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে উচ্চারিত হয় যে শহরটির নাম, তার নাম ফিলাডেলফিয়া, যেটি পেনসেলভেনিয়ার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। ফিলাডেলফিয়ায় আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করা হয়। এখানেই রচিত আমেরিকার সংবিধান। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফিলাডেলফিয়া ছিল আমেরিকার রাজধানী।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রথম কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শহরটির নাম। এবার এই রাজ্যটি আমেরিকার উত্তেজনাপূর্ণ ও হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী লড়াইয়ে রেখেছে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা। পেনসেলভেনিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় ভোট গণনায় শুরুতে এগিয়ে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তখন বাকী ছিল ফিলাডেলফিয়া। আমেরিকার স্বাধীনতার শহরটি বরাবর ডেমোক্রেটদের ঘাটি। আর এখান থেকেই উড়তে শুরু হয়েছে জো বাইডেনের জয়ের নিশান।

সম্প্রতি গিয়েছিলাম আমেরিকার এই স্বাধীনতার শহর ফিলাডেলফিয়ায়, সংক্ষেপে ফিলি বলে ডাকে এই শহরের মানুষেরা। প্রাচীন গ্রীসের অনুকরণে শহরটির সৃষ্টি। গ্রীক ভাষায় ফিলোস মানে প্রিয় আর এ্যাডেলফস মানে ভ্রাতা বা ভ্রাতাতুল্য। এই শহরকে ‘সিটি অব ব্রাদারলি লাভ’ ও ‘দি এথেন্স অব আমেরিকা’ও বলা হয়।

সম্প্রতি ফিলাডেলফিয়া সফরে আমরা গিয়েছিলাম- ইন্ডিপেন্ডেন্স ন্যাশনাল হিস্টোরিকাল পার্ক, লিবার্টি বেল সেন্টার, ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অব আর্ট, জন এফ কেনেডি প্লাজা সংক্ষেপে লাভ প্লাজা, ডিলওয়ার্থ পার্ক, ইটালিয়ান মার্কেট ও এম্বেসি এলাকায়। শিল্প, সংস্কৃতি, কুইজিন, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের নানা চিহ্ন পুরো শহরে ছড়িয়ে আছে। যে কারণে প্রতি বছর এখানে অন্যান্য স্টেট থেকে বহু পর্যটক আসে। যেটা শহরের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে।

আমেরিকায় বহু প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শহরটির নাম। কি কি শুনবেন- প্রথম লাইব্রেরী (১৭৩১), প্রথম হাসপাতাল (১৭৫১), প্রথম মেডিকেল স্কুল (১৭৬৫), প্রথম ন্যাশনাল ক্যাপিটাল (১৭৭৪), প্রথম স্টক একচেঞ্জ (১৭৯০), প্রথম চিড়িয়াখানা(১৮৭৪), প্রথম বিজনেস স্কুল (১৮৮১) পুরো আমেরিকার মধ্যে প্রথম এই শহরে স্থাপিত হয়েছিল। ফিলাডেলফিয়ায় ৬৭টি ‘ন্যাশনাল হিস্টোরিক্যাল ল্যান্ডমার্কস’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট অব ইন্ডিপেন্ডেন্স হল’ আছে। ২০১৫ সালে এই শহর ‘অর্গানাইজেশন অব ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার’ এর সদস্য হয়। আমেরিকার প্রথম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটি’ এটি।

আমেরিকার অন্যান্য বিখ্যাত শহরের মতো এখানেও বসতি ছিল শুরুতে আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের। ইউরোপিয়ানরা আসার আগে ফিলাডেলফিয়ায় লেনোপো ইন্ডিয়ানদের এলাকা ছিল। তারা শাকাম্যাক্সন নামে একটি এলাকায় বাস করতো। তারা ছিল ‘নেটিভ ইন্ডিয়ান ট্রাইব’ ও প্রথম ‘ন্যাশন্স ব্যান্ড গর্ভনমেন্ট’। তাদেরকে ডেলওয়ার ইন্ডিয়ানও বলা হত। ঐতিহাসিকভাবে তারা সংযুক্ত ছিল ডেলওয়ার রিভার ওয়াটারশেড, ওয়েস্টার্ণ লং আইল্যান্ড ও লোয়ার হাডসন ভ্যালির সঙ্গে। কিন্তু লেনোপোরা এক সময় ডেলওয়ার হোমল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হতে শুরু করে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিকরা যখন পুরো আমেরিকায় ছড়িযে পড়তে শুরু করার পরে এটা ঘটে। তদুপুরি লেনোপো ইন্ডিয়ানদের নিজেদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গাও ছিল। রোগ ও মহামারীও ছিল। বিশেষ করে গুটি বসন্তে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে বহুবার। ইরোকুইস নামে আরেকটি রেড ইন্ডিয়ানদের দল প্রায়ই লড়াই করতো লেনোপোর সঙ্গে। লড়াই করে বেঁচে যাওয়া লেনোপেরা ক্রমে আপার ওহাইও রিভার বেসিনের দিকে চলে যায়।

আমেরিকার রেভ্যুলেশনারি ওয়ার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার সময়কাল তাদের আরো পশ্চিমে সরিয়ে দেয়। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পূর্বাঞ্চলে আরো যারা লেনোপোরা তখনও বাস করতো তাদের ইন্ডিয়ান টেরিটোরিতে (বর্তমান ওকলাহোমা) পাঠিয়ে দেয়। ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ‘ইন্ডিয়ান রিমুভাল’ নীতি গ্রহণ করেছিল। একুশ শতকের এসে এখন বেশী লেনাপোর বাস ওকলাহোমা স্টেটে। এর বাইরে উইসকনসিন ও কানাডার অন্টারিওতে আছে অনেকে।

সতেরশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপিয়ানরা ডেলওয়্যার ভ্যালিতে আসতে আরম্ভ করে। প্রথম বসতি স্থাপন করতে দেখা যায় ডাচদের। তারা ১৬২৩ সালে সুইকিল নদীর অপরদিকে ডেলওয়্যার রিভারের ওপর ‘ফোর্ট নাসাউ’ নির্মাণ করে। এই জায়গাটি বর্তমানে নিউজার্সির বুকলনের অন্তর্ভূক্ত। ডাচরা পুরো ডেলওয়্যার ভ্যালিকে ’নিউ নেদারল্যান্ড কলোনী’ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে।

১৬৩৮ সালে সুইডিশরা এসে ফোর্ট ক্রিস্টিনা স্থাপন করে দ্রুত ভ্যালিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ফিনল্যান্ডও আসে এরপর। ১৬৫৫ সালে নিউ নেদারল্যান্ড ডিরেক্টর জেনারেল পিটার স্টাইভ্যাসেন্ট ফিনিশিওদের পরাজিত করে ১৬৬৪ সালে ইংলিশদের কাছে পরাস্ত হয়।

১৬৮১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস উইলিয়াম পেনকে ফিলাডেলফিয়াকে কলোনী করার অনুমতি দেন। এরপর পেন স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান লেনোপোদের কাছ থেকে ভালো দাম দিয়ে জমি কেনেন। তিনি এলাকাতে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করেন। শাকাম্যাক্সন গাছের নীচে পেন একটি বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ হন লেনোপো প্রধান তামানির সঙ্গে। প্রাচীন গ্রীক শব্দ থেকে শহরটির নাম দেন- ফিলাডেলফিয়া মানে গ্রীক ভাষায় ব্রাদারলি লাভ।

গীর্জার একজন কোয়েকার হিসেবে পেন সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। যে কারণে আমেরিকার অন্যান্য কলোনীর তুলনায় ফিলাডেলফিয়া দ্রুত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও একইসঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ্য শহর হয়ে ওঠে। পাশাপাশি রেলরোড, খাল, নদীপথ, রাস্তাঘাট গড়ে ওঠায় ফিলাডেলফিয়া হয়ে যায় আমেরিকার শিল্পাঞ্চলের কেন্দ্র।

ফিলাডেলফিয়ার গুরুত্ব ও অবস্থানগত তাৎপর্য্য শহরটিকে স্বাভাবিকভাবে আমেরিকার ‘বিপ্লব’ এর কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করে। ১৭৫০ সালের পরে বোস্টনকে ছাড়িয়ে ব্রিটিশ আমেরিকার সবচেয়ে ব্যস্ততম বন্দর হয়ে ওঠে ফিলি। ব্রিটিশ সম্রাটদের শহর লন্ডনের পরেই ছিল তাদের অবস্থান। এই শহরটি ১৭৭৪ সালে প্রথম ‘কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস’ হয়। লিবার্টি বেল কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে সেই আলোচনা ছিল কংগ্রেসে।

লিবার্টি বেল আমেরিকার স্বাধীনতার প্রতীক। কারণ যুদ্ধের সময় এটা বাজিয়ে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের সমবেত করা হত। ১৭৭৫-৭৬ সালে দ্বিতীয় ‘কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস’ও এই শহরে অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ কংগ্রেসে ‘ইউনাইটেড স্টেটস ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স’ এ স্বাক্ষর করা হয়। তখন যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধের পরে ১৭৮৭ সালে ‘কন্সিটিটিউশনাল কনভেনশন’ হয় এখানে।

ফিলাডেলফিয়া আমেরিকার ও পেনসেলভেনিয়া স্টেটের প্রথম রাজধানী ছিল। কিন্তু পরে দুটোই স্থানান্তরিত হয়। ওয়াশিংটন হয় আমেরিকার রাজধানী আর হ্যারিসবার্গ পেনসেলভেনিয়ার। তবে আঠারোশ শতকে আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল শহরটি। ক্রীতদাসপ্রথার অবসানের পরে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের প্রথম কোন সংগঠন ছিল- আফ্রিকান মেথোডিস্ট এপিসকোমাল চার্চ। যেটা এই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখনও এই শহরে কৃ্ষ্ণাঙ্গরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

ফিলাডেলপিয়া শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণের নাম- লিবার্টি বেল, যাকে আমেরিকার স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বাধীনতার প্রতীক মনে করা হয়। শহরটি পরিভ্রমনে আমি গিয়েছিলাম ইন্ডিপেন্ডেন্স ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত লিবার্টি বেল সেন্টারে। তবে মজার ব্যাপার হল, ক্র্যাক পড়ে যাওয়ায় বেল বা ঘন্টাটি দীর্ঘদিন বাজানো হয় না। কিন্তু আবার সারানো হয়না, যদি ঘন্টাটির অবস্থা আরো খারাপ হয়।

লন্ডনের এক কারখানা থেকে যখন এটি বানিয়ে আনা হয়েছিল সেই ১৭৫২ সালে, তখনই এর ওপর ক্রাক সৃষ্টি হয়। স্থানীয় দুই মিস্ত্রি জন পাস ও জন স্টো এটিকে ঠিক করেছিলেন, যাদের নাম এখনও ঘন্টার ওপর আছে। বাইবেলের বাণী উদ্ধৃত আছে ঘন্টার ওপর। এটি শুধু স্বাধীনতার নয়, দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনেরও প্রতীক।

আমেরিকার সংবিধান স্বাক্ষর এবং বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জর্জ ওয়াশিংটন, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ও থমাস জেফারসনের মৃত্যৃর পরে ঘন্টাটি বাজানো হয়েছিল। তবে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা কালে ঘন্টাটি বাজানো হয়েছে কিনা এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতভেদ আছে। তবে ঐতিহাসিকভাব সত্য যে ১৮৪৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের জন্মবার্ষিকী উদযাপনের জন্য সর্বশেষ এই ঘন্টাটি বাজানো হয়। তারপর থেকে বড় ধরনের ফাটল পাওযা যাওয়ায় ঘন্টাটি বাজানো বন্ধ।

আমেরিকার স্বাধীনতার ইতিহাস শুধু একজনের মাধ্যমে রচিত হয়নি। বরং সম্মিলিত প্রচেষ্ঠার ফল। যে আলোকিত মানুষেরা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তাদের বলা হয় ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’। আমেরিকা বর্তমানে ৫০টি স্টেট নিয়ে গঠিত হলেও, শুরুতে ছিল মোট ১৩টি স্টেট। ফাউন্ডিং ফাদাররা এই স্টেটের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তারা তাদের অঞ্চলের মানুষের আকাঙ্খাকে বুকে ধারণ করেছেন। তারা ছিলেন সুদূরপ্রসারী ভাবনার অধিকারী ও প্রজ্ঞাবান।

আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা হলেন- জন এ্যাডামস, জন ডিকিনসন, উইলিয়াম ফিন্ডলে, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, জন জে, থমাস জেফারসন, রিচার্ড হেনরি লি, জেমস ম্যাডিসন, থমাস পেন, জর্জ ওয়াশিংটন ও জেমস উইলসন। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় তারা ফিলাডেলফিয়াতে ছিলেন।

৬ নভেম্বর, নিউইয়র্ক।

লেখক: মনিজা রহমান, আমেরিকা প্রবাসি লেখক ও সাংবাদিক