ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ৮:৫৯:৫৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে

প্রসঙ্গ ‘ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইল্লা আমারে’

অদিতি ফাল্গুনী | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:৩২ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২১ রবিবার

অদিতি ফাল্গুনী

অদিতি ফাল্গুনী

'ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইল্লা আমারে/আমি অহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে!‘ গানটি অতি অবশ্যই স্কুল পড়ুয়া আমাদের কােন-মাথায় প্রবল ঘা দিয়েছিল। তখন বরিশালে থাকি। ক্লাস সেভেনে পড়ি? ১৯৮১ সালে গানটি প্রথম রচিত হলেও আমাদের কানে আরো কয়েক বছর পর এসে পৌঁছায়। গার্লস স্কুলের ক্লাস রুমে মেয়েরা এই গান গায়। রাস্তায় রিক্সাঅলা থেকে মধ্যবিত্ত যুবক সবাই এই গান গায়। সেসময় চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের সিনেমায় রুচিগত পতনের শুরু। তাঁর ‘গোলাপী এখন ট্রেনে' সত্যজিত রায়ের প্রশংসা কুড়িয়েছিল বলে শোনা যায়। সেই আমজাদ হোসেন মাত্রই ‘ভাত দে' বানানো শুরু করেছেন। এরপর বানাবেন ‘দুই পয়সার আলতা।' 
বিষয়বস্ততে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের প্রতি আস্থা তখনো পরিচালকের আছে, তবে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে'-র মাধুর্য নেই। বড় বেশি চড়া। যাহোক, বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে...ক্লাস টেনে থাকতেই বোধ করি এক বাংলা নববর্ষে শিশু পার্কের সামনে সরাসরি দেখলাম তাঁকে গান গাইতে। ‘নাম তার ছিল জন হেনরী' গেয়েছিলেন। কিন্ত হেনরীর গানটার লিরিকস ত‘ আর ফকির আলমগীরের নিজের না। আজই জানলাম যে ‘ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইলা আমারে‘-র  লিরিকসও তাঁর নয়। এটা সত্যি যে প্রকৃতিদত্ত উদাত্ত গলার এই গায়কের শেষের দিকের অধিকাংশ গানই চেঁচানিতে পর্যবসিত হয়েছিল। 
তরুণ কবি জাহিদ সোহাগের আক্ষেপও সঠিক যে কেন ষাট বা সত্তরের দশকের শিল্পীরা জীবনে সব প্রাপ্তির পরও সুরের সাধনা নিয়ে এগোননি। একই কথা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বলা যায়। আমাদেরই অনেক বন্ধু-বান্ধবী এখন আর লিখছে না। সুর বা শব্দের সাধনা জীবনব্যাপী সংগ্রাম। একজন কবীর সুমনের সব মতের সাথে একমত নাই হতে পারি, কিন্ত হাসপাতাল বেডে, রোগীর পোশাকে, কাঁপতে থাকা হাতে ডিজিটাল তানপুরার সুরে গান গাইছেন...এমন দৃশ্য দেখে তাঁর শত্রুর চোখেও জল আসতে বাধ্য। বাংলাদেশে কেন এমন সাধনা- সুর বা শব্দ কোন ক্ষেত্রেই দানা বেঁধে উঠছে না কে জানে? আমাদের চারপাশ কি আমাদের বড় বেশি জাগতিক স্বচ্ছলতা ও পেশাগত প্রতিষ্ঠার দৌড়ে সামিল হতে বলে? কিন্ত সুর বা শব্দের ধ্যানে অত দৌড়ালে ত‘ হবে না। আর ব্যক্তি ফকির আলমগীর জিয়া বা এরশাদ কার সেবা করেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর সেসব আলোচনা আসলেই খুব অর্থহীন।
তবু...তবু...তবু...হ্যাঁ, ঐ একটি মাত্র গান...‘ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইল্লা আমারে/আমি অহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে‘-তে আপনার উদাত্ত গলা (যদি অন্য কারো লিরিকসও হয়) এক ঝটকায় নদী ভাঙ্গন, ক্রমাগত গ্রাম থেকে শহর বিশেষত: রাজধানীর বুকে ছুটে চলা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত জনতার বিপন্ন বাংলাদেশকে যেভাবে চেনায়...তার কাছে...খুব শ্রদ্ধা নিয়েই বলি...খোদ সুমন-অঞ্জন-নচিকেতাদের গানের পৃথিবী বড় বেশি সুকুমার-পেলব-পারিজাত কুসুম তূল্য। এমনকি অনেকটা সমতূল্য অঞ্জন দত্তের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘কে মাথায় রেখেই বলছি। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘-র নেপালী বা পাহাড়ি ছেলেটি লেপচা বস্তির মেয়েটি তথা প্রেমিকার কানের মাকড়ি বিক্রি করে বড় শহরে আসে। কিভাবে সেই মাকড়ি বেচার সত্তর টাকা ফিরিয়ে দেবে সেটা ভাবে। ভাবে শহুরে বাবু কালিম্পং বেড়াতে গেলে শঙ্কর হোটেলে যে মেয়েটি তার চুল্লী জ্বালাতে আসবে তার কপালে সিঁদুর দেখলে কিছু না বলে শুধু যেন সত্তর টাকা ফিরিয়ে দেয়া হয়! ভারি মিষ্টি গান। দার্জিলিংয়ের পাহাড় থেকে পাইন পাতা সব কিছুই ভেসে ওঠে সেই গানে (আপনি দার্জিলিং হয়তো শুধু সত্যজিত রায়ে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘তেই দেখেছেন)। প্রলেতারিয়েতের গান হলেও অঞ্জনের প্রলেতারিয়েত ভারি ‘পোলিশড।‘ কিন্ত সখিনার গানে অত সফিস্টিকেশন নেই। সেটা রিক্সা-বস্তি-বন্যা-হকার গিজগিজ ফুটপাথ-এঁদো পুকুরের কচুরিপানার বাংলাদেশ। 'লক্ষ মশার উৎপাতে রাত কাটে না ফুটপাতে'-র বাংলাদেশ। ফকির আলমগীরের ঐ একটি গান যেন মুক্তিযুদ্ধের পর সত্তর-আশির বিপন্ন অথচ বাড়তে থাকা বাংলাদেশ-তার ক্রমাগত বন্যা, মুক্তিযুদ্ধের পর যে ধ্বংসস্তপ ভরা দেশকে বিদেশী পত্রিকায় বলা হয়েছিল ‘দ্য আইরিশ অফ এশিয়া‘- ঘন ঘন সামরিক অভ্যুত্থান, বন্যা ও মাত্রই খুলতে থাকা পোশাক কারখানার বাংলাদেশ...আজ যে বাংলাদেশে একদিকে বিপুল প্রবৃদ্ধি আর একদিকে জুস কারখানায় ৫২টি লাশ। ইসশ্- ফকির আলমগীর- সখিনার সিক্যুয়েলটা আপনি কেন লিখে-সুর করে-গেয়ে গেলেন না? যে সখিনা তার রিক্সাচালক প্রেমিককে খুঁজতেই হয়তো ঢাকায় এসে পোশাক কারখানায় আগুন লেগে বা ছাদ ভেঙ্গে মৃতা? আমাদের চারপাশে জীবনমুখী গান যারা লেখেন বা সুর বাঁধেন- তারা কেউ লিখুন না ‘সখিনা‘র গানের একটা সিক্যুয়েল? প্লিজ? 
এছাড়াও সহজিয়া বাউলিয়ানার সুরে ও কথায় গাওয়া তাঁর অমিত আবেগী গান ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম/কাটিয়া গায়ের চাম/পাপোষ বানাইলেও শোধ হবে না‘...অস্বীকার করব না সুর ও শিল্পীর দরাজ গলার কারণে ভাল লাগলেও বহু বহু দিন গানটির প্রথম লাইন আমার ব্রাম্ম ঘেঁষা মনকে লজ্জায় নুইয়ে দিত। আমার খুব অস্বস্তি হতো গানটি শুনতে। এখন বুঝি গানটি আসলে খুবই ভাল গান। ‘জন হেনরী‘র গানটি বা ‘ওরা আমাদের গাইতে দেয় না‘ তাঁর নিজের না হলেও গাইতেন তিনি দরাজ গলাতেই। নেলসন ম্যান্ডেলাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর লেখা, সুর করা ও গাওয়া ‘শুভ হোক তোমার জন্মদিন‘ আমাদের প্রাণ কেড়েছিল। 
আর হ্যাঁ- সখিনার ঐ একটি গানের জন্যই আমাদের প্রজন্মের সবার কাছে আপনার যা কিছু ভুল বা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও, আপনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অদিতি ফাল্গুনী: লেখক ও গবেষক