ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ২০:০৫:৩৩ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

রাজশাহীর দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরা

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:৩৬ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার

রাজশাহীর দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরা

রাজশাহীর দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরা

একাত্তরে যুদ্ধের দামামা বাজছে সারা দেশজুড়ে। শওকত আরা খাতুন তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী৷ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে সারাক্ষণ বিচরণ করেছেন যুদ্ধের ময়দানে৷ নানা কৌশলে মারণাস্ত্র পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে৷

পদ্মা নদীর পাড়ে হাড়ুপুর গ্রাম৷ শওকত আরার জন্ম এই হাড়ুপুর গ্রামে৷ ১৯৫২ সালের পয়লা জুলাই৷ বাবা আহমেদ হোসেন পণ্ডিত ও মা পরিজান বেগমের ১১ ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শওকত আরা৷

অসহযোগ আন্দোলন থেকে রাজশাহীতে শুরু হয় প্রতিরোধের প্রস্তুতি৷ রাজশাহী পুলিশ লাইন, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ক্যাম্প, আনসার ক্যম্পের স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন৷ স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন রাজশাহী পুলিশ লাইনের স্বাধীনতাকামী বাঙালি সদস্যরা৷

পাশের কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামে একটি নিমগাছের নিচে একদিন দাঁড়িয়ে শওকত আরা দেখেন পাকিস্তানি সৈন্যরা যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে নারী পুরুষদের আলাদা করে লাইনে দাঁড় করাচ্ছে৷ জোর করে নারীদের তুলে নিচ্ছে তাদের গাড়িতে৷ পুরুষদের দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তুলে নির্যাতন করছে৷ এসব দৃশ্য তাকে অস্থির করে তোলে৷ দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু একটা করা প্রয়োজন। যুদ্ধের জন্য নিজেকে তৈরি করতে ছুটে যান নিজ গ্রামে৷ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করেন। খুব দ্রুত শিখে নেনে কিভাবে গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়, রাইফেল চালাতে হয় কেমন করে৷

তারপর ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশরক্ষার কাজে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ নয়মাস অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এই বীর নারী৷ একদিন পাকসেনাদের আসার খবর পেয়ে তার ফুপু বানু তাকে, তার ভাই শাখাওয়াত, আব্দুস সালাম ও অন্য কয়েকজনকে একটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেন। ফুফু দরজায় বসে থাকলেন৷ পাকসেনারা শওকত আরার চাচা গোলাম রব্বানী, আমানুল্লাহ, ড. শহিদুল্লাহ আজিজ, লেনিনকে ধরে লইনে দাঁড় করিয়ে রাখলো। আমিনকে জোর করে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ সর্মথকদের খুঁজতে থাকলো৷

এ সময় ফুপু বানুকে ঘরটি দেখিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা জিজ্ঞেস করলো ‘ভেতরে কে?' উনি সাহসের সাথে উত্তর দিলেন ‘জেনানা' অর্থাৎ নারী৷ পাকিস্তানি সৈন্যরা আর কিছু না বলে সেদিন বিদায় নিল৷ তবে লাইনে দাঁড় করানো মানুষগুলোর ওপর প্রচুর নির্যাতন করে গেলো ৷ ওই দিন বিকেলে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান থেকে তাদের গ্রামের ওপর প্রচন্ড গুলি করা হয়৷

তরুণী শওকত আরা ভাবলেন এভাবে বসে থেকে কাপুরুষের মত প্রাণ দিলে তো চলবে না। যুদ্ধ করে মরতে হবে। তিনি ভাবলেন, যুদ্ধে যেতে হলে গ্রামে বসে থাকলে চলবে না৷ তাই কিছুদিন পর গ্রাম থেকে আবারও রাজশাহী শহরে চলে গেলেন শওকত আরা৷

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি তেমন নেই৷ ক্লাসও তেমন হচ্ছে না৷ এ সুযোগে প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তিনি৷ সুযোগ বুঝে নিয়ে নেন সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং৷

এরপর শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজ  শুরু করেন৷ পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের চোখের সামনে দিয়ে অস্ত্র ভর্তি ট্রাঙ্ক আনা-নেওয়ার কাজ করতেন এই বীর নারী।

এই দুঃসাহসিক কাজ করতে গিয়ে অনেক বড় বড় বিপদের মুখে পড়েছেন। কিন্তু নানা বৃদ্ধি দিয়ে রক্ষা পেয়ে গেছেন আবার।

যুদ্ধচলাকালে একদিন নিজের ফুপাতো বোন হাসমত আরা হাসিকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহী থেকে ট্রেনে চব্বিশনগর যান শওকত আরা। সেই গ্রামের গণি নামে এক লোকের বাড়ি থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করেন। কৌশলে তা পরের দিন রাজশাহী শহরে এনে শেখ পাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা মোনায়েম মঞ্জুরের বাড়িতে পৌঁছে দেন৷

চব্বিশনগর, কাকনহাট থেকে গ্রেনেড, অস্ত্র নিয়ে তা রাজশাহী শহরে আনা-নেওয়া করেছেন নিয়মিত৷ একদিন ৭ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর ৪-এর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নির্দেশ দিলেন রাজশাহী শহরের ঘোড়ামারায় কুঞ্জ মৈত্রীর বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প, বোয়ালিয়া থানার পাশে মোসলেম আলীর বাড়িতে আল বদরদের ক্যাম্প, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুৎ ভবনসহ কয়েকটি স্থানে অপারেশন করতে হবে৷

এই কাজে সহযোগিতার জন্য শওকত আরার সঙ্গে কথা বলেন বুয়েটের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলী৷ কথা মতো তিনি ৭ অক্টোবর বাবর আলীসহ বিশ্বস্ত এক রিকশা চালককে নিয়ে রাজশাহী কোর্টের পশ্চিম দিক থেকে রওনা হন৷ তাদের সঙ্গে ছিলো চব্বিশ ইঞ্চি একটি ট্রাঙ্কে ভরা চারটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন, বিস্ফোরক, এসএমজি, গ্রেনেড, কারবাইন ম্যাগজিন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব যুদ্ধসামগ্রী নিয়ে রাজপথ ধরে এগিয়ে যান সাহসী এই তরুণী।

ঠিক রাজশাহী কোর্টের কাছে রিক্সাটা পৌঁছালে পাকসেনারা তাদের রিক্সা থামিয়ে দেয়। এ সময় সেনারা তাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমরা কোথায় যাও?' বাবর আলী বললেন, ‘সঙ্গে আমার বোন, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে রাখতে যাচ্ছি'৷ এর পরও পথে আরো কয়েকবার পাকসেনা ও গোয়েন্দাদের নজরে পড়তে হয় তাদের৷ তবে শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চকর পথ পাড়ি দিয়ে ট্রাঙ্কটি পৌঁছে দেন শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে অপেক্ষারত লাইব্রেরিয়ান রেজাউল আহমেদ ও পিওন মজিবুর রহমানের কাছে৷ কয়েকদিন পরেই এসব অস্ত্র দিয়ে চালানো হয় বেশ কিছু অপারেশন৷ এভাবে অনেকবার অস্ত্র আনা-নেওয়ার কাজ করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এসব কাজের ফলে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে খবর পৌঁছে যায় শওকত আরার গোপন কর্মতৎপরতার৷ তাকে ধরতে উঠে পড়ে লেগে যায় পাকসেনারা৷ তবে তিনি বেশ কয়েকবার অল্পের জন্য বেঁচে যান পাকসেনাদের হাত থেকে৷

শেষ পর্যন্ত অক্টোবরের শেষ দিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের আঁধারে সীমান্ত পেড়িয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ চলে যান শওকত আরা৷ ভারতে গিয়ে নেমে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা কাজে৷ পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে অস্ত্র সংগ্রহ করেন৷ সেসব অস্ত্র পাঠান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে৷ লিফলেট বিলিসহ নানাভাবে দেশের পক্ষে জনমত তৈরির কাজ করেন তিনি৷

অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর শত্রু মুক্ত হয় রাজশাহী৷ তখন মুক্ত-স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরা খাতুন৷