ঢাকা, শনিবার ২৭, এপ্রিল ২০২৪ ৬:১৬:৩৫ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি ছাড়াবে আগামী সপ্তাহে থাইল্যান্ডের গভর্নমেন্ট হাউসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী চলতি মাসে তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই গাজীপুরে ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ

বীর মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জলিরা ৫ ভাই-বোনই সশস্ত্র যোদ্ধা

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৭:৩৮ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২১ রবিবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

১৯৭১ সাল; ঝালকাঠির কীর্তিপাশা গ্রাম। অঞ্জলি রায় গুপ্তারা ৫ ভাইবোন বয়সে কেউ তরুণ, কেউ বা কিশোরী। যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে গেছে সারা দেশ। সে আগুনের লেলিহান শিখা এসে হামলে পড়েছে কীর্তিপাশা গ্রামেও। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়ি। কি করবে অঞ্জলিরা! বাবা বললেন, জীবন যখন দিতেই হবে, একটা পাকসেনাকে হলেও হত্যা করে তারপর মরো।

যেই কথা, সেই কাজ। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বাবার কথামত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ৫ ভাই-বোন। মুক্তিযুদ্ধ চাঁকালে নয় নম্বর সেক্টরের আওতায় ঝালকাঠির বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ পাক সেনাদের দেওয়া আগুনে দগ্ধ নিজেদের বাড়ির ছাই হাতে নিয়ে যুদ্ধজয়ের শপথ করেছিলেন অঞ্জলি এবং তার চার ভাই-বোন৷

ঝালকাঠির কীর্তিপাশা গ্রামে ১৯৪৫ সালের ৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ তার বাবার নাম সুশীল কুমার রায় এবং মায়ের নাম শোভা রাণী রায়৷ ১৯৬১ সালে কীর্তিপাশা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন৷ এরপর বরিশালের চাখারে ফজলুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন তিনি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন অঞ্জলি রায়৷

১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ঝালকাঠির শিরযুগ আজিমুন্নেছা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি৷ বিভিন্ন এলাকার মুক্তিকামী মানুষ কীর্তিপাশা স্কুলমাঠে আসত যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে৷ একাত্তরের ২৫ মার্চের পর প্রশিক্ষণ আরো জোরদার হয়৷ প্রশিক্ষণ শিবিরের পাশেই তাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হতো৷ এ কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রশিক্ষণ দিতে ও নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷

মুক্তিযুদ্ধে নিজের অংশগ্রহণের কথা বলতে গিয়ে অঞ্জলি রায় গুপ্তা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ তাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে৷ রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট শেষে জ্বালিয়ে দেয়৷ বাবা-মা, ভাইবোনদের নিয়ে বাড়ির পাশের একটি জঙ্গলে আশ্রয় নেন তিনি৷ তাদের লক্ষ্য করে জঙ্গলেই গুলি চালানো হয়৷ তারা জঙ্গলের ভেতর গর্ত করে তাতে লুকিয়ে থাকেন৷ একসময় গুলি থেমে গেলে গর্ত থেকে বেরিয়ে দেখেন, পুরো জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ ওদিকে আগুনে তাদের বিশাল বাড়ি পুড়ে ছাই৷ সেই ছাই ছুঁয়ে তারা পাঁচ ভাইবোন শপথ করেন দেশ শত্রুমুক্ত করার৷ এ সময় তাদের বাবা  বলেছিলেন, ‘মরতে যখন হবেই, একটা পাকিস্তানি সেনা মেরে তারপর মরো'৷

নিজেদের বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বিলের মধ্যে পেয়ারাবাগানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন তারা৷ ভাই শ্যামল রায় আর চার বোন অঞ্জলি, সন্ধ্যা, মণিকা ও সুদীপ্তা সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে পেয়ারাবাগানে যুদ্ধে অংশ নেন৷ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ঝালকাঠি-স্বরূপকাঠির সীমান্তবর্তী পেয়ারাবাগানে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন তারা৷ সেখানে পাক সেনাদের সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়৷ পাক সেনারা হেরে গিয়ে আলবদর, আলশামস আর রাজাকারের সহযোগিতায় পুরো পেয়ারাবাগান পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়৷ ফলে পেয়ারাবাগান ছেড়ে যেতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের৷

জুন মাসের শেষ দিকে নৌকায় করে পুলিশ আর শত্রুবাহিনী ঝালকাঠি থেকে নবগ্রাম ইউনিয়নে যাতায়াত করছিল৷ একই সঙ্গে তারা নবগ্রাম ও বিনয়কাঠি ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালায়৷ অঞ্জলি এবং তার সহযোদ্ধারা শত্রুর বোটে আক্রমণ চালান৷

এই ঘটনা সম্পর্কে অঞ্জলি রায় বলেন, ‘আমরা ককটেল ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে পাক সেনাদের নৌকায় হামলা চালিয়েছি৷ এসময় তাদের কয়েকজন নিহত হয়৷'

যুদ্ধচলাকালে একদিনের বিপদজনক পরিস্থিতির কথা জানান অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ তিনি বলেন, ‘আমরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ আর ঠিক সেসময় পাক সেনারাও রাস্তায় উঠে গেছে৷ আমি যাচ্ছিলাম পূর্বদিকে৷ কিন্তু দেখি সামনে, পেছনে এবং ডান দিক থেকেও পাক সেনারা আসছে৷ আর বামদিকে ছিল নদী৷ মানে আমাকে ধরার জন্য তারা এভাবে  ঘেরাও করেছে৷ আমি যে কীভাবে পালাবো তার কোন বুদ্ধিই পাচ্ছিলাম না৷ এমন সময় আমাদের দলের মধ্যে একজন আমাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললো, আপনি সরে পড়ুন৷ তার কথা শুনে আমি নদীতে ঝাঁপ দিলাম। তারপর দ্রুত সাঁতার কেটে ওপারে চলে গেলাম৷ কিন্তু দূ:খের বিষয় আমার পেছনে থাকা আমারেই দুই সহযোদ্ধা  ধরা পড়ে যান পাক সেনাদের হাতে৷'

দেশ স্বাধীন হয়৷ কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে অঞ্জলির মুক্তিযোদ্ধা ছোট দুই বোনের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি৷ তারা চলে যান ভারতে৷ এমনকি তারা ক্ষোভ ও অভিমানে মুক্তিযুদ্ধের সনদ পর্যন্ত নিতে আসেনি বলে জানান অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ পাঁচ ভাইবোন সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও সনদ পেয়েছেন মাত্র দু'জন৷

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও কর্মস্থলে যোগ দেন অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব অঞ্জলি সেই বিদ্যালয়টিকে পরবর্তীতে কলেজ পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেন৷ সেই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০০৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি৷

সূত্র : ডয়চে ভেলে