ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৯:৫৩:১১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতীরা রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে আজ বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া

মুক্তিযোদ্ধা দুই বোন অনু আর মনুর গল্প

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৫৮ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারা বেগম।  ফাইল ছবি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারা বেগম। ফাইল ছবি।

দেশকে বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন পটুয়াখালীর বীর সাহসী দুই বোন আনোয়ারা বেগম এবং মনোয়ারা বেগম৷ সশস্ত্র যুদ্ধে পাকবাহিনীর সদস্যদের পরাস্ত করেছেন তারা। বড় ভাই আবদুর রশিদসহ দুই বোন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ায় পাকসেনারা তাদের মাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু তার পরও পিছু হঠেননি এই বীর দুই মুক্তিযোদ্ধা বোন।

বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হল শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রভোস্টের দায়িত্বেও রয়েছেন।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষুধা, দুর্বলতা- এমন কোনো কিছু আমাদের মধ্যে কাজ করেনি। আমাদের ভাবনায় ছিল- যে কোনোভাবে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করতে হবে। আমরা বুঝতাম স্বাধীন হলেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে আসতে পারবেন। না হলে পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করবে। এমনকি তারা আমার মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন-সে চিন্তাও তখন আমাদের মাথায় ছিল না। দেশ স্বাধীন করতে হবে-এটাই ছিল লক্ষ্য।

১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর কালিকাপুর গ্রামে জন্ম ড. এস এম আনোয়ারা বেগমের৷ ঠিক তার এক বছর আগে জন্ম বড় বোন মনোয়ারা বেগমের। তাদের বাবার নাম শরীফ হোসেন সরদার এবং মা সোনা বানু৷ পাঁচ বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে ভাইটি সবার বড়৷ পারিবারিকভাবেই রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তারা৷ বড় ভাই সরদার আবদুর রশীদ তখন পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷ বড় ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন দুই বোন আনোয়ারা এবং মনোয়ারা৷ পাড়ার লোকেরা তাদের অনু আর মনু নামে ডাকত৷

মুক্তিযুদ্ধের আগের দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আন্দোলন সংগ্রামে নিজেদের সক্রিয় কর্মকাণ্ডের কথা জানালেন ড. এস এম আনোয়ারা বেগম৷

তিনি বলেন, ‘আমার বড় ভাইয়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি আমাদের মনে নাড়া দেয়৷ দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগে মনে৷ তখন ভাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি রাজনীতিতে৷ ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন ছিল রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি৷ এলাকার সবার মুখে মুখে তখন আমাদের দুই বোনের নাম৷ আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নেওয়ার কারণে আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি আসে৷ তবু থেমে থাকিনি৷ বড় ভাইকে প্রায়ই কারাগারে যেতে হতো৷ আইয়ুব খানের মার্শাল কোর্টে তাকে সাজাও দেওয়া হয়৷ ১৯৬৮ থেকেই আন্দোলন সংগ্রামে মেতে ছিলাম আমরা৷ মিছিলে মিছিলে যখন প্রকম্পিত হতো রাজপথ৷ আমরা তখন মিছিলের সামনে অবস্থান করে স্লোগান দিতাম৷'

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জন্য এলাকায় মানুষের কাছে গিয়ে সাহায্য চান তারা। সাধ্য অনুযায়ী বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা পাঠান তারা৷ ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পর নির্বাচনের আগে দক্ষিণাঞ্চলের অবস্থা দেখতে যান৷ বঙ্গবন্ধু সরদার আব্দুর রশীদ এবং তার দুই বোনের আন্দোলন সংগ্রামের কথা জানতে পেরে তাদের বাসায় যান এবং দুই বোনের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন৷

১৯৭১ সালে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের ছাত্রী আনোয়ারা এবং মনোয়ারা৷ ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এলাকার তরুণদের সাথে নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন তারা৷ এলাকায় বেশ কিছু বাংকার তৈরি করেন৷ তিন ভাইবোন পটুয়াখালী জুবিলী কলেজের মাঠে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ২৬ মার্চ থেকে প্রায় এক মাস অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন৷ এ খবর পাকিস্তানি হানাদার ও শান্তি বাহিনীর লোকদের কাছে পৌঁছায়৷ তারা এই দুই বোনকে ধরতে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে৷

একাত্তরের ১১ এপ্রিল পটুয়াখালী আক্রমণ করে পাকবাহিনী৷ পাকিস্তানী মেজর নাদের পারভেজ নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে৷ মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়৷ মাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অনু ও মনু৷

এক আত্মীয়ের বাসায় মাকে রেখে ওই রাতেই তারা অন্যত্র চলে যান৷ সে রাতেই হানাদার বাহিনী তাদের মাকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে প্রথমে গলাচিপা থানা এবং পরে পটুয়াখালী সদর থানায় চালান করা হয়৷ তখন এলাকায় ঘোষণা করা হয় অনু ও মনুকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা ও ৩০ ভরি স্বর্ণ পুরস্কার দেওয়া হবে৷

এই পরিস্থিতিতে এই দুই বোনকে আশ্রয় দিতে অনেকেই আপত্তি জানায়৷ তবে নিশানবাড়িয়ার সফিউদ্দিন বিশ্বাস নামের একজন পীর তার মুরিদদের নির্দেশ দেন তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য৷ তারাও আশ্রয় দিতে ভয় পাচ্ছিল৷ একদিন তারা এই দুই বোনকে আগুনমুখা নদীর তীরে একটি গভীর জঙ্গলে রেখে আসে৷ সেখানে তিন দিন না খেয়ে অবস্থান করেন তারা৷

তাদের খুঁজতে খুঁজতে ওই জঙ্গলেও হানাদার বাহিনী এবং রাজাকাররা গিয়ে হাজির হয়৷ একদিন প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন তারা৷ পীরের মুরিদ হেলাল নামের এক যুবক জানত তারা কোথায় লুকিয়ে আছে৷ হেলালকে সঙ্গে নিয়ে পাকসেনারা জঙ্গলের ভেতর যায়৷ খুঁজতে খুঁজতে তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গায় এসে পড়ে৷ হেলাল তখন ওখানে বিষধর সাপ আছে বলে পাকসেনাদের মিথ্যে বোঝায়৷ হেলালের কথা পাকসেনারা বিশ্বাস করে ফিরে যায়৷ পরে পীরের লোকজন ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন সাব সেক্টরের প্রধান মেজর জিয়াউদ্দিনের কাছে তাদের বিপদের খবর পৌঁছে দেয়৷ অস্ত্রশস্ত্রসহ তিনটি বোটে করে একদিন রাত ২টার দিকে মেজর জিয়াউদ্দিন একদল মুক্তিযোদ্ধা পাঠান৷ তারা এসে অনু ও মনুকে উদ্ধার করে নিয়ে যান৷

এ সময় দুই বোনের অল্প বয়সের কারণে তাদের যুদ্ধে না যাওয়ার পরামর্শ দেন মেজর জিয়াউদ্দিন৷ কিন্তু তার সেই পরামর্শ তোয়াক্কা না করে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে নিজেদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে দেন তারা৷ দীর্ঘ নয় মাস নানা প্রতিকূল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মাঝে যুদ্ধ করেন আনোয়ারা এবং মনোয়ারা বেগম৷

৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন তারা দু’বোন৷ প্রথমে সৈনিক ইসমাইল মিয়া ও পরে মেজর জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন দুজনে৷ প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল গ্রেনেড নিক্ষেপ, স্টেনগান, স্টেন মেশিন কারবাইন, স্টেন মেশিনগান, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, লাইট মেশিনগান চালনা প্রভৃতি৷ মূলত স্টেন মেশিন কারবাইন বহন করতেন তারা৷

বড় ভাই আরো প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান৷ দুই বোন সুন্দরবনে সেন্ট্রির কাজ, অপারেশনের রেকির কাজ করেন৷ সুন্দরবন, শরণখোলা, রায়েন্দ, নামাজপুর, তুশখালী, কাকছিঁড়া, ডোবাতলা, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধ করেন তারা৷

যুদ্ধের সময়ের একদিনের করুণ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘ সাত মাস সুন্দরবন এলাকায় যুদ্ধ করেছি আমরা৷ সেখানে প্রায় ১১ শ' মুক্তিযোদ্ধা ছিল৷ ঈদের দিন আমাদের কোনো খাবার ছিল না৷ আমরা সারাদিন না খেয়ে ছিলাম৷ এতগুলো মুক্তিযোদ্ধা না খেয়ে থাকবে তা হয় না৷ তুশখালীতে অভিযান চালিয়ে গুদাম থেকে চাল নিয়ে আসি৷ এরপর রান্না করে খাবার খাই সবাই৷'

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একদিন আনোয়ারা বেগমরা জানতে পারেন, বেশ কয়েকজন মেয়েকে ফাতরারচরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে৷ এ তথ্য জানামাত্রই তারা হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর ৩৫ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে৷ রাজাকারদের তিনটি ক্যাম্প দখল করে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ নির্যাতিত মেয়েদের সেখান থেকে উদ্ধার করেন তারা৷

আনোয়ারা বেগমের বড় বোন মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ারা বেগম সম্প্রতি মারা গেছেন৷